শনিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

বসতভিটা বিক্রি করে একাত্তর ভাস্কর্য নির্মাণ

সঞ্জয় দাস লিটু, পটুয়াখালী

বসতভিটা বিক্রি করে একাত্তর ভাস্কর্য নির্মাণ

সাহেব আলী পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য বানাতে গিয়ে প্রথম স্ত্রীর সংসার ভেঙে গেলেও ছাড়েনি ভাস্কর্য নির্মাণ কাজ। নতুন প্রজন্মকে ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার ইতিহাসের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে একে একে ৬৬টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য বানিয়েছেন তিনি। কোনো অনুদান নয়, নিজের বসতভিটে বিক্রি করে নিরক্ষর এ মানুষটি মহৎকর্ম করে চলছেন। বাকি পাঁচটি ভাস্কর্য নির্মাণাধীন, প্রয়োজন অর্থ। সাহেব আলীর এই হস্তশিল্প দেখতে অগণিত মানুষের ভিড় জমে তার গ্রামের বাড়িতে। পটুয়াখালী সদরের আউলিয়াপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বড় আউলিয়াপুর নামের অজপাড়াগাঁয়ের মৃত আবদুল আজিজ মিয়ার ছেলে সাহেব আলী। দ্বিতীয় স্ত্রী পিয়ারা বেগম ও ছেলে হাসান-হোসেন, মেয়ে নীলিমা ও নিলুফাকে নিয়ে তার সংসার। ৫৭ বছরের কোটায় সাহেব আলীর এক ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবন্ধী। ১৯৯৬ সালে মুন্সীগঞ্জের একটি চালের মিলে কর্মরত অবস্থায় সহকর্মী (বীরাঙ্গনা) রাহিমা বেগমের কাছে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদারদের হাতে হত্যা, মা-বোনদের নির্মম নির্যাতনসহ অমানবিক কর্মকান্ডের করুণ কাহিনি শুনে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রতিজ্ঞা করেন তিনি। সমাজ-সভ্যতা বিবর্জিত কাহিনি শুনে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য বানাতে উদ্বুদ্ধ হন তিনি। নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার ইতিহাস, ঐতিহ্য তুলে ধরতে এক নীরব সংগ্রামে নামেন সাহেব আলী। কিন্তু তার এই ভিন্ন শিল্পায়নের রূপ দিতে বসতভিটা বিক্রি ছাড়াও প্রথম স্ত্রী ছকিনা বেগমও তাকে ছেড়ে চলে যান। তবুও ভাস্কর্য নির্মাণ ত্যাগ করেননি সাহেব আলী। কখনো অর্ধাহারে, কখনো অনাহারে দিন পার করে ভাস্কর্য বানানোর কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। বর্তমানে পুরনো টিন দিয়ে শেড বানিয়ে পরিবারের সদস্যরা বসবাস করছেন। বর্ষা মৌসুমে নির্ঘুম রাতে ঘরের মেঝের পানি সেচ করতে করতে সকাল হয়ে যায়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় চরম শঙ্কায় থাকতে হয় পরিবার নিয়ে। সরকারি অথবা কোনো দাতাসংস্থা শিল্পকর্মকে সহায়তা দিলে নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার অজানা ইতিহাস-ঐতিহ্য ভালোভাবে তুলে ধরতে পারবেন বলে আশা করেন তিনি। সাহেব আলী বলেন, প্রথমে ভাস্কর্য বানানোর কাজ শুরু করলে সংসারের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম স্ত্রী ছকিনা বেগম আমাকে পাগল বলে ত্যাগ করে বেড়ানোর কথা বলে বাপের বাড়ি চলে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। সবার সহযোগিতা পেলে আমি নতুন প্রজন্মের জন্য অনেক কিছুই তুলে ধরতে চাই। সরেজমিন দেখা যায়, বাড়ির অভিমুখে কংক্রিট দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দেশের বিখ্যাত ব্যক্তি, স্বাধীনতার চিত্রপট এবং একাত্তরের অবিস্মরণীয় তাৎপর্য নিয়ে ২০টি প্ল্যাকার্ড। এ ছাড়াও প্রদর্শন করা হয়েছে নাগরিক সচেতনতামূলক কিছু বাক্য। পৈতৃক ৩০ শতক জমির ১৭ শতক ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দীর্ঘ এক বছর ধরে ৬৬টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য নির্মাণ করতে গিয়ে এনজিও থেকেও ঋণ নিতে হয়েছে তাকে। পুরনো টিন শেডে তৈরি ঘরটুকু ছাড়া বাকি জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে জাতির জনকের বজ্রমুষ্টি, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ আঙুলে প্রদর্শন করা হয়েছে গোটা বাংলাদেশ, বীরযোদ্ধার পদদলিত (পাকবাহিনী) কালনাগ, ১৫ আগস্টের ভয়াবহ বুলেট, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বর, ৭ মার্চ, ২৬ মার্চ, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনসহ মোট ৬৬টি ভাস্কর্য। নিরক্ষর এই মানুষের হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় যেন ফুটে উঠেছে গোটা বাঙালি জাতির সংস্কৃতি, কৃতিত্ব এবং স্বাধীনতার সেই রক্তস্নাত স্মৃতি। বালু আর সিমেন্ট মিশ্রণে তাক লাগিয়ে দিয়েছে গোটা এলাকায়। শুধু গ্রাম নয়, শহর থেকে অনেকেই দেখতে যান সাহেব আলীর নিজ হাতে গড়া মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই ভাস্কর্যগুলো।

সর্বশেষ খবর