শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
নওগাঁর ১০ বীরাঙ্গনা

অবশেষে পেলেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি

বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ

অবশেষে পেলেন  মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি

স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর নওগাঁর রানীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের ১০ বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা মর্যাদা পেলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সব সুযোগ-সুবিধা পেতে যাচ্ছেন স্বামী, সন্তান ও সম্ভ্রম হারানো এই বীরাঙ্গনারা। তবে এই ১০ বীরাঙ্গনার মধ্যে ইতিমধ্যেই চারজন মারা গেছেন। আর বয়সের ভারে ন্যুব্জ কোনোরকম বেঁচে আছেন এই ৬ বীরাঙ্গনা। আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বিশেষভাবে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় গেজেটের মাধ্যমে নওগাঁর আতাইকুলার গ্রামের ১০ বীরাঙ্গনাসহ সারা দেশে ৪৭ জনের নাম প্রকাশ করেছে। আতাইকুলার বানী রানী পাল, ক্ষান্ত রানী পাল, রেণু বালা ও সুষমা সূত্রধর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আর বয়সের ভারে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন মায়া রানী সূত্রধর, রাশমণি সূত্রধর, সন্ধ্যা রানী পাল, কালীদাসী পাল, সন্ধ্যা রানী ও গীতা রানী পাল। একাত্তরের সেই দুর্বিষহ যন্ত্রণা ও সামাজিক বঞ্চনার পাশাপাশি অনেকটা দুঃখ-দুর্দশার অভাব-অনটন আর অসুস্থতার মধ্যেই চলছে তাদের জীবন-সংগ্রাম।

রানীনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর তীরে ছায়ায় ঘেরা শান্ত আতাইকুলা পালপাড়া গ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনীর স্থানীয় দোসর রাজাকার ও আলবদরদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নির্যাতন চালায় এই পালপাড়া গ্রামের সনাতন ধর্মের মানুষদের ওপর। এই সময় গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ জঘন্য ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সংখ্যালঘু পরিবারের কিশোর, যুবক, মাঝ বয়সী ও বিভিন্ন বয়সী নারীদের ধরে ওই গ্রামের সুরেশ্বর পালের বাড়ির বারান্দায় একত্রিত করে ‘জয়বাংলা বলতে হ্যায় নৌকামে ভোট দিতে হ্যায়’ এভাবে পাকসেনারা ব্যাঙ্গাত্ত উক্তি করতে করতে ব্রাশফায়ার করে গোবিন্দ চরণ পাল, সুরেশ্বর পাল, বিক্ষয় সূত্রধর, নিবারণ পালসহ ৫২ জন মুক্তিকামী মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। এ সময় পাকহানাদার বাহিনী গণহত্যা, লুটপাট ও নারী নির্যাতনের মতো ধ্বংসলীলা থেকে বিশেষ করে নারীরা স্বামী সন্তানদের প্রাণে বাঁচানোর শেষ আকুতিটুকু করলেও তাদের মন গলেনি। উল্টো সুযোগ বুঝে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে নওগাঁ জেলা শহরের উদ্দেশে চলে যায়। ৫২ শহীদের তাজা রক্তে সেদিন নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর পানি লাল হয়েছিল। নির্যাতিত নারী ও স্বজনদের হৃদয় বিদারক আর্তনাদ ও কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল।

চোখের জল ফেলতে ফেলতে বীরাঙ্গনা কালীদাসী পাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ওইদিন সকালে যখন আমাদের গ্রামে পাঞ্জাবি আসে তখন আমার স্বামীসহ বাড়ির দরজা লাগিয়ে আত্মগোপনের চেষ্টা করি। কিন্তু স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় গেটের দরজা ভেঙে আমার স্বামীকে টেনেহিঁচড়ে পাঞ্জাবিরা রাইফেল দিয়ে মারতে মারতে যোগেন্দ্রনাথের বারান্দায় ফেলে রাখে। স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইতে গিয়ে আমার কথা না শুনে চোখের সামনে আমার স্বামীসহ ৫২ জনকে হত্যা করে উল্টো আমার ওপরও তারা নানা কায়দায় নির্যাতন চালায়। আমার এক ছেলে আছে। অভাবের সংসারে সেদিন মজুরের কাজ করে। আমিও পেটের তাগিদে কখনো ধান কুড়িয়ে, বয়লারের চাতালে কাজ করে, কিংবা অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করে দুমুঠো ডালভাত খেয়ে কোনো মতো বেঁচে আছি। ভেবেছিলাম বেঁচে থাকতে আর মনে হয় স্বীকৃতি পাব না। তবে অবশেষে এই স্বীকৃতি পেয়ে আমি অনেক খুশি। এই সরকারকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আরেক বীরাঙ্গনা সন্ধ্যা রানী পাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ওইদিন সকাল ৯টার দিকে পাঞ্জাবিরা আমার স্বামী বাড়িতে কাজ করা অবস্থায় সুরেশ্বর পালের বাড়িতে ধরে নিয়ে লাইন করে রাখে এই দিকে পাঞ্জাবিরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লুটপাট ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের নির্যাতন চালায়। আমি ছোট ছেলেকে নিয়ে পাশের বাড়ির এক বড় মাটির ডাবরের ভিতর আশ্রয় নেই। বাচ্চার কান্না পাঞ্জাবিরা শুনতে পেয়ে আমাকে সেখান থেকে বের হওয়ার কথা বলে। তখন আমি পালিয়ে মাঠের মধ্যে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকবাহিনীরা এই গ্রামের মেয়েদের সঙ্গে অনেক খারাপ আচরণ করেছে। আমাদের অবশেষে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। স্বামী হারানোর পর থেকে ৪৭টি বছর অভাব-অনটনের মধ্যে জীবন কাটালাম। তাই স্বীকৃতির পাশাপাশি সব সুযোগ-সুবিধা যদি দ্রুত আমাদের দেওয়া হতো তাহলে যে কদিন বাঁচি তা ভোগ করে যেতে পারতাম।

বীরাঙ্গনাদের পরিবারের সদস্যরা বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, সরকারের দেওয়া স্বীকৃতি পেয়ে তারা খুশি। তাই স্বীকৃতি ও আর্থিক সহায়তার টাকা দিয়ে তারা ভালোভাবে বীরাঙ্গনাদের খাওয়া ও চিকিৎসা করাতে পারবেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও বীরাঙ্গনাদের ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। অবশেষে আমাদের সবার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের এই বীরাঙ্গনারা মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পেয়েছে। আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে উপজেলার সব মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে ১০ বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাকে বিশেষভাবে সংবর্ধনা প্রদান করবেন। আর সেই সঙ্গে তাদের সব প্রকার সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন তিনি। অবশেষে যে ছয়জন বীরাঙ্গনা এখনো বেঁচে আছেন তারা অনন্ত। তাদের নায্য প্রাপ্যটুকু একটু হলেও ভোগ করে ও স্বীকৃতির মুকুট মাথায় নিয়ে সমাজে বেঁচে থাকতে পারবেন। রানীনগর উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অ্যাডভোকেট ইসমাইল হোসেন বলেন, অনেক চেষ্টার পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার অবশেষে আতাইকুলা গ্রামের ১০ বীরাঙ্গনাকে স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে নাম গেজেটভুক্ত হয়েছে। এই স্বীকৃতি প্রাপ্তির সব প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে।

সর্বশেষ খবর