শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা
আফসানা আসিফ সোমা

পাটের সম্ভাবনা নিয়ে এক নারীর লড়াই

সাইফ ইমন

পাটের সম্ভাবনা নিয়ে এক নারীর লড়াই

ছবি : রাফিয়া আহমেদ

পাটশিল্প এখন আর আগের সেই সোনালি অবস্থানে নেই। কিন্তু পাট নিয়েই স্বপ্ন দেখছেন এবং প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছেন কেউ কেউ। তেমনই একজন পাটজাত পণ্য তৈরি ও রপ্তানিতে কাজ করে যাওয়া আউটস্ট্যান্ডিং বিজনেস উইমেন খেতাব পাওয়া আফসানা আসিফ সোমা। বিশ্বের নানা দেশে তার প্রতিষ্ঠানের তৈরি পাটজাত পণ্য রপ্তানি করছেন নিয়মিত। লড়াইটা শুরু করেছিলেন অনেক আগেই। তরুণ বয়সে কানের দুল বিক্রি করে শুরু করেছিলেন প্রথম ওয়ার্কশপ...

 

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। আফসানা আসিফ সোমাও স্বপ্ন দেখেছিলেন নিজেকে বিকশিত করার। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সফলতা পেয়েছেন এই নারী উদ্যোক্তা। নিজের সৃষ্টিশীলতা আর মেধা পুঁজি করে আফসানা আসিফের পথচলা। তার প্রতিষ্ঠান এসিক্স বিভিন্ন পাটজাত পণ্য তৈরি ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে। আর এ থেকে প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর ১.৫ মিলিয়ন ডলার ব্যবসা করছে। পাটপণ্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ও পাটশিল্পের উন্নয়নে কাজ করা আফসানা আসিফ বিশ্বাস করেন ব্যক্তিগত অর্জন বলে কিছু নেই। ব্যক্তি-উন্নয়ন যখন দশের কাজে লাগে তখনই একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে কাজে লাগে। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববাজারে পাটপণ্যের চাহিদা ক্রমে বাড়ছে।

এই জায়গায় দাঁড়িয়ে পাটশিল্প নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। বহুমুখী পাটপণ্যের গুণগতমান, দেশ ও দেশের বাইরে এর ব্র্যান্ডিং ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য কাজ করতে হবে। দেশের সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পাটপণ্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে এগিয়ে এলে এ শিল্প খুব দ্রুত এগিয়ে যাবে। আমি চাই তরুণরা এ সেক্টরে আসুক। তারা আমার এফোর্ডটাকে যেন তাদের স্মার্টনেসের সঙ্গে ক্যারি করতে পারে।’ একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি আরও বলেন, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। একজন নারী যতই বাইরে কাজ করুক তাকে ঘরে ফিরে আবার সংসারে মনোযোগ দিতে হয়। এটাই ভালোবাসা। এভাবেই সংসার সুখের হয়। নারীদের কাছে এক্সপেকটেশনটা একটু বেশি থাকে সবসময়।’ শৈশব থেকেই মায়ের সঙ্গে শাড়ি ডিজাইন করতে করতেই হাতেখড়ি। তখনই মনের ভিতর একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছিল যে নিজে কিছু একটা করবেন। আফসানা আসিফ বলেন, ‘ছোটবেলায় দেখতাম আম্মু হাতের কাজ করতেন। আম্মুকে দেখে দেখে আমিও করতাম। এটার প্রতি আমার প্রচন্ড আগ্রহ ছিল। তারপর বিয়ে হলে আমার হাজব্যান্ডও প্রচন্ড সাপোর্ট দিয়েছেন আমাকে। আমি তো ডিজাইনারই হতে চেয়েছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্সে পড়েছিলাম। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিন্তু একজন ডিজাইনার লাগে। এখন অনেক বেশি ছেলেমেয়ে ডিজাইনিংয়ের দিকে আসছে। আর আমাদের দেশ অনেক রিসোর্সফুল। পুরো পৃথিবীতে এই রিসোর্স কাজে লাগিয়ে কত রকম কত কিছু করা যায় তা কিন্তু আমাদের দেশর তৃণমূল পর্যায়ে সবাই জানে না। আমি লাভ-লোকসান বুঝি না। আমি প্যাশন থেকেই এ কাজে এসেছি। এটা আমার মনের ক্ষুধা। মাই অর্গানাইজেশন ইজ লাইক মাই চাইল্ড।’ আফসানা আসিফ পাটের কাজ শুরু করেছেন ২০১০-এ এসে, কিন্তু ডিজাইনিংয়ের কাজে আছেন ২৫ বছর ধরে। তরুণ বয়সেই নিজের কানের দুল বিক্রি করে শুরু করেন প্রথম ওয়ার্কশপ। আফসানা আসিফ বলেন, ‘আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স শুরু করছি তখন আমার ক্যারিয়ার নিয়ে বাসার সবাই ভাবতে শুরু করে। আমি সবাইকে জানাই যে আমি ব্যবসা করব। তখন ব্যবসার জন্য টাকা জোগাড় করতে গিয়ে কানের দুল বিক্রি করে দিই। এই দুল রাখা ছিল আমার বিয়ের জন্য। এই দুল আমি পুরান ঢাকায় গিয়ে বন্ধক রেখে টাকা নিয়ে এলাম। আমাকে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছিল। আমার বাসা ছিল মোহাম্মদপুর। জেনেভা ক্যাম্পের পাশে। কাপড় নিয়ে এসে আমি বিহারিদের দিয়ে কাজ করাতাম। আমি চেয়েছিলাম আমার দেশের ছেলেরা যেন কাজ শিখতে পারে। তারপর আমি চট্টগ্রামে অনেক ছেলেকে ডেভেলপ করেছি।’ আর এটাই তাকে আজকের একজন সফল পাটজাত পণ্য প্রস্তুতকারক হিসেবে গড়তে কাজে লেগেছে।

একসময় শিক্ষকতা করেছেন এই নারী উদ্যোক্তা। জাতীয় দলের ক্রিকেটার তামিম ইকবাল, বর্তমান শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী নওফেল থেকে শুরু করে মীর হেলালসহ অনেকেই আফসানা আসিফের একসময়ের ছাত্র। সানসাইন গ্রামার স্কুলে পড়িয়েছেন অনেকটা সময়। চট্টগ্রামেই একটা ওয়ার্কশপ চালু করেছিলেন যেখানে মেয়েদের নানারকম জামা ও শাড়ি ডিজাইন করা হতো। আফসানা আসিফের স্টুডেন্টরা তার ডিজাইন করা কাপড় খুব পছন্দ করতেন। এভাবেই একসময় ব্যাপক সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল আফসানার ডিজাইনার হিসেবে। সে সময় আবার ঢাকায় চলে আসতে হয়েছিল তাকে পরিবারের সঙ্গে। ঢাকায় এসে স্কলাস্টিকায় জয়েন করেন। জয়েন করেছিলেন ইকোনমিকস ও বিজনেস স্টাডিজের শিক্ষক হিসেবে। কিন্তু চট্টগ্রামের সময়টাকে ভীষণ মিস করতেন তিনি। প্রতি সপ্তায় একবার চট্টগ্রামে যেতেন। চট্টগ্রামে একসময় এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন যে অন্য ব্যবসায়ীরা কাপড় বিক্রির সময় বলতেন, ‘আফসানা আসিফের মতো ডিজাইন করা কাপড়’।

আফসানা আসিফ বলেন, ‘তখন খুব রাগ হতো যে আমার ডিজাইন চুরি করছে অন্যরা। এখন মনে হয় আসলে তারা আমার উপকারই করেছে। আমার ব্র্যান্ডিং করেছে।’ ফ্যাশন ডিজাইনার ও উদ্যোক্তা হিসেবে ক্যারিয়ার তুঙ্গে থাকা অবস্থাতেই পাটশিল্পে আসা নিয়ে আফসানা আসিফ বলেন, ‘একদিন মশিউর ভাই বললেন পাট নিয়ে কিছু একটা করা যায়। আমিও আগ্রহী হলাম। আমার মনে হলো এই সেক্টরটাতে অনেক কাজ করা যাবে। আবার দেখলাম আমি এত দিন যে মেটারিয়েলটার ওপর ডিপেন্ড করি ডিজাইনিংয়ে কাপড়ের ক্ষেত্রে ভারত-পাকিস্তানের ওপর, আমাদের সেই সোর্সটা নেই। কিন্তু পাটজাত পণ্যে শূন্য থেকে শুরু করে পুরোটা আমাদেরই। পাট নিয়ে আমি স্টাডি শুরু করলাম। মার্কেটের প্রডাক্টগুলো দেখলাম কেমন জানি কমপ্লিট না। কী যেন একটা মিসিং। এই জায়গাটাতে এসে আমি কাজ শুরু করলাম। তখন আমি দুটি ছেলে নিয়ে ফ্যাক্টরি শুরু করি। ধানমন্ডিতে একটি এক্সিবিশন করি। একটা সময় পাটের জুতা বানাতেও শুরু করলাম। এখন বয়স হয়েছে। মাঝে মাঝেই মনে হয় আরও আগে কেন শুরু করলাম না। তাহলে একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারতাম। আমাদের দেশ একটা সোনার খনি। উন্নত কাঁচা পাটগুলো দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এই কাঁচা পাট যখন রপ্তানি হচ্ছে তখন অনেক কম দাম পাই আমরা। সো যে সুতা বানাবে সে পাট পাচ্ছে না। আমরা কাপড় পাচ্ছি না। রেভিনিউ আসবে ভ্যালু এডিশন দিয়ে।’ কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও পাট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন আফসানা আসিফ। তার প্রতিষ্ঠানের তৈরি পণ্যগুলো দেশের বাইরে কানাডা, জাপান, ফ্রান্স, ইতালিতে ব্যাপক প্রশংসিত ও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ব্যক্তিজীবনে এই নারী উদ্যোক্তা তিন সন্তানের জননী। তার স্বামী বাংলাদেশের প্রখ্যাত গীতিকার আসিফ ইকবাল। আফসানা আসিফের বাবা সুলতান আহমেদ, মা নীলুফার বেগম। তিন সন্তান হলেন আরাফ, আরিবা, আলিনা।

সর্বশেষ খবর