শনিবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
অনন্য

হুইল চেয়ারে রূপকথার পরী মুনিবা মাজারির গল্প

সুজন খান

হুইল চেয়ারে রূপকথার পরী মুনিবা মাজারির গল্প

মুনিবা একজন পাকিস্তানি মানবাধিকার কর্মী, চিত্রশিল্পী, টেলিভিশন উপস্থাপক, মোটিভেশনাল স্পিকার এবং গায়িকা। ২০০৭ সালে গাড়ি এক্সিডেন্ট হয় তার। এর পর থেকে তিনি হুইল চেয়ার ব্যবহার করেন। নিজের সৃষ্টিশীলতা ও অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি তাকে পরিচিত করেছে

পাকিস্তানের লৌহমানবী হিসেবে। তিনি এখন পাকিস্তানের ইউএন ওম্যানের শুভেচ্ছাদূত। দুর্ঘটনার দিন বেলুচিস্তান থেকে গাড়িতে করে যাচ্ছিলেন তার বাবার বাসায় স্বামী খুররাম শাহজাদের সঙ্গে। গাড়ি চালাবার সময় শাহাজাদের ঘুম চলে আসে আর দুর্ভাগ্যজনক ভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি পড়ে যায় একটি খাদে। শাহাজাদ কোনোভাবে বেরিয়ে এলেও ঐ গাড়িতে আটকা পড়ে যান মুনিবা মাজারি। দুর্ঘটনায় মুনিবার কাঁধের হাড়, কলারবোন, পাঁজরের বলতে গেলে প্রতিটি হাড় ও মেরুদন্ডের তিনটি হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। বিরান এলাকায় প্রায় দুই ঘণ্টা এভাবেই পড়ে ছিলেন মুনিবা অবশেষে একটি পিকাপের পেছনে শুইয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কাছের হাসপাতালে। ওখানে রোগীর মারাত্মক অবস্থা দেখে তারা নিতে চাননি পরে বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় হাসপাতালে নিলে তারাও মানা করে দেয়। অতঃপর করাচির একটি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা শুরু করে। এই দুর্বিষহ যাত্রার টানাটানিতে মুনিবার স্পাইনাল কর্ডের সংযোগ তার শরীরের নিচের অংশ হতে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই হাসপাতালেই মুনিবার প্রায় তিন মাস কাটাতে হয়। তার মতে এই সময়টিই ছিল তার জীবনে কাটানো সবচেয়ে কষ্টের, দুঃখের ও বিভীষিকাময়ের। পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ কহিনুর হীরা নয়, সে মূল্যবান সম্পদ হলো মা। মায়ের সন্তানের জন্য প্রার্থনা যে সরাসরি বিধাতার কাছে একটি সফল বার্তা তার প্রমাণ এর পরের ঘটনাগুলোই।

চিকিৎসাধীন থাকাকালীন সময়ে প্রথমদিন ডাক্তার মুনিবাকে জানান, শুনেছি আপনি চিত্র শিল্পী হতে চান কিন্তু দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আপনার হাত এতটাই আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে যে আপনি আর কখনোই কলম ধরতে পারবেন না। এই  কথাটি মুনিবাকে পাথরের মতো নিশ্চুপ করে দিয়েছিল। এই নিষ্ঠুর সত্যকে বরণ করবার কোনো সুযোগ ও সময় না দিয়েই ডাক্তার ২য় দিন শোনালেন স্পাইনাল কর্ডটি ছিঁড়ে যাওয়ায় এবং অনেক গুরুতর আঘাত পাওয়ার কারণে তিনি আর কোনোদিনও নিজপায়ে দাঁড়াতেও পারবেন না। স্তব্ধ ও অবাক মুনিবা কিছু ভাববার আগেই ৩য় দিন ডাক্তার এমন একটি দুঃসংবাদ দিলেন যা শোনার পর মুনিবা মাতৃত্বের গৌরব হতে একবারে ছিটকে অথৈ গভীরে পড়ে গেলেন, অপ্রস্তুত হয়ে শুনলেন তার মেরুদ- ভেঙে যাওয়ার কারণে তিনি কোনোদিন গর্ভধারণ করতে পারবেন না। জীর্ণ হয়ে যাওয়া শীর্ণ শরীরে ও মনে যতটুকু শক্তি ছিল তা হারিয়ে ফেলেন আর তার মাকে বলেন ‘আমিই কেন মা’ ‘কেন আমার সাথেই এমন হয়’? মুনিবার মা তাকে আগলে ধরে বলেন ‘এই খারাপ সময় চলে যাবে মা, বিধাতা তোমার জন্য নিশ্চই বড় কিছু ভেবে রেখেছেন। আমি জানি সেটা কী, কিন্তু অবশ্যই রেখেছেন যা সময় মতো তুমি পাবে, ধৈর্য ধর মা’। বিধাতা দিয়েছিলেন মুনিবাকে এক জাদুকরী শক্তি ও উদ্যাম। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি ভাবলেন আমার বাবা একজন শিল্পী আর আমি তো ফাইন আর্টসে ব্যাচেলর করেছি চেষ্টা আমি করবই। তার ছোট ভাইকে দিয়ে কিছু ক্যানভাস ও রং তুলি আনিয়ে হাসাপাতালেই ভাঙা হাত দিয়ে আঁকা শুরু করলেন ছবি। অভুতভাবে এঁকে ফেললেন চমৎকার কিছু চিত্র যা তার কষ্ট ও অশ্রু মিশ্রিত। দীর্ঘদিন বিছানায় থাকলে যা হয় বেডশোর বা শয্যাক্ষত আরও অনেক সংক্রামক রোগ। এ জন্য ডাক্তার তাকে দুই বছর সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে বলেন। এই দীর্ঘ দুই বছরে মুনিবার জীবনের প্রতি, বেঁচে থাকার প্রতি, সুস্থতার প্রতি ও অসহায়ত্বের প্রতি এক অন্যরকম অনুক্ত অধিবিদ্যতার প্রকাশ ঘটে। ঠিক যেমন রেশমের গুটি বের হয়ে আসা প্রজাপতি। মুনিবা জানতেন ভয় কাটালেই দিনের আলোয় আসবে জয়। তাই করুণার ও অবহেলার পাত্রী না থাকবার জন্য নিজ থেকেই বিবাহ বিচ্ছেদের পত্র প্রেরণ করেন তার স্বামীকে। তাকে মুক্তিদান করে নিজের ভয়কে জয় করলেন এভাবেই। দত্তক নিলেন মাত্র দুই দিনের এক পুত্র সন্তানকে আর শিশুটিকে কোলে নেওয়ার পর মা না হতে পারা ও মা হওয়ার এক মিশ্রিত অনুভূতি কাঁদিয়ে ছিল মুনিবাকে। বিশ্বাসী মনে মুনিবা তার চিত্রকর্মের প্রদর্শনী শুরু করেন এর পাশাপাশি অনলাইন পোর্টালে কনট্যান্ট লেখক হিসেবে কাজ শুরু করায় অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে থাকেন। যেই ঘটনাটি বদলে দিয়েছিল মুনিবার চলার পথ যখন তিনি দেখলেন একটি বাবা হুইল চেয়ারে তার পোলিও আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে শোকে বিলাপ করছেন এবং সবাইকে শতর্ক করছেন। সে দিনের সিদ্ধান্ত ছিল, সবার মাঝে গিয়ে জনসচেতনতা বাড়াবেন এবং বিকলাঙ্গ মানুষের প্রতি সমাজের ধারণা পরিবর্তন করবেন আর এ জন্য দরকার বেশি বেশি করে মানুষের মাঝে আশার।

শুরু করেন মডেলিং, ‘পন্ডস’ ‘টনি অ্যান্ড গাই’সহ আরও অনেক কোম্পানির অ্যাম্বাসেডর হিসেবে যোগ দেন  একই সঙ্গে হুইল চেয়ারে বসা চিত্রশিল্পী হিসেবে চরম খ্যাতি অর্জন করতে থাকেন। আকাশের তারা মাটিতেও উজ্জ্বল, হুইল চেয়ারে বসা প্রথম তিনিই টিভিতে উপস্থাপনা করেন। এখনো বেশ অনেক শোর বিখ্যাত উপস্থাপিকা তিনি। জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন, চাইল্ড রাইটস ও অন্যান্য সামাজিক কর্মকান্ডে মোটিভেশনাল পারসন হিসেবেও কাজ করেছেন এবং বর্তমানেও করছেন। তার দূরদর্শিতা ও দুর্বার মনোভাবের জন্য ‘ইউ এন উইমেন পাকিস্তান’ ও ‘ন্যাশনাল গুডউইল’ অ্যাম্বাসেডর হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ২০১৫ ও ২০১৬ তে জায়গা করে নেন যথাক্রমে ‘বিবিসি ইন্সপিরেশনাল উইমেন’ এবং ‘ফোর্বস থার্টি আন্ডার থার্টিতে’ এ ছাড়াও ‘মিরাকেল উইমেন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন পন্ডস মিরাকেল উইমেনে। প্রযুক্তি যেমন আতঙ্কিত করে নিউক্লিয়ার ওয়েপন আবিষ্কারে তেমন জাগায় আশার আলোও বদলে দেয় সব সাধারণ ধারণা। ১৯ মে ২০১৮ সালে রোবোটিক্স সাপোর্ট সিস্টেমের মাধ্যমে দশ বছর পর প্রথম নিজ পায়ে দাঁড়ান মুনিবা মাজারি। শুরুতেই বলেছি এ গল্পে রয়েছে কান্নার পর উচ্ছ্বাস, উল্লাস ও অগ্রগতি, সব কর্মকান্ড পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছেন এর সঙ্গে আবার গানটাও নতুন করে যোগ হয়েছে।  নিজের নামের একটি ব্র্যান্ড আছে যার নাম

‘মুনিবাস ক্যানভাস’ যেখানে রয়েছে মুনিবার চমৎকার সব শিল্পকর্ম আর এই ব্র্যান্ডের স্লোগান ‘নিজের দেয়ালকে রাঙ্গিয়ে দাও’। প্রতিটি রূপকথার গল্পের পর বলে, অতঃপর তারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল। মুনিবা মাজারি তার সন্তান ও পরিবারের সঙ্গে সুখে শান্তিতে বসবাস করছেন যদিও এটি কোন রুপকথার গল্প নয়।

সর্বশেষ খবর