শনিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
আগামীর প্রজন্ম

ভিন্নধারার বিদ্যাবাড়ি

জিকরুল হক, সৈয়দপুর (নীলফামারী) থেকে

ভিন্নধারার বিদ্যাবাড়ি

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মডেল হয়ে গড়ে উঠছে নীলফামারীর সৈয়দপুরে এক বিদ্যাবাড়ি। ভিন্নধারার এ বিদ্যাবাড়ির নাম ডাংগারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। উপজেলার বাঙ্গালীপুর ইউনিয়নে অবস্থিত এ প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যসূচির বাইরে শিশু শ্রেণি থেকেই মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনানো হয় শিক্ষার্থীদের। একই সঙ্গে শিশুদের হৃদয়ে গেঁথে দেওয়া হয় মানবতার বীজ।

 

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সামাজিক মূল্যবোধের চর্চার মাধ্যমে শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ডাংগাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সারা দেশে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাবা মায়ের স্নেহের পরশে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখা করা হয়। শ্রেণিকক্ষে কোনো ছাত্রছাত্রী স্যান্ডেল বা জুতা পায়ে প্রবেশ করে না। শ্রেণিকক্ষ পরিচ্ছন্ন ও ধুলোবালিমুক্ত রাখতে এমন নিয়ম চালু করা হয়েছে বিদ্যালয়টিতে। ফুল ও ফলের ছবি এঁকে অঙ্ক শেখানো হয়। ইংরেজিতে পারদর্শী করতে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণমালা দিয়ে বাংলায় উত্তর লেখা হয়েছে ক্লাসের চারদিকের দেয়ালে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসের বেঞ্চে বসলেই ইংরেজি শব্দের বাংলা উত্তর তাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। একই শব্দের উত্তর বারবার দেখার ফলে খুব সহজেই শিশুরা শব্দের অর্থ মনে রাখতে সক্ষম হয়।

শিশুদের হৃদয়ের মানসপটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগরিত করতে বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে আঁকা হয়েছে জাতীয় পতাকা। বিদ্যালয় ভবনে অঙ্কিত আছে বঙ্গবন্ধু ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ছবি। বিদ্যালয় চত্বরে প্রবেশ করা মাত্রই সেসব ছবি চোখে পড়বে। স্কুলের অফিসকক্ষে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার রয়েছে। এই কর্নারে দেশের মানচিত্র, জাতীয় চার নেতা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলনের প্ল্যাকার্ড, ভাষার দাবি আদায়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমতলার ছাত্রসভা, মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরের ১১ জন সেক্টর কমান্ডার, সাত বীরশ্রেষ্ঠ, ১৪ বীরাঙ্গনা, পাকসেনা কমান্ডের আত্মসমর্পণ, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাত মার্চের ভাষণের ছবি, সৈয়দপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ও স্থানীয় বধ্যভূমির ছবি স্থান পেয়েছে। ওই কর্নারের চিত্র ও তথ্য বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনানো হয়। ওই গল্পের শুরু হয় ১৯৫২ সাল থেকে। যার সমাপ্তি টানা হয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে। এতে করে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিশু শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের মোটামুটি ইতিহাস জানতে পারে। বিশেষ করে লিঙ্গ সমতা শেখাতে শ্রেণি কক্ষের দেয়ালে বিভিন্ন লেখকের বাণী লেখা রয়েছে। যা দেখে শিশুদের মনে জাগরিত হবে ছেলে মেয়েতে কোনো বিভেদ নেই।

এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে জানতে অফিস কক্ষে মুক্তিযুদ্ধ বই কর্নার রয়েছে। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা বই নিয়ে শিক্ষার্থীরা টিফিন ও পড়ার অবসরে পড়ে। রয়েছে সততা স্টোর। এই স্টোর থেকে যে যার প্রয়োজনমতো খাতা কলম কিনে টাকা রেখে যায়। ছোট বেলা থেকেই সৎভাবে গড়ে ওঠার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে এই সততা স্টোরকে। বিদ্যালয়ের এক কোনায় গড়ে তোলা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে শহীদ মিনারে স্কুলের শিক্ষার্থীরা ফুল দেয়। শহীদ মিনারে মালা দেওয়ার সময় কোনো শিশু শিক্ষার্থী ভুলেও স্যান্ডেল বা জুতা পায়ে শহীদবেদিতে ওঠে না। বিদ্যালয়ে নামাজ পড়ার জন্য রয়েছে নামাজঘর। আর পাঠ্যবইয়ের বাইরের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে রয়েছে লাইব্রেরি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে লাইব্রেরির নামকরণ করা হয়েছে। দেশের বরেণ্য লেখক, কবি, সাহিত্যিকদের নামে শ্রেণিকক্ষের নামকরণ করা আছে। এতে করে শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই এমন বরেণ্য ব্যক্তিদের নাম মনে রাখতে পারে। এ ছাড়াও ছোটবেলা থেকে সাংগঠনিক মনোভাব ও নেতৃত্ববোধ জাগাতে বিদ্যালয়টিতে স্টুডেন্টস কাউন্সিল, কাবদল, খুদে ডাক্তার, কিশোর-কিশোরী ক্লাব ও প্রাক্তন  শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে শিক্ষা ভলানটিয়ার দল।

ডাংগাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেতিবাচক দিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। এ জন্য এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবসর সময়ে খেলাধুলা আর গল্পের বই পড়ে সময় কাটায়। অপরদিকে এসব অভ্যাসে অভ্যস্ত হতে প্রতিনিয়ত শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের তালিম দিচ্ছেন।

সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে কথা হয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিবলি বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা বাবা মো. সৈয়াদুল হকের কাছে দেশপ্রেমের শিক্ষা পেয়েছি আর মা কমলা বেগমের কাছে শিখেছি শিশুদের কীভাবে ভালোবাসা আর স্নেহের পরশে আবদ্ধ করা যায়। বাবা মায়ের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে কর্ম জীবনে প্রবেশ করি। এই বিদ্যালয়ে ২০১৭ সালের ২ এপ্রিল প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই। আমিই এই বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষক। এর আগে যারা ছিল তারা সবাই ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে ভাবতে থাকি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে কীভাবে গড়ে তোলা যায়। আর শিক্ষার্থীদের মাঝে দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কীভাবে উজ্জীবিত হবে এই চিন্তা করতে থাকি। চিন্তা বাস্তবায়নে প্রয়োজন অর্থের। এ ব্যাপারে সহকর্মী রামপ্রসাদ ও সহকারী শিক্ষা অফিসার মুসরাত জাহান সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তাদের অভয় আমার বন্ধুর পথচলায় একের পর এক সফল কাম হতে থাকি। তার মতে পরিকল্পনা আর সৎ মনোভাব নিয়ে কাজ করলে অনেক বেশি অর্থের প্রয়োজন পড়ে না। নিজের বেতনের টাকার সঙ্গে সহকর্মীদের আর্থিক সহায়তা আমার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সফলতা বয়ে এনেছে। যার কারণে আমি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান হওয়ার গৌরব ইতিমধ্যে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর