শনিবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
আবিষ্কার

বাঙালি গবেষকের আবিষ্কার অ্যান্টি-ডায়াবেটিস বিস্কুট

শনিবারের সকাল ডেস্ক

বাঙালি গবেষকের আবিষ্কার অ্যান্টি-ডায়াবেটিস বিস্কুট

গোটা বিশ্বে ডায়াবেটিস মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সারা বিশ্বে এটি একটি আতঙ্কের নাম। শুধু উন্নত বিশ্বেই নয়, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত বিশ্বেও ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। বিশ্বে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৪২ কোটি। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে ২০৩০ সালের মধ্যে রোগীর সংখ্যা ৫০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করলে রোগী নিজেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সব বয়সের মানুষই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতি বছরই দ্বিগুণ হারে বাড়ছে নতুন নতুন রোগীর সংখ্যা। সচেতনতার অভাবে অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটায় এমন প্রধান পাঁচটি রোগের মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। পৃথিবীতে প্রতি ১০ সেকেন্ডে একজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষ মারা যান এবং প্রতি ১০ সেকেন্ডে দুজন ডায়াবেটিস রোগী শনাক্ত করা হয়। বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস হরমোন সংশ্লিষ্ট রোগ। দেহযন্ত্র অগ্ন্যাশয় যদি যথেষ্ট ইনসুলিন তৈরি করতে না পারে অথবা শরীর যদি উৎপন্ন ইনসুলিন ব্যবহারে ব্যর্থ হয়, তাহলে এ রোগ হয়।

 

ইনসুলিন, জীবন ধারা পরিবর্তন, অ্যান্টি-ডায়াবেটিস ওষুধ, নিয়মিত ব্যায়াম, খাদ্য গ্রহণে সচেতনতা এবং অসুখ সম্বন্ধে রোগীর প্রয়োজনীয় ধারণা ডায়াবেটিস রোগীকে সুস্থ রাখে। এর মধ্যে খাদ্য গ্রহণে সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিস রোগী চাইলেই মিষ্টি ইচ্ছেমতো খেতে পারেন না। ইচ্ছা থাকলেও পছন্দের খাবার খাওয়া হয়ে ওঠে না। যে কারণে অনেকেই প্রবলভাবে অনুভব করেন অ্যান্টি-ডায়াবেটিস খাবার। এমনই এক অ্যান্টি-ডায়াবেটিস বিস্কুট উদ্ভাবন করেছেন দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. ইয়াছিন প্রধান।

 

ড. মো. ইয়াছিন প্রধান জানান, তিনি দিনাজপুর শহরের বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে প্রায়ই লক্ষ্য করতেন ডায়াবেটিস রোগীর জন্য আলাদা এক ধরনের মিষ্টি চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। বিষয়টি দেখে অবাক হন তিনি! মিষ্টিগুলো কী দিয়ে তৈরি, কীভাবে তৈরি হতে পারে তা নিয়ে ভাবতে থাকেন তিনি। মিষ্টিতে ব্যবহৃত দ্রব্য সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন সেখানে স্যাকারিন ব্যবহৃত হয়েছে; যা কৃত্রিমভাবে তৈরি। অথচ স্যাকারিন বা সোডিয়াম সাইকোমেট খেলে রক্তে চিনির পরিমাণ না বাড়লেও, দীর্ঘদিন খেলে ডায়াবেটিস বেড়ে যেতে পারে। তাই কৃত্রিম উপায়ে তৈরি স্যাকারিন মুখে মিষ্টির স্বাদ এনে দিলেও, তা আদৌ কতটা গ্রহণযোগ্য এটা প্রশ্নসাপেক্ষ। ডায়াবেটিস রোগীদের এর হাত থেকে রক্ষা করতে তিনি গবেষণায় মনোযোগী হলেন। এক সময় স্যাকারিনের বিকল্প হিসেবে পেয়েও গেলেন স্টেভিওল গ্লাইকোসাইড।

ড. মো. ইয়াছিন প্রধান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য থিসিস করার সময় স্টেভিওল গ্লাইকোসাইডের উৎস স্টেভিয়া গাছ সম্পর্কে অবহিত হন। গাছটির পাতা বিপরীত দিকে অবস্থিত, খাজকাটা, আঁশ আছে, গাঢ় সবুজ। গাছগুলো সুগন্ধ ছড়ায় না কিন্তু পাতা মিষ্টি। স্টেভিয়ার পাতা চিনি অপেক্ষা ৩০-৪০ গুণ এবং পাতার স্টেভিয়াসাইড চিনি অপেক্ষা ৩০০ গুণ বেশি মিষ্টি। তাই তিনি ভাবলেন, চিনির বিকল্প হিসেবে জিরো ক্যালরি স্টেভিয়ার পাতা ব্যবহার করা যায়। গবেষণার একপর্যায়ে তিনি দেখলেন কিছু নার্সারিতে স্টেভিয়া চাষ হচ্ছে এবং তারা চারা বিক্রির পাশাপাশি পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে উচ্চ দামে বাজারজাতও করছে। বিক্রিও হচ্ছে বেশ। ডায়াবেটিস রোগীরাই এর আসল ক্রেতা।

 

খোঁজ-খবর নিয়ে জানার পর শুরু হয় ড. মো. ইয়াছিন প্রধানের নতুন যাত্রা। গাছের মিষ্টি কম্পাউন্ড বাড়ানো কমানো কিংবা অন্য কিছু যোগ করার মাধ্যমে ত্বরান্বিত করা যায় কি নাÑ শুরু হয় নতুন গবেষণা। কিন্তু ততদিনে তিনি হয়ে গেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষক হওয়ার পরও থেমে যাননি। হাই পারফরম্যান্স লিকুইড ক্রোমোটোগ্রাফি করার মাধ্যমে পাতার মধ্যে কী পরিমাণ গ্লাইকোসাইড আছে তা নির্ণয় করেন। তার পরই পিএইচডি ডিগ্রির জন্য জাপানে পাড়ি জমান। ডিগ্রি শেষে দেশে শিক্ষকতার জন্য ফিরে এলে স্টেভিয়া গাছ থেকে স্টেভিওল গ্লাইকোসাইড বা স্টেভিয়া গাছ থেকে উৎপন্ন চিনি খাদ্যদ্রব্যে মিশিয়ে অ্যান্টি-ডায়াবেটিস খাদ্য উৎপাদন করার পরিকল্পনা করেন।

প্রাথমিকভাবে অর্থায়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন তিনি। সেই অর্থায়নে শুরু হয় গবেষণা। অ্যান্টি-ডায়াবেটিস বিস্কুটের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে ড. মো. ইয়াছিন বলেন, ‘আমরা যেহেতু সলিড স্টেভিরল গ্লাইকোসাইড অর্থাৎ চিনি দেশের বাইরে থেকে আমদানি করছি সেহেতু খরচ অনেক বেশি পড়ে। যার কারণে বাণিজ্যিকভাবে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। স্টেভিরল গ্লাইকোসাইড পানিতে দ্রবণীয় হওয়ায় লিকুইড সুগার সল্যুশন তৈরির মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারলে সস্তায় অ্যান্টি-ডায়াবেটিস খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা যাবে। সেটা নিয়েও কাজ করছি। আশার কথা আমি ইতিমধ্যেই প্লান্ট থেকে সুগার তৈরি করেছি। যদিও বিষয়টি নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। এটি এখন পর্যন্ত কোথাও ব্যবহার করা হয়নি। একে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে সহজ কোনো পদ্ধতিতে উৎপাদন করে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাতকরণের পরিকল্পনা রয়েছে।’

সর্বশেষ খবর