শনিবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
দৃষ্টান্ত

বেদুইন থেকে ফ্রান্সের শীর্ষ ধনী

সুজন খান

বেদুইন থেকে ফ্রান্সের শীর্ষ ধনী

২০০ কোটি ডলার। কোনো দেশের বার্ষিক বাজেট নয়। মাত্র একজনের আয়ের পরিমাণ। একটি অথবা দুটি প্রতিষ্ঠানের আয় নয়; মোট ১৭০টি প্রতিষ্ঠানের আয় এই ২০০ কোটি ডলার। ১৭০টি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে সর্বমোট ১৭ হাজার মানুষ। এই ১৭ হাজার মানুষের পরিবারের ভরণ-পোষণ, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের যাবতীয় খরচ মেটানোর কাজে নিযুক্ত একটি বিশাল গ্রুপের নাম আলত্রাদ গ্রুপ। জানেন কি? এই বিশাল গ্রুপের মালিকের বাবা কে? তা তিনি নিজেই জানেন না। মোহেদ আলত্রাদ বাদাআই নিজের ভাষায় বলেছেন তিনি ধর্ষণের ফসল। সত্য অনেক সময় বিষের চেয়েও কর্কশ ও তিক্ত হয়। যে বিষ পানে একজন সাধারণ বেদুইন শিশু অসামান্য একজন মানুষ হয়ে উঠেছিল। সিরিয়ার উত্তপ্ত মরুতে এক বর্বর গোত্রপতি ধর্ষণ করে একজন নারীকে জনশূন্য স্থানে ফেলে রেখে চলে যায়। জন্ম দেওয়ার পর পৃথিবী থেকে চলে যান তার মা। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সবার চোখে ছেলেটি একটি জারজ সন্তান। তবুও সব কষ্ট ও অপমানের স্রোতে মোহেদ বড় হতে থাকে তার নানির কাছে। বেদুইন এতিম মোহেদকে তার নানি বলেছিলেন মেষ পালক হওয়ার কথা কারণ জন্মলগ্ন থেকে মোহেদের নানি অভাব-অনটনের মাঝে দিন পার করছিলেন। কিন্তু শিশুকাল থেকেই মোহেদের ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া করার। তাইতো তপ্ত মরুভূমিতে খালি পায়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে উপস্থিত হতেন শিক্ষালয়ে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার কোনো অর্থ ছিল না। তবুও পড়ালেখায় মুগ্ধ হয়ে দেয়ালের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করতেন। যদিও তেমন কিছুই বুঝতে পারতেন না। একদিন এভাবে মোহেদ সেই স্কুলের শিক্ষকের নজরে আসেন। শিক্ষক তাকে স্কুলে পড়াশোনার সুযোগ করে দেন। শুরু হয়ে যায় ভাগ্যের চাকা উন্নতির শিখরে চলা। বিধাতার অসীম কৃপায় শুষ্ক মরুতে রৌদ্রতাপে জন্মে খেজুর, আর সেই মরুতে পানি পান না করে উট চলতে পারে পাঁচ-ছয় মাস।

 

বিধাতা দিয়েছেলেন সেই বেদুইন ছেলেটিকে মেধা। সুযোগ পেয়ে মোহেদ ক্লাসে সবার চেয়ে ভালো করতে থাকে। বেদুইন ছেলেটির  উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে গভীর মরুতে গর্ত খুঁড়ে তাতে ফেলে এসেছিল তার সতীর্থরা মোহেদকে। সে যাত্রায় মোহেদ বেঁচে ফিরে এসেছিল। তার ভাগ্যও বদলে যায় যখন নিঃসন্তান দম্পতি আলত্রাদ মোহেদকে কাছে টেনে নিল সন্তান হিসেবে। সময় যেতে থাকে এভাবেই। এক সময় মোহেদ রাকায় থাকা এক আত্মীয়ের বাসায় যান আর সেখান থেকে তিনিই প্রথম সেই অঞ্চল থেকে অর্জন করেন বাকালুরিয়েট গ্রাজুয়েশন আর পেয়ে যান ফ্রান্সে পড়ার স্কলারশিপ।

 

১৭ বছর বয়সে আলত্রাদ মোহেদ চলে আসেন ফ্রান্সে আর পকেটে মাত্র ২০০ ফ্রাঁ। চোখে কিছু করবার স্বপ্ন আর বুকে পাহাড় পরিমাণ সাহস। ইউনিভার্সিটি অব মনটিপিলার-এ যখন ফ্রেন্স টিচাররা পড়াত তখন মোহেদ বলতে গেলে কিছুই বুঝতে পারত না, যা বুঝত তা হলো সংখ্যা। নিজের খরচ চালাবার জন্য তিনি গ্রীষ্মের ছুটিতে আঙ্গুরের বাগানে ১২ ফ্রঁাঁ প্রতিদিন হিসেবে মজুরি করতেন। মোহেদের ফ্রান্সের ভাষার ওপর দক্ষতা আসে যখন তার সাক্ষাৎ হয় একজন ফ্রেন্স নারীর সঙ্গে; যিনি একই ইউনিভার্সিটিতে একসঙ্গে পড়ছিলেন। পরে মোহেদ ওই নারীকেই বিয়ে করেন।

 

১৯৮০ সালে বেদুইন মোহেদ কম্পিউটার সায়েন্সের ওপর পিএইচডি লাভ করেন আর নিজ যোগ্যতায় পান ফ্রান্সের সিটিজেনশিপ। সেই বছরেই আবুধাবি ন্যাশনাল ওয়েল কোম্পানিতে আইটি ডিপার্টমেন্টে যোগ দেন। মোহেদের মতে, মিডল ইস্টে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছের কারণেই এ কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিলেন। তখন থেকেই শুরু করেছিলেন টাকা জমানো। পরে ফ্রান্সে ফিরে স্যুটকেসের মতো কম্পিউটার বানানোর একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরে এ প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে আয় করেন প্রচুর অর্থ। পার্টনারশিপ করে ফ্রান্সের একটি স্ক্যাফোল্ডিংয়ের একটি প্রতিষ্ঠান ক্রয় করেন যার ব্যবসা ছিল বাঁশ, কাঠ ও অস্থায়ী অবকাঠামো যেখানে বসে শ্রমিকরা কাজ করেন। কিছু দিন পরেই মোহেদ দেখলেন ব্যবসায় নতুন কিছু না করলে লোকসান হবে তাই শুরু করলেন ছোটখাটো ঠিকাদারি লোহা ও ইস্পাত ক্রয়-বিক্রয় ও ভাড়া দেওয়া, সিমেন্ট মিক্সার মিশ্রন যন্ত্র ইত্যাদি। ক্রমেই ব্যবসা প্রসারিত হতে লাগল আর বৃদ্ধি পেতে থাকল আয় এবং মুনাফা।

 

বুদ্ধি খাটিয়ে মোহেদ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ক্রয়-বিক্রয় করতে লাগলেন আর দেশে-বিদেশে নিজের ব্যবসাকে বিস্তৃত করতে লাগলেন। সেই একই ব্যবসা স্ক্যাফোল্ডিং, ভবন নির্মাণের কাজে যা যা প্রয়োজন সব তার কোম্পানিতে সংযোজন করতে থাকলেন। ৩০ বছর নিরলস পরিশ্রমে গড়ে তুললেন আলত্রাদ গ্রুপ। এ ছাড়া তিনি ফ্রান্সের একটি রাগবি ক্লাবের মালিক, তিনি একজন সার্থক লেখক এবং নিয়মিত লেখালেখি করেন আর প্রকাশিত করেছেন বেশ কয়েকটি উপন্যাস।

সর্বশেষ খবর