শনিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

আমেরিকা জয়ী বাংলাদেশি

সাইফ ইমন

আমেরিকা জয়ী বাংলাদেশি

মার্কিন নির্বাচনে দুই গুরুত্বপূর্ণ পদে জয় পেয়েছেন দুই আমেরিকান-বাংলাদেশি। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জের শেখ রহমান ডেমোক্র্যাট দলের হয়ে জর্জিয়ার স্টেট সিনেটর হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন। শেখ রহমানের নির্বাচনী এলাকার ভোটারের সংখ্যা ১৪ হাজার ৯০৪ জন। এর মধ্যে শ-খানেক বাংলাদেশি আমেরিকান। বাকিরা সবাই ভিন্ন ভাষা, বর্ণ আর ধর্মের। আর নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্য থেকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশি বংশো™ভূত আবুল বি. খান। এ নিয়ে টানা চারবার নির্বাচিত হলেন এই রিপাবলিকান নেতা। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার আবুল খান। তিনি সেখানে নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা, জননিরাপত্তা ও পরিবেশ উন্নয়নে একজন বাংলাদেশি হিসেবে বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন। পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলা শহরের ঐতিহ্যবাহী খান লজ বাড়ির প্রয়াত মাহাবুব উদ্দিন খান কাঞ্চন ও প্রয়াত শাহানারা বেগমের বড় ছেলে আবুল বাশার খান।

প্রয়াত বাবা মাহাবুব উদ্দিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী সচিব ছিলেন। ১৯৬০ সালের ১ মার্চ তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তারা দুই ভাই, দুই বোন। পরিবারের সবাই আমেরিকা প্রবাসী। তবে ছোট বোন রোজী খান অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। ভাই ও বোনদের মধ্যে তিনি সবার বড়। আবুল খান ১৯৮১ সালের ১০ জানুয়ারি আমেরিকায় যান। এর আগে ঢাকার মুসলিম গভ. হাইস্কুল থেকে ১৯৭৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৭৮ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হয়ে তিন বছর পড়ার পর স্টুডেন্ট ভিসায় আমেরিকা গিয়ে আর ফেরেননি। আমেরিকা বসবাসরত অবস্থায় ১৯৮৪ সালে নিজ জেলা পিরোজপুরের মরজিয়া হুদা খানকে বিয়ে করেন। এ দম্পতির ঘরে ছেলে আতিক খান ও মেয়ে নুসরাত জাহানও আমেরিকা প্রবাসী। আবুল খান আমেরিকা যাওয়ার পর নিউইয়র্ক শহরে প্রথমে ব্যবসা শুরু করেন। ২০০০ সালে তিনি নিউ হ্যাম্পশায়ার সিটিতে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্রয় করেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ছাড়া সেখানে একটি গ্যাস স্টেশনও ছিল। ২০০৬ সালে তিনি সি ব্রকে প্ল্যানিং বোর্ডের সদস্য হিসেবে প্রথম নির্বাচনে দাঁড়ান। চার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে হারিয়ে সেই তার প্রথম নির্বাচনে জেতা। এরপর ২০০৬ সালে ওই শহরের বাজেট কমিটির সদস্য পদে নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে সি ব্রক বোর্ড অব সিলেক্টম্যান পদে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে তৃতীয় দফায় নির্বাচন করে বিজয়ী হন। ২০১১ সালে সি ব্রকে তিন বছর মেয়াদে ওই পদে পুনরায় তিনি নির্বাচিত হয়ে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টসহ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মাণে ভূমিকা রাখেন। ২০১২ সালের ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিউ হ্যাম্পশায়ারে হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন।

এদিকে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের স্টেট সিনেটর পদে নির্বাচিত হওয়া বাংলাদেশি বংশো™ভূত শেখ রহমান চন্দনের বিরুদ্ধে কেউ মাঠে নামেননি। এমনকি রিপাবলিকান পার্টি থেকেও কেউ প্রার্থী হননি এ আসনে। ১৯৮১ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসেন চন্দন। বাংলাদেশে তার ছোট ভাই শেখ মুজিবর রহমান ইকবাল একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য হয়েছিলেন কিশোরগঞ্জ থেকে। শৈশব এবং কৈশোর বাংলাদেশেই কাটিয়েছেন শেখ রহমান। গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলায়। মুক্তিযোদ্ধা ও সরকারি কর্মকর্তা বাবার সন্তান শেখ রহমান বাংলাদেশে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্নের পর পাড়ি জমান আমেরিকায়। তিনি বিশ্বাস করতেন পরিশ্রম ও অধ্যবসায় যখন এক বিন্দুতে মেলানো যায় তখন সাফল্য ধরা দেবেই। আমেরিকায় এসে ভর্তি হন সেন্ট্রাল পিডমন্ট কমিউনিটি কলেজে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অদম্য ইচ্ছা থেকেই বাবার কাছ থেকে কোনো খরচ নিতেন না তিনি। একের পর এক রেস্টুরেন্টে কাজ খুঁজতে খুঁজতে সঙ্গের অনেকেই যখন হাল ছেড়ে দিচ্ছিল তিনি তখন আরও নতুন উদ্যমে পথচলা শুরু করলেন।

৫০টিরও বেশি রেস্টুরেন্ট থেকে ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি নর্থ ক্যারোলিনা রেস্টুরেন্টে ডিশওয়াশারের কাজ পেয়েছিলেন। চালিয়েছেন ট্যাক্সিক্যাবও। জীবনযুদ্ধে হার না মানা এ অদম্য সৈনিকই এখন আমেরিকার জর্জিয়া স্টেটের সিনেটর বাংলাদেশি-আমেরিকান শেখ রহমান হিসেবে গোটা বিশ্বে পরিচিত। ইউনিভার্সিটি অব জর্জিয়া থেকে অনার্স করার পর জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকোনমিকস অ্যান্ড গ্লোবাল স্টাডিজে পড়াশোনা করেন। মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলা- এ বোধ বাংলাদেশে থাকাবস্থাতেই তৈরি হয়েছিল শেখ রহমানের। তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছেন। মওলানা ভাসানীর ভাষণও শুনেছিলেন অনেকবার। তিনি কৈশোরেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। যা পরবর্তী জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। সেই থেকেই মানুষের অধিকার আদায়ে এগিয়ে আসার একটা প্রত্যয় তৈরি হয়েছিল ভিতরে। ব্যক্তি জীবনে এক ছেলে এবং এক মেয়ের বাবা তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি এখন থেকেই আমার ছেলেকে  তৈরি করতে শুরু করেছি। যেন সে ভবিষ্যতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারে। সেভাবেই আমি আমার ছেলেকে বড় করছি।’

দেশের বাইরে বাংলাদেশিদের এমন নানা সাফল্য গোটা বিশ্বের সব বাংলাদেশিকেই গর্বিত করে। জর্জিয়ার সিনেটর শেখ রহমানের ছেলে যদি এক দিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারে তাও হবে বাংলাদেশিদের জন্য অনেক বড় গর্বের।

 

আরও অংশ নিলেন যারা...

মার্কিন নির্বাচনে আরও তিনজন বাংলাদেশি বংশো™ভূত রাজনীতিবিদ অংশ নিয়েছেন। টেক্সাসের অস্টিন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে একমাত্র বাংলাদেশি প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী ছিলেন ডোনা ইমাম,  পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের অডিটর জেনারেল পদপ্রার্থী ড. নীনা আহমেদ, মিশিগান স্টেট থেকে  হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী ড. এমডি রাব্বি আলম। ড. এমডি রাব্বি আলম যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সাবেক সার্জেন্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির ককাসের সাবেক সভাপতি এবং মিসোরি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এশিয়ান ককাসের প্রতিষ্ঠাতা। এমডি রাব্বি আলম ২০০৮ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার স্যাটেলাইট ক্যাম্পেইন ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্সের ক্যাম্পেইনের ‘মুসলিম আমেরিকান ফর বার্নি স্যান্ডার্স’ উইং এর চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেছেন। আর ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী ডোনা ইমাম হেরেছেন বর্ষীয়ান রিপাবলিকান রাজনীতিবিদ জন কার্টারের কাছে। কার্টার ২ লাখের বেশি ভোট পেয়েছেন। সেখানে ডোনা পেয়েছেন প্রায় পৌনে দুই লাখ। মার্কিন রাজনীতিতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপদেষ্টা বাংলাদেশি বংশো™ভূত ড. নীনা আহমেদ একটি উজ্জ্বল নাম। দায়িত্ব পালন করেছেন ফিলাডেলফিয়ার নির্বাচিত ডেপুটি মেয়র হিসেবে। সদ্য শেষ হওয়া নির্বাচনে তিনি পেনসিলভেনিয়ার অডিটর জেনারেল পদে পরাজিত হয়েছেন। কিন্তু ডেমোক্র্যাট অধ্যুষিত পেনসিলভেনিয়া স্টেটে নীনা আহমেদের জয়ের প্রবল সম্ভাবনা ছিল। পেনসিলভেনিয়ার ২৩৩ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একজন অশ্বেতাঙ্গ মুসলিম নারী এবং বাদামি রঙের বাংলাদেশি-মার্কিনির বিপুল ভোটে প্রাইমারিতে জয়লাভ করেছিলেন। নীনা আহমেদ ২১ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়া থেকে পিএইচডি করেন রসায়নে এবং মেডিকেল ফেলোশিপ করেছেন থমাস জেফারসন ইউনিভার্সিটি থেকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর