শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
পদার্থবিজ্ঞানে বাংলাদেশের প্রথম ইমেরিটাস অধ্যাপক

শিক্ষা ও গবেষণায় অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক

মর্তুজা নুর, রাবি প্রতিনিধি

শিক্ষা ও গবেষণায় অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক

অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক। পদার্থবিজ্ঞানে বাংলাদেশের প্রথম ইমিরেটাস অধ্যাপক। শিক্ষকতা ও গবেষণা সবকিছুই হার মেনেছে তার বয়সের কাছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের বয়স প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই হলেও শিক্ষকতা ও গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন তিনি। ৭৮ বছর বয়সে এসেও সকাল ৮টা থেকে রাত ৭টা কি ১০টা পর্যন্ত বিভাগে শিক্ষকতা ও গবেষণার রুটিন পাল্টায়নি তার। ৫৮ বছর ধরে পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। অবসরে গিয়েছেন অনেক দিন। কিন্তু কাজ থেকে অবসর নেননি। বৃদ্ধ বয়সেও যুবক বয়সের মতো পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি। আর এই বিষয়টাকে ভালোভাবে উপভোগ করছেন। দেশের প্রখ্যাত এই পদার্থবিজ্ঞানী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪১ সালের ১৭ অক্টোবর পাবনা শহরের রাধানগর মহল্লায়। তার ছেলেবেলা পাবনা শহরেই কাটে। দেশ ভাগের সময় তার বাবা হরিপদ বসাক ভারতের মালদহে চাকরি করতেন। তবে দেশ ভাগের পর মা জন্মভূমি ছেড়ে যেতে রাজি হননি। ফলে বাবাকে চাকরি ছেড়ে চলে আসতে হলো। আস্তে আস্তে সংসারে অভাব দেখা দেয়। তবুও মা ছেলেকে টিউশনি করতে দিতেন না। সারা দিন সংসারের কাজ করে গভীর রাত পর্যন্ত চরকায় সুতা কাটতেন। ভোরে মায়ের রিলে করা সুতার বান্ডেল কাঁধে করে নিয়ে সেগুলো ফ্যাক্টরিতে দিয়ে আসতেন। সোয়া মাইল হেঁটে নতুন সুতা বাড়িতে রেখে বিদ্যালয়ে পড়তে যেতেন। এভাবেই পড়ালেখা করেছেন অরুণ কুমার বসাক। অরুণ কুমার বসাক ১৯৫৭ সালে পাবনার রাধানগর মজুমদার একাডেমি হতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড ঢাকা এর অধীনে ফার্স্ট ডিভিশনে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। স্কুল জীবন শেষ করে তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৫৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তিনি তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় তদানীন্তন রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। সেই সময় সেই কলেজে একজন শিক্ষক ছিলেন যার নাম মাখন লাল চক্রবর্তী, যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেই যুগে প্রথম শ্রেণি পাওয়া। সেই মাখন লাল চক্রবর্তীই আজকের অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাকের মধ্যে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। সেই অরুণ কুমার বসাক স্যারও অনেক বছর ধরে অনেকের মাঝে আলো জ্বালিয়েছেন। একজন মানুষ হয়েছেন বহু মানুষ তৈরির কারিগর। মানুষ তৈরির এই কারিগর ছাত্র জীবনেও ছিলেন তুখোড় মেধাবী। ১৯৫৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক, ১৯৫৯ সালে ইন্টারমিডিয়েটে রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে সম্মিলিত মেধাতালিকায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ছিল না বলে রাজশাহী কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে দুই বছরের অনার্সে পড়েছেন। সেখানে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্সেও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। যেদিন তার এমএসসির রেজাল্ট বেরোল, পরদিন থেকে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করলেন। প্রথম ক্লাসটি নিতে হয়েছিল এমএসসির। ক্লাসের ৬০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীই তার ক্লাসমেট, বাকিরা এক ব্যাচ সিনিয়র। তখন তাকে দুটি কোর্স পড়াতে হতো। এমএসসির থিসিসের মাধ্যমে ১৯৬৩ সালে তিনি গবেষণার ভুবনে প্রবেশ করেন। তার সুপারভাইজর ছিলেন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক আহমদ হুসেন। ক্ষেত্র ছিল কণাবিজ্ঞান। এক বছরের মাথায় ফলাফল পেয়েছিলেন। এটি নিয়ে তখনকার ডেইলি পাকিস্তান অবজারভারে খবর প্রকাশিত হয়েছে। থিসিস পেপারটি ১৯৬৪ সালের ২৭ আগস্ট চীনের চায়না সিম্পোজিয়ামে প্রথম উপস্থাপন করা হয়। খুব প্রশংসা লাভ করে। তবে ১৯৬৫ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করায় যেতে পারেননি। ফলে ১৯৭২ সালে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে বিলেতে যান। কিন্তু ব্রিটেনের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় জানায়, কণাবিজ্ঞানে গবেষণার জন্য পোস্ট ফাঁকা নেই। নিউক্লিয়ার ফিজিকসে গবেষণার সুযোগ আছে। ফলে নিউক্লিয়ার ফিজিকস নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তিনি। সেখানে প্রোটন, নিউট্রন, হিলিয়াম থ্রি ইত্যাদি কণার আচরণ সম্পর্কে তিনি গবেষণা করেছেন। দেশে ফিরে ১৯৯৭ সাল থেকে নিউট্রন স্টার নামে এক ধরনের তারা যেগুলো থেকে আলো বের হয় না, সেগুলোর স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে গবেষণা করেছেন। সূর্য যে আমাদের আলো দিচ্ছে, এটিও একদিন নিউট্রন স্টার হয়ে যাবে। দেশের একমাত্র গবেষক হিসেবে ড. অরুণ কুমার বসাক যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে এই প্রজেক্টে গবেষণা করেছেন। প্রথম ধাপে ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সালের জুলাই এবং পরে ২০০২-এর আগস্ট থেকে ২০০৮ সালের জুলাই পর্যন্ত যে গবেষণাকর্ম চালিয়েছেন, তার ফলাফল নিয়ে ৩৩টি আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র লিখেছেন। সেগুলো ইংল্যান্ডের ইনস্টিটিউট অব ফিজিকস [আইওপি] ও যুক্তরাষ্ট্রের ফিজিক্যাল সোসাইটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। দেশি-বিদেশি জার্নালে তার প্রায় ১৫০ বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। অনার্স লেভেলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য তার লেখা ‘ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞান’ বইটি বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে।

সর্বশেষ খবর