শনিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা
সবুজ বিদ্যাবাড়ি

চকলেট আপার অন্যরকম স্কুল

শাহ্ দিদার আলম নবেল

চকলেট আপার অন্যরকম স্কুল

সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলা সদরের পাশেই কদমতলা এলাকা। প্রধান সড়ক থেকে মাত্র কয়েকশ গজ দূরেই এই কদমতলা বেদেপল্লী। বেদেপল্লীতে পা রাখতেই ভেসে আসে শিশুদের কণ্ঠে গুনের নামতার সুর। একটি ঘরের ভিতর চিৎকার করে শিশুরা গুনছে নামতা। বেদেপল্লীর বিকালের নীরবতা ভাঙছে শিশুদের পড়ার শব্দে। কাগজে-কলমে বেদেপল্লীর ছোট্ট এই ঘরটির নাম ‘সবুজ বিদ্যাবাড়ি’। আর পড়তে আসা শিশুরা জানে এটি ‘চকলেট আপার স্কুল’। এক বছর থেকে এই বিদ্যাবাড়িই শিক্ষার আলো জ¦ালানোর চেষ্টা চালাচ্ছে বেদেপল্লীর অন্ধকারে। মিজারেবল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন নামক একটি সামাজিক সংগঠন পরিচালনা করছে এই স্কুলটি। সংগঠনের সভাপতি তাসমিনা বেগম সোমার হাত ধরেই স্কুলটির যাত্রা শুরু। বেদেপল্লীর শিশুদের চকলেট খাইয়ে আপন করে নেওয়া সোমার পরিচয় এখন সেখানে ‘চকলেট আপা’। ‘চকলেট আপা’ স্বপ্ন দেখেন শিক্ষার আলোবঞ্চিত বেদে সম্প্রদায়ের শিশুদের নিয়ে। সেই স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করতে চান তার ‘সবুজ বিদ্যাবাড়ি’ দিয়ে। সম্প্রতি কদমতলা বেদেপল্লীতে গিয়ে দেখা হয় বিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা তাসমিনা বেগম সোমার সঙ্গে। সিলেট নার্সিং কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী তিনি। শিশুদের টানে তিনি শহর থেকে ছুটে যান সেখানে। স্কুলে বসেই জানালেন তার ‘সবুজ বিদ্যাবাড়ি’ প্রতিষ্ঠার পেছনের গল্প।  শোনালেন ছোট্ট ঘরের বড় স্বপ্নের কথা। স্কুলের জন্য বেদেপল্লী বেছে নেওয়ার কারণ প্রসঙ্গে সোমা জানান, বেদে সম্প্রদায়ের উদ্বাস্তু যাযাবর জীবন নিয়ে তার কৌতূহল অনেক দিনের। কিন্তু তাদের সঙ্গে মেশার সুযোগ পাননি কোনোদিন। শোনাও হয়নি তাদের জীবনযাত্রার গল্প। ২০১৮ সালের এপ্রিল বা মে মাসের দিকে সিলেট জেলা জজকোর্টের সামনে ফুটপাথ ধরে হাঁটছিলেন তিনি। হঠাৎ এক বেদে মহিলা তাকে আটকান। দেখতে চান হাত। প্রথমে ইতস্তত করেন। রাজি হননি হাত দেখাতে। শেষ পর্যন্ত মহিলার পীড়াপীড়িতে বাড়িয়ে দেন হাত। তবে হাত দেখিয়ে ভূত-ভবিষ্যৎ জানার কোনো আগ্রহ ছিল না তার। হাত দেখানোর অজুহাতে চেয়েছিলেন ওই মহিলার সঙ্গে খাতির জমাতে। তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানতে। কিন্তু তার কথায় মন ভরেনি মহিলার। বেদেদের জীবন নিয়ে খুব একটা কথা বলতে রাজি হননি তিনি। তবে দমে যাওয়ার পাত্রী নন সোমা। আগ্রহ বেড়ে যায় আরও কয়েক গুণ। বাসায় এসে ইউটিউবে দেখেন বেদের জীবন-যাপনের বৈচিত্র্যতা। পরে ছুটে যান গোলাপগঞ্জ, ছাতক ও ফেঞ্চুগঞ্জের বেদেপল্লীতে। বেদেদের জীবনমান আর বঞ্চনার চিত্র ব্যথিত করে তাকে। বিশেষ করে যুগের পর যুগ বেদে শিশুদের শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থাকার বিষয়টি মনে দাগ কাটে তার। সিদ্ধান্ত নেন বেদে শিশুদের শিক্ষার জন্য কিছু একটা করবেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন তার সংগঠন ‘মিজারেবল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর বন্ধুদের সঙ্গে। সবাই সায় দেন। একমত হন বেদেপল্লীতে একটি স্কুলের যাত্রা শুরু করার। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন যে খুব সহজ নয়, তা সোমা বুঝতে পারেন শিক্ষার বার্তা নিয়ে বেদেপল্লীতে যাওয়ার পর। শিক্ষা নিয়ে বেদেপল্লীর কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। বরং বাচ্চারা বড় হয়ে কীভাবে পূর্বসূরিদের পেশায় যোগ দেবে সেটা নিয়েই তাদের চিন্তা বেশি। সোমাও হাল ছাড়েন না। প্রায় চার মাস তিনি কদমতলা বেদেপল্লীতে ঘুরেন। বেদে সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। উদ্বুদ্ধ করেন বাচ্চাদের পড়ালেখা করাতে। স্কুলে যাওয়ার সময় তিনি শিশুদের জন্য নিয়ে যেতেন চকলেট। তাকে দেখলেই বাচ্চারা দৌড়ে এসে ঘিরে ধরত চকলেটের জন্য। এক সময় সোমা হয়ে ওঠেন বেদেপল্লীর ‘চকলেট আপা’। কিছু লোককে বোঝাতেও সক্ষম হন তিনি। অবশেষে ২০১৮ সালের ৬ আগস্ট তার সংগঠনের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বেদেপল্লীর শিশুদের নিয়ে শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। এই কার্যক্রমের নাম দেন তিনি ‘সবুজ বিদ্যাবাড়ি’। শুরুতে বেদে বস্তির উঠানে খোলা আকাশের নিচে চলত পাঠদান কার্যক্রম। গত কয়েক মাস ধরে বস্তির এক টুকরো জায়গা ভাড়া নিয়ে সেখানে অস্থায়ী একটি ঘর তুলে চলছে ‘সবুজ বিদ্যাবাড়ি’র কাজ। ‘মিজারেবল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ পরিচালিত সোমার বিদ্যাবাড়িতে এখন শিক্ষার্থী সংখ্যা ২৮। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহে ছয় দিন বিকাল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত চলে স্কুলের কার্যক্রম। বয়স ও মেধা বিবেচনায় প্রাক প্রাথমিক, প্রথম ও দ্বিতীয় এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করে পাঠদান দেওয়া হচ্ছে তাদের। পাঠদানের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দুজন শিক্ষিকা। সংগঠনের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার উপকরণও দেওয়া হয় সম্পূর্ণ ফ্রিতে।

সর্বশেষ খবর