শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
বাধা পেরিয়ে

হাতবিহীন নারী পাইলট জেসিকা কক্স

সুজন খান

হাতবিহীন নারী পাইলট জেসিকা কক্স

মানুষ চাইলেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। সেটা করে দেখিয়েছেন জেসিকা কক্স। হাত নেই তবু আকাশে বিমান উড়ানোর মতো দুঃসাধ্য কাজ করছেন জেসিকা। জেসিকা কক্স আমেরিকার অ্যারিজোনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮৩ সালে। কোনো পরিবারে সন্তান জন্ম নিলে পরিবারের সবাই আনন্দিত হয় আর উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে, কিন্তু জন্ম নেওয়ার পরপরই  জেসিকার পরিবার হয়ে পড়ে বিষণ্ন। এমন একজন জন্ম নিয়েছে যার দুই হাত নেই, এ যেন বিধাতার কাছ থেকে চেয়ে আনা অভিশাপ। সন্তান বাবা-মার কাছে ত্রুটিবিহীন একটি প্রাণ, তাই তো আরও দুই ভাই-বোনের মাঝে জেসিকাও বেড়ে ওঠেন স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু মা-বাবার মনের কষ্ট একটিই ছিল- তাদের এই সন্তানের দুটি হাত নেই, এজন্য কৃত্রিম হাত লাগিয়ে দিয়েছিলেন। যেন তিনি একটু স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারেন। প্রকৃতি কখনই অস্বাভাবিকতা মেনে নিতে পারে না। প্রকৃতি প্রাকৃতিক গুণাবলিতে সম্পন্ন, তাই তো জেসিকার অভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক গুণ এই কৃত্রিম হাতটিকে মেনে নিতে পারেনি, তখন তার বয়স মাত্র ১১ বছর। অতঃপর ১৪ বছর বয়সে কৃত্রিম হাত দুটো খুলে প্রথম ডানা মেলে উড়বার প্রয়াস শুরু করেন জেসিকা কক্স।

শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও জেসিকার বাবা ও মা তাকে সাধারণ বাচ্চাদের স্কুলে পাঠান এবং সাধারণ সবার মতোই জেসিকাও বেড়ে ওঠেন সবার মাঝে। স্কুলে পড়ার সময় অনেকেই জেসিকাকে সহানুভূতির চোখে দেখত, যা জেসিকাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিত, অনেকে তাকে ব্যঙ্গ করে হ্যান্ডলেস গার্ল বলেও খোটা দিত।

প্রকৃতি যেমন বসন্তে রাঙিয়ে দেয় পৃথিবী, আবার  বৈশাখের উন্মাদ ঝড়ে করে দেয় সব ল-ভ-, তেমনি জেসিকার সুলভ আচরণের ভিতরেও ছিল প্রচ- রাগ ও জেদ। প্রতিবাদী জেসিকা চিৎকার করে পা ছোড়াছুড়ি করতেন তাদের প্রতি, যারা তাকে কটু কথায় আহত করার চেষ্টা করত। এই রাগারাগির মাঝেও জেসিকার বাবা-মা একটি প্রতিভাবান নারীকে আবিষ্কার করেন এবং তার ভাই-বোনদের সঙ্গে ভর্তি করিয়ে দেন মার্শাল আর্ট স্কুলে। হাতবিহীন জেসিকা স্কুলে প্রতিটি খেলায় অংশ গ্রহণ করত, ট্যাপ ডান্স ও গার্লস স্কুলে সাঁতারও শিখত। সেই মেয়েটি যখন মার্শাল আর্টে ভর্তি হলো বলাই বাহুল্য ভিতরে পুষে থাকা ক্ষোভ বেরিয়ে আসে এক পারদর্শী মার্শাল আর্ট চ্যাম্পিয়ন হয়ে। তায়কোয়ান্দোতে ব্লাক বেল্ট অর্জন করে, গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম লেখান প্রথম হাতহীন ব্যক্তি হিসাবে। প্রতিভা এমন একটি বিষয় যা বিকাশিত হয় আলোর মতো, এক দিকে নয় সর্বত্র। এবং অতল সমুদ্রে স্কুবা ড্রাইভ করে মেপে নিত তার পানি চিরে আকাশে যাওয়ার দুর্বার যোগ্যতা।

জেসিকা কক্স একজন লাইসেন্স প্রাপ্ত গাড়ি চালক, যিনি দুইপা দিয়ে গাড়ি নির্বিকারে চালাতে পারেন তিনিই পারেন দুর্বল মানুষদের সাহস জুগিয়ে নতুন উজ্জ্বল দিকে দিকনির্দেশনা দিতে। ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করা জেসিকা আন্তর্জাতিক মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। বিভিন্ন দেশে দেশে বক্তৃতা দেওয়ার সময় পরিচয় হয় প্যাট্রিক ছেইম্বালেনের সঙ্গে যার সঙ্গে পরিনয় এবং ২০১২ সালে বিয়ে করেন, যেই বিয়েতে বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন কিছু মানুষ যাদের হাত নেই। ২০১৫ সাল, জেসিকার ডানা মেলার সময় হয়ে এসেছিল। আমেরিকার রোটারি ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে রবিন স্টোড্ডার্ডের একটি প্রশ্ন বদলে দেয় জেসিকার জীবন, প্রশ্নটি ছিল তুমি প্লেন চালাতে চাও? জেসিকার হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ানোর পেছনে যিনি নিঃস্বার্থক ভূমিকা পালন করেছেন তিনি জেসিকার বাবা, কারণ জেসিকা প্লেনে উঠতে ভয় পায় জেনেও তার বাবা যুদ্ধ পাইলট ও রাইট ফ্লাইট নামের টুসন বেসড সংগঠনের মালিক স্টোড্ডার্ডকে বলেছিলেন আমার মেয়ে প্লেন চালাতে খুবই আগ্রহী যিনি অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানের ওপর স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছেন তার মনের জোর কতটা দৃঢ় তার প্রমাণ জেসিকা দিয়েছিল প্লেন চালানোটাকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে। জেসিকা এমন কোনো প্রশিক্ষক পাননি যিনি তাকে ধৈর্য সহকারে সময় নিয়ে শিখাবেন, অবশেষে নিজ শ্রম ও ধৈর্য বলে তিনি শেষ করতে পেরেছিলেন। এই কঠিন অর্জন। তিন বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর মাত্র ৩৫ বছর বয়সে জেসিকা কক্স হয়ে যান একজন যুদ্ধ বিমান চালক আর আবারো ইতিহাস রচনা করেন এবং গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম লিখান প্রথম হাতহীন পাইলট হিসেবে।

সর্বশেষ খবর