শনিবার, ১৩ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা
দিলরুবা আক্তার মিলি

দেশের প্রথম নারী বনরক্ষীর গল্প

বিশ্বজুড়ে সাফল্যের অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলেছে নারীরা। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। নারীর ক্ষমতায়নে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই সাফল্যের ছাপ রাখছে বাংলাদেশ। এমন কিছু পেশা ও কাজ রয়েছে যেগুলোতে সচরাচর নারীদের খুব একটা দেখা যায় না। এমন পেশায়ও নারীরা রাখছেন পদচিহ্ন। এমনই একটি পদ ‘বনরক্ষী’। বনরক্ষী পেশায় এর আগে কখনই কোনো নারীকে দেখা যায়নি। কিন্তু এ পদে প্রথম নারী হিসেবে ইতিহাস গড়েছেন দিলরুবা আক্তার মিলি। তার সেই সাফল্যের গল্প নিয়েই এবারের মূল রচনা।

শনিবারের সকাল ডেস্ক

দেশের প্রথম নারী বনরক্ষীর গল্প

প্রশিক্ষণকালে সহক্যাডেটদের সঙ্গে দিলরুবা হক মিলি

ঘটনা ২০১৬ সালের। তখনই ঢাকায় বনরক্ষী হিসেবে যোগদান করেন দিলরুবা হক মিলি। নিজের মৌখিক পরীক্ষা, প্রশিক্ষণকালেই জেনেছেন যদি লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেন, তাহলে এই পদে তিনিই হবেন প্রথম বাংলাদেশি কোনো নারী। এরপরও অনেকটা অজ্ঞাতসারেই জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের বনরক্ষী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। এবার এসে তার সেই চাকরিটা স্থায়ী হলো। আর তখন থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল দিলরুবা হক মিলির সাফল্যগাথা। দেশের প্রথম নারী বনরক্ষী হিসেবে পেয়েছেন অগণিত মানুষের ভালোবাসা ও অভিনন্দন। কিন্তু দিলরুবা হকের আজকের এ অবস্থানে আসাটা কিন্তু সহজ ছিল না। বলা চলে এক প্রকার বৈরী পরিবেশের মধ্য দিয়েই এখান পর্যন্ত পৌঁছেছেন তিনি। এত কিছু থাকতে বনরক্ষী কেন? প্রশ্ন করা হলে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে একটু হাসলেন দিলরুবা হক মিলি। হেসে উত্তর দিলেন, ‘আসলে খুব আয়োজন করে বনরক্ষী হয়েছি বিষয়টা এমন নয়। ছোটবেলা থেকেই গাছ গাছালি আর প্রকৃতির প্রতি একটা টান ছিল। প্রকৃতি ভীষণ ভালো লাগত। এর মধ্যেই পড়াশোনা এগিয়ে যেতে থাকে। কাউখালী মহাবিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করি। তখন প্রকৃতি নিয়ে কাজ করতে চাইলাম। আবার পড়াশোনা শেষে চাকরিরও একটা টান থাকে। সেই মতো বনরক্ষী হওয়ার ব্যাপারটা মাথায় ঢুকে। আবার ছোটবেলায়ও এমন একটা সুপ্ত ইচ্ছা মনের ভিতর ছিল। সেই ইচ্ছেটাকে পূরণ করার একটা সুযোগ এলো সামনে। তখনো অবশ্য আমি দারুণ দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। আমাকে দিয়ে হবে কী হবে না, কী করব, কীভাবে করব... আরও নানান কিছু।’

একজন নারী হয়ে বনরক্ষী হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করাটা কিন্তু একটু অভিনবই বটে। এই অভিনব চিন্তা প্রসঙ্গে দিলরুবা হক মিলি বলেন, ‘যে কোনো কাজেই নিজের আনন্দটাই মুখ্য। আপনি যদি একটা কাজ শতভাগ উপভোগ করতে না পারেন তাহলে কিন্তু কাজটা সম্পূর্ণ সফল হয় না। কিছু না কিছু খুঁত থেকে যায়। আর কাজের ক্ষেত্রে নারী আর পুরুষে আমি কোনো পার্থক্য করতে চাই না। আপনি যে লিঙ্গেরই হোন না কেন আপনি কতটুকু কী করতে সামর্থবান সেটাই মুখ্য বিষয় হওয়া উচিত। আমার কাছে মনে হয়েছে আমি কাজটা করতে পারব, তাই চেষ্টা করলাম।’

পারিপার্শ্বিক নানা প্রতিকূলতা থাকলেও নিজের পরিবার আর আশপাশের মানুষের সহযোগিতা পেয়েছেন দিলরুবা। বিশেষ করে বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন প্রতিমুহূর্তের সঙ্গ সমর্থন। বরিশালের পিরোজপুর থেকে পড়াশোনা শেষ করেন মিলি। এরপর বনরক্ষী হিসেবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রশিক্ষণ পর্ব। সেই সময়কার স্মৃতিচারণ করে দিলরুবা মিলি বলেন, ‘ট্রেনিং পর্ব নিয়ে আসলে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। আমাদের ট্রেনিং হয়েছে রাজশাহী পুলিশ একাডেমিতে। যেহেতু আমার ব্যাচে আমিই একমাত্র নারী হিসেবে ট্রেনিং পর্যায় পর্যন্ত এসেছি, তাই আমাকে পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গেই ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। তখন বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হই। আমাদের সময় মৌখিক পরীক্ষায় ২০৩ জন প্রার্থীর মধ্যে আমিই একমাত্র নারী ছিলাম। প্রথম প্রথম আমার নিজের ও সবার একটু খটকা লাগলেও এরপর ঠিক উতরে যাই। আসলে প্রতিকূলতাকে যদি আপনি পাত্তা দেন তাহলে কখনই আপনার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেন না। আমিও কীভাবে যেন সব কিছু উতরে গেলাম। এরপর অবশেষে ২০১৬ সালে ঢাকায় বনরক্ষী হিসেবে যোগ দিই। এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। এখনো পর্যন্ত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে বনরক্ষী হিসেবে কর্মরত আছি।’

নিজের কাজ ভালো মতোই উপভোগ করছেন মিলি। জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান  ফুল ও উদ্ভিদের  জাদুঘরের মতো। তাই এই স্থানের দেখাশোনা করতে গিয়ে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকা হচ্ছে। আর এই ব্যাপারটাই সবচেয়ে বেশি উপভোগ্য দিলরুবা হক মিলির কাছে। দেশের প্রথম নারী বনরক্ষী হিসেবে ইতিহাস গড়ায় নিজের আনন্দের কথা জানালেন সানন্দে। বাবার পাশাপাশি স্বামী এটিএম মাকসুদুল হকও আমাকে দিলেন অনেকটা স্বীকৃতি। কারণ কাছের মানুষের সমর্থন ছাড়া কখনই সাফল্য পূর্ণতা পায় না। দিলরুবা হক মিলির মতো আত্মবিশ্বাসী নারীদের হাত ধরে পাল্টে যাবে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া নারীদের দৃশ্যপট, এমন প্রত্যাশা আমাদের সবার।

সর্বশেষ খবর