শিরোনাম
শনিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
আদর্শ

সততায় অনন্য নজির মমর

সামছুজ্জামান শাহীন, খুলনা

সততায় অনন্য নজির মমর

খুলনার বটিয়াঘাটার প্রত্যন্ত এলাকায় টাকার ব্যাগ কুড়িয়ে পায় নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রী মম। ব্যাগে ছিল দুই লাখ টাকা ও জমি কেনাবেচার গুরুত্বপূর্ণ দলিল। একটুও না ভেবে এই কিশোরী টাকার ব্যাগ নিয়ে হাজির হয় স্থানীয় থানায়। তারপর পুলিশের মাধ্যমে টাকা ফিরিয়ে দেওয়া হয় প্রকৃত মালিককে। মম অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কনস্টেবল শংকর মল্লিকের মেয়ে। বাবা শংকর মল্লিকও প্রায় ৪০ বছর আগে এভাবেই কুড়িয়ে পাওয়া টাকা পৌঁছে দিয়েছিলেন প্রকৃত মালিকের কাছে। বাবার সততায় আলোর পথে পা বাড়িয়েছে মম। টাকা ফেরত দেওয়ার পর সবার প্রশংসায় ভাসছে মম। এলাকায় হাটে-বাজারে, চায়ের দোকানে সর্বত্র তাকে নিয়েই আলোচনা...

 

১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস, রাত ২টা। ঢাকার শাহবাগ এলাকায় ডিউটি শেষ করে হেঁটে সূত্রাপুর থানায় ফিরছিলেন পুলিশ কনস্টেবল শংকর মল্লিক। পথে বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে একটি ব্রিফকেস কুড়িয়ে পান। ব্রিফকেস খুলতেই ভিতরে মিলল থরে থরে সাজানো প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ টাকা। কিছু না ভেবেই ব্রিফকেস ভর্তি ওই টাকা জমা দেন থানায়। পরে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে টাকার মালিক খোঁজা হয়। সন্ধান পেয়ে থানায় গিয়ে উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে ব্রিফকেসসহ টাকা নিয়ে যান মালিক। বিভিন্ন সময় পরিবারের সদস্যদের কাছে গর্ব নিয়েই সততার এসব গল্প করেছেন শংকর মল্লিক।

১৯৭৮ সাল থেকে ২০১৯। যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। একচল্লিশ বছর পর খুলনার বটিয়াঘাটার প্রত্যন্ত এলাকায় আবারো টাকার ব্যাগ কুড়িয়ে পেল নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রী মম মল্লিক ওরফে জিতু। কিছু না ভেবে ছোট মেয়েটিও টাকার ব্যাগ নিয়ে হাজির হয় স্থানীয় থানায়। তারপর পুলিশের মাধ্যমে টাকা ফিরিয়ে দেওয়া হয় প্রকৃত মালিককে। মম অবসরপ্রাপ্ত সেই পুলিশ কনস্টেবল শংকর মল্লিকের মেয়ে। বাবার সততায় আলোর পথে পা বাড়িয়েছে মম। বাবা ও মেয়ের সততার এই কাহিনি এখন মানুষের মুখে মুখে। স্কুলে, হাটে-বাজারে বের হলে সবাই সম্মানের চোখে তাকায় পরিবারটির দিকে। অনেকেই হাসি মুখে কথা বলতে এগিয়ে আসেন। সততার আলোয় বদলে নিতে চান নিজেকে। শংকর মল্লিক বলেন, ‘মেয়ের এই সততার পরিচয়ে আমি যে কী খুশি তা বলে বোঝানো মুশকিল। গরিব ঘরের মেয়ে যে এটা করতে পারবে তা কল্পনাতীত। এ ঘটনার পর সবাই মেয়েকে আশীর্বাদ করতে বাড়িতে আসছেন আর বাবা হিসেবে তা দেখে আমার চোখে আনন্দের জল গড়িয়ে নামে।’ 

ঘটনার দিন ৯ সেপ্টেম্বর সকাল বেলা। ঘুম থেকে উঠেই প্রাইভেট পড়তে রওনা হয় মম। পৌনে আটটার মধ্যে যেতে হবে কয়েক মাইল দূরে শিক্ষকের বাড়িতে। প্রতিদিনের মতো ভ্যানে করেই রওনা হয়। বটিয়াঘাটা বাজার পার হতেই চোখে পড়ে রাস্তার কাছে একটি ছোট খয়েরি রঙের ব্যাগ পড়ে আছে। ব্যাগটি পড়ে থাকতে দেখেই সন্দেহ হয়। ভ্যান থেকে নেমে ব্যাগটি কুড়িয়ে চেইন খুলে দেখে তাতে অনেক টাকা। রয়েছে কিছু কাগজপত্র। তারপর ব্যাগটি নিয়ে ভ্যানে উঠে সোজা চলে আসে থানায়। যাদের ব্যাগ হারিয়েছিল তারাও তখন থানায় উপস্থিত। জমি কিনতে উপজেলা সাব-রেজিস্ট্র্রি অফিসে টাকা নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাড়াহুড়ায় দুটি ব্যাগের মধ্যে একটি পড়ে যায়। পুলিশের মাধ্যমে ব্যাগের মধ্যে থাকা দুই লাখ টাকা ও কাগজপত্রের প্রমাণ দিয়ে তারা ব্যাগটি নিয়ে চলে যান। যাওয়ার সময় জোর করে মমকে কিছু টাকা বকশিশ দিয়ে যান।

টাকা ফেরত দেওয়ার পর সবার প্রশংসায় ভাসছে মম। ঘটনা জানার পর হোগলবুনিয়া-হাটবাটী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-সহপাঠীরা মমকে ঘিরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। মম ওই স্কুলের নবম শ্রেণির বাণিজ্য শাখার ছাত্রী। ওই দিনের ঘটনা সবার কাছে তার মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন সততার এই আলো ভাগাভাগি করে নিতে চায় সহপাঠীরাও।

পরিবারে তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট মম। বাড়িতে সবাই তাকে জিতু বলেই ডাকেন। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। সংসার-শ্বশুর বাড়িতে তারাও বেশ সুখী। সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে মম জানায়, বাবার কাছে শুনেছি সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হলো থানা। এ কারণে ব্যাগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে থানায় যাওয়ার কথা মাথায় আসে। বাবা-মার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন বা কোনো বিপদ হতে পারে, সে কথা মাথায় আসেনি। কুড়িয়ে পাওয়া ব্যাগটি তার মালিকের কাছে ফেরত দেওয়া আমার দায়িত্ব ছিল, আমি সেটিই করেছি। মমর স্কুলের প্রধান শিক্ষক অন্নদা শংকর রায় বলেন, ছোট বেলা থেকেই সে পড়াশোনায় বেশ ভালো। মেধাবী মেয়েটি বড় হয়ে বিসিএস ক্যাডার হতে চায়। মমর সততার এই দৃষ্টান্ত আমাদের সম্মান আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর