শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
মূল রচনা

বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে দেওয়া সেই মেয়েটি

রাশেদুর রহমান, নেপাল থেকে

বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে দেওয়া সেই মেয়েটি

এখনো চেহারায়  কৈশোরের ছাপ। রুখে না দাঁড়ালে আরও দুই বছর আগে বিয়েই হয়ে যেত ১৪ বছরের ইতি খাতুনের। কোনোভাবেই তা না মেনে তখনকার ১২ বছরের কিশোরী বাড়ি থেকে পালিয়ে যোগ দিয়েছিলেন আরচারি ক্যাম্পে। দুই বছর পর সেই কিশোরী দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের হয়ে খেলতে গিয়ে জিতে নিয়েছেন তিনটি সোনার পদক।

 

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার এক বক্তব্যে বলেছিলেন, যে জাতি নারীদের মর্যাদা দেয় না তারা উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পারে না। যদি উন্নতি করেও তবে তা স্থায়ী হয় না। কেবল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কেন, এমন মহান বক্তব্য আরও অনেক মনীষীই দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতা এখনো নারীদের মর্যাদা দেওয়ার সেই সর্বোচ্চ লক্ষ্যটা অর্জন করতে পারল কই! না হলে ইতি খাতুনের মতো সোনার মেয়েকে কী বাল্যবিয়ে থেকে পালাতে হয়! বাল্যবিয়ের খপ্পরে না পড়লে আরও কত ইতি খাতুনের জন্ম হতো বাংলাদেশে! আরও কত সোনার মেয়ে দেশের পতাকা উড়াতেন বিশ্ব মঞ্চে!

ইতি খাতুন। ১৪ বছরের এক বালিকা। তার হাত ধরেই সোনার পদক পেয়েছে বাংলাদেশ। তাও একটি নয়। তিন তিনটি। অথচ এই ইতি খাতুনই এসএ গেমসে যাত্রার আগে ভীরু ভীরু কণ্ঠে নিজের লক্ষ্যের কথা বলছিলেন। সেসময় তিনি সোনার পদক জয়ের কথা বলেননি। কেবল এতটুকুই বলেছিলেন, নিজের সেরাটা খেলতে পারলে অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব। নিজের ভালোটাই কেবল নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো খেলাটাই খেললেন এই নারী ক্রীড়াবিদ। এস এ গেমসের ইতিহাসে প্রথম মেয়ে হিসেবে একই আসরে জয় করলেন তিনটি সোনার পদক। সত্যিই তিনি সোনার মেয়ে। এস এ গেমসের ১৩তম আসরে রিকার্ভে মেয়েদের দলগত ও মিশ্র দলগত ইভেন্টের পর রিকার্ভ মেয়েদের এককেও সোনার পদক জিতেছেন ইতি খাতুন। ঘরোয়া টুর্নামেন্টে নিজেকে আগেই চিনিয়েছেন ইতি। এ বছর জাতীয় জুনিয়রে রিকার্ভের ব্যক্তিগত ইভেন্টে জেতেন রুপা এবং জুনিয়র ক্যাডেট বিভাগে জেতেন সোনা। এবার এস এ গেমসেও নিজেকে মেলে ধরলেন ইতি খাতুন। বাংলাদেশের এস এ গেমসের ৩৫ বছরের ইতিহাসে এর আগে কোনো নারী খেলোয়াড় একই গেমসে তিনটি সোনা জিততে পারেননি। এর আগে একই গেমসে সর্বোচ্চ সোনার পদক জেতেন সাঁতারু মোশাররফ হোসেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় এস এ গেমসে সুইমিংপুলে রীতিমতো ঝড় তোলেন তিনি। বাংলাদেশের ৯টি সোনার মধ্যে ৫টি সোনাই জেতেন এ সাঁতারু।

অথচ ইতিহাসটা ভিন্নও হতে পারত। আরও হাজারও বালিকা বধূর মতোই ইতি খাতুনের নাম হারিয়ে যেতে পারত কালের গহ্বরে। বছর দুয়েক আগে মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে ঠিক হয়েছিল ইতি খাতুনের। চুয়াডাঙ্গার এক নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য ছিলেন তিনি। বাবা ইবাদত আলী হোটেলের কর্মচারী। তিন মেয়ে ইভা খাতুন, ইতি খাতুন ও স্মৃতি খাতুনকে নিয়ে সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হতো তাকে। পরিবারের স্বাভাবিক খরচ জোগাতেই দিন ফুরিয়ে যেত তার। মেয়েকে বিয়ে দিয়ে অনেকটা দায়মুক্তি চেয়েছিলেন হয়তো তিনি। অবশ্য পরবর্তীতে সিদ্ধান্তটা যে ভুল ছিল তাও এখন তো পেছন ফিরে তাকানোর আর সময়ই নেই। ইতি খাতুনও আর পেছন ফিরে তাকাতে চান না। তবে পেছনের ইতিহাসটা তো কখনই মুছে যাবে না। ইতি খাতুন সেসময় মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তেন। পুতুল খেলার বয়স ছিল তার। অথচ বিয়েটা ঠিক হয়ে যায়। ওই সময় আরচারি ফেডারেশন চুয়াডাঙ্গায় প্রতিভা অন্বেষণ ক্যাম্প করে। বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে প্রতিভা অন্বেষণ ক্যাম্পে যোগ দিয়েছিলেন ইতি। অনেকটা পালিয়ে আসার মতোই ছিল ব্যাপারটা। পরিবারের সম্মতি ছিল না ইতির এই ক্যাম্পে যোগ দেওয়া। সেখানে আরচারির স্থানীয় কোচ সালেহ ইমরানের নজর কাড়েন পারফরম্যান্স দিয়ে। এরপর আরচারির ক্যাম্পে যান। সেই ক্যাম্পই ইতিকে বিয়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছে তখন। সেই অধ্যায় আর মনে করতে চান না সোনাজয়ী ইতি খাতুন। তিনি বলেন, ‘এখন আর সেই কথা মনে করতে চাই না। তখন বিয়ে হয়ে গেলে অবশ্য জীবনের গল্প ভিন্ন হতো। শুধু এটুকু বলব আরচারি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। আমার মাধ্যমে আরচারি আজ সোনার পদক জেতায় খুব ভালো লাগছে।’ আরচারি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজিবউদ্দিন আহমেদ চপল ইতির উত্থান সম্পর্কে বলেন, ‘কোচ সালেহ ইমরানকে আমাকে প্রথম ইতির সন্ধান দেয়। এরপর আমার ছেলে তার ক্লাব তীরন্দাজ সংসদে ইতিকে অন্তর্ভুক্ত করে। তখন আমাদের প্রতিভা অন্বেষণ ক্যাম্প হচ্ছিল। সেই ক্যাম্পে আসায় বিয়ে থেকে রক্ষা পায়। আমরাও তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলি।’ ইতি খাতুনের ব্যাপারে দারুণ আশাবাদী ফেডারেশন কর্তারা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি অর্জন করা এই আরচার ভবিষ্যতে দেশকে আরও অনেক কিছুই উপহার দিতে পারবেন বলে আশা করেন তারা। রোমান সানা আরচারিতে বাংলাদেশকে পথ দেখিয়েছিলেন। এবার ইতি খাতুন আর সোহেল রানার মতো তারকারাও উঠে আসছেন।

ইতি খাতুন সোনার পদক জয়ের হ্যাটট্রিক করে বিস্ময়ে বিভূত হয়েছিলেন। নিজেকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। চোখের কোণে চিক চিক করা অশ্রু জানান দিচ্ছিল তার খুশির পরিমাণ। কিন্তু একজন সোনাজয়ী তারকা ছাড়া কী এই অনুভূতি বুঝতে পারার কথা। বোঝার কথা নয়। ইতি খাতুনের মতো যারা খুব সাহসী নয়, কিন্তু মেধাবী। যাদের দেশকে অনেক কিছুই দেওয়ার আছে। যারা পরিবারের সামান্য সহযোগিতা পেলে নিজেদের সব সীমাবদ্ধতা দূর করে বহুদূর এগিয়ে যেতে পারেন সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে। সেসব মেয়ের জন্য এক বার্তা দিয়েছেন ইতি খাতুন। ঠিক সেসব মেয়ের জন্য নয়, তাদের পরিবারের জন্য। ইতি খাতুন বলেন, ‘যেসব মেয়ে তাদের ভবিষ্যৎ গড়তে চায় তাদের সুযোগ দেওয়া উচিত। পরিবারের একটু সহযোগিতা পেলে তারা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারে।’ ইতি খাতুনের এই আহ্বান বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে যাক। বাল্যবিয়ের কবল থেকে মুক্তি পাক সমাজ। আর ইতি খাতুনের মতোই হাজার হাজার মেয়ে দেশের পতাকা বুকে জড়িয়ে বয়ে আনুক অসংখ্য সাফল্য। এবারের এস এ গেমস থেকে এর চেয়ে বড় শিক্ষা আর কী হতে পারে! আরচারিতে ১০টি সোনার পদক এসেছে। রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। ইতি খাতুন এ গেমসে না থাকলে এমন রেকর্ড কি হতে পারত! ইতি খাতুন অবশ্য একটা যুদ্ধ জয় করেই থেমে থাকেননি। এখনো প্রতিটা মুহূর্তেই তাকে যুদ্ধ করতে হয়। তীর ছোড়ার আগে লক্ষ্য স্থির করতে হয়। চারপাশটাকে ভুলে মনোযোগ স্থির করার লড়াইয়ে জয়ী হতে হয়। ইতি খাতুনের এই যুদ্ধ জয়ের গল্প হাজারো মেয়ের জীবন বদলে দিতে পারে। প্রেরণা দিতে পারে নতুন পথে এগিয়ে যাওয়ার। সাহস জোগাতে পারে অসম্ভবকে সম্ভব করার।

সর্বশেষ খবর