শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
আদর্শ

শ্রবণ-প্রতিবন্ধী, তবু ছড়াচ্ছেন শিক্ষার আলো

মো. নাসির উদ্দিন ও মোজাম্মেল হক সজল, টাঙ্গাইল থেকে

শ্রবণ-প্রতিবন্ধী, তবু ছড়াচ্ছেন শিক্ষার আলো

অদম্য ইচ্ছা শক্তি থাকলে যে কোনো প্রতিবন্ধকতা যে, জয় করা যায় তার উপর্যুপরি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন আবুল হাশেম নামের এক শ্রবণ-প্রতিবন্ধী শিক্ষক। তিনি ন্যায়নিষ্ঠতা ও শতভাগ শিক্ষকের মিশেলে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কের উৎস তার প্রত্যক্ষ ছাত্রদের অভিজ্ঞতা। শিক্ষক যদি মানুষ গড়ার কারিগর হন, তবে তাকে শুধু জ্ঞানের আধার নয়, একজন যথার্থ মানুষও হতে হবে। সে মানুষটিকে আজ তার সততা, একাগ্রতায় তাকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়।

তার বাড়ি টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার কালিয়া ঘোনারচালা গ্রামে। আবুল হাশেম একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধীকতার প্রতিকূলতায় তিনি থেমে থাকেননি। জয় করে নিয়েছেন অসংখ্য শিক্ষার্থীর হৃদয়। প্রমাণ করেছেন, কর্মনিষ্ঠা আর অধ্যবসায় থাকলে যে কোনো প্রতিবন্ধকতা জয় করা যায়।

আবুল হাশেম টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার আউলিয়াবাদ মাজার দাখিল মাদ্রাসার শরীরচর্চা শিক্ষক। ১৯৯৯ সাল থেকে এই মাদ্রাসায় তিনি শিক্ষকতা করছেন। কেবল শরীরচর্চার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। ছাত্রছাত্রীদের অন্যান্য বিষয়ও পড়ান। শিক্ষার্থীরা তার কাছে নিজের সন্তানের মতো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের পড়াশোনার খবর নেন। প্রতিষ্ঠানের চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চ মেরামতসহ যে কোনো কাজ করেন নিজ হাতে। কোনো কাজেই কারও মুখাপেক্ষী হন না। যে কোনো কাজ নিজ হাতে করার মধ্য দিয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের শেখাতে চান, কোনো কাজ ছোট নয়।

আবুল হাশেমের জন্ম ১৯৭৭ সালে। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি প্রচ- ঝোঁক ছিল তার। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হন। তারপর থেকে শ্রবণশক্তি হারানো আবুল হাশেম একেবারেই কানে শুনতে পান না। তিনি জানান, শ্রবণ প্রতিবন্ধী হওয়ার পর স্কুলে গেলে কোনো কথা শুনতে পেতেন না। শিক্ষকরা কী পড়াচ্ছেন, তা বুঝতে কষ্ট হতো। সে সময় তার বাবা লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু কিছুতেই হাশেম মিয়া লেখাপড়া ছাড়তে রাজি হননি। বাবা-মাকে জানিয়ে দেন, লেখাপড়া তিনি করবেনই। অবশেষে বাবা-মা তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। ১৯৯১ সালে সখীপুরের ঘোনারচালা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন আবুল হাশেম। পরে একই উপজেলার সরকারি মুজিব কলেজ থেকে এইচএসসি ও স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

কীভাবে এত জনপ্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠলেন আবুল হাশেম এ বিষয়ে জানতে চাইলে তার স্ত্রী একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা রহিমা খাতুন বললেন অনেক কথা। বিয়ের পর রহিমা খাতুনের প্রথম চাকরি হয় আউলিয়াবাদ মাজার দাখিল মাদ্রাসায়। স্ত্রীর সঙ্গে মাঝেমধ্যে মাদ্রাসায় যেতেন আবুল হাশেম।

কখনো কোনো শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে তাদের হয়ে ক্লাস নিতেন। তখনই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের নজর কাড়েন তিনি। পরে মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি আবুল হাশেমকে শরীরচর্চা শিক্ষকের শূন্য পদে নিয়োগ দেয়। অবশ্য সে সময় অনেকে বিরোধিতাও করেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কীভাবে শিক্ষকতা করবেন। কিন্তু অল্প দিনেই সে সবার ধারণা ভেঙে দেন আবুল হাশেম। সব শিক্ষার্থী ও সহকর্মীর মন জয় করে নেন। আবুল হাশেম মিয়া এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে মাদ্রাসার কাছেই আউলিয়াবাদ গ্রামে বাস করেন। ওই গ্রামে সবাই তাকে এক নামেই চেনেন। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা জানায়, আবুল হাশেম স্যার সবাইকে খুব ভালোবাসেন। শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ালেখার খবর নেন। কোনো শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় দুই একদিন না এলে খোঁজ নিতে ছুটে যান বাড়িতে। আবুল হাশেমের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং মেয়ে ময়মনসিংহ নার্সিং কলেজে বিএসসি নার্সিং বিষয়ে পড়াশোনা করছেন।

মাদ্রাসার শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ভাষ্যমতে, ‘হাশেম স্যার তার কাজের মধ্য দিয়ে মাদ্রাসার এবং স্থানীয় গ্রামের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।’ শ্রবণপ্রতিবন্ধী হয়েও এত কর্মোদ্দীপনা কোথায় পান এমন প্রশ্নের জবাব মনের জোরেই ছুটে চলি! সরল ব্যক্তিত্ব, বিনয়, আন্তরিকতা সহজেই আলাদা করে তোলে তাকে। সরস পাঠদানের ফলে তিনি শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে প্রিয় শিক্ষক হয়ে আছেন এবং শিক্ষা বিস্তারের মশাল হাতে তিনি ছুটছেন অহর্নিশ এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। আঁধারে আলো জ্বালিয়ে মানুষের কাছে ‘হাশেম স্যার’ হয়ে উঠেছেন সেই কবে। শিক্ষকতা পেশার অনন্য উদাহরণ হয়ে ওঠা শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিক্ষক আবুল হাশেম জানান, ‘অগণিত ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ভালোবাসা পাই। এখন নিজেকে স্বার্থক শিক্ষক বলে মনে হয়। আমি তাদের ভালোবাসা পেয়ে আপ্লুত হই। এই ভালোবাসায় আমাকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখে।’ আপাদমস্তক শিক্ষকের আবরণে ঢাকা এই শিক্ষকের শেষ চাওয়া কী তার উত্তর একটাই ‘দীর্ঘ শিক্ষক জীবনে সব শিক্ষার্থীকেই আমি সন্তান ভেবেছি। শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা নিয়ে এভাবেই বেঁচে থাকতে চাই।’

সর্বশেষ খবর