শনিবার, ২৭ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

ব্রিটেনে প্রথম বাংলাদেশি মিলিয়নিয়ার

জামশেদ আলম রনি

ব্রিটেনে প্রথম বাংলাদেশি মিলিয়নিয়ার

মুকিম আহমেদ একজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি উদ্যোক্তা ও সমাজসেবক। ৪০ বছর ধরে বাস করছেন যুক্তরাজ্যের টাওয়ার হ্যামলেট এলাকায়।  মাত্র ২৬ বছর বয়সে মিলিয়নিয়ার হন তিনি। ২০১২ সালে ক্ষমতাধর ১০০ ব্রিটিশ-বাংলাদেশির তালিকায় উঠে আসে তার নাম।

ব্যবসা করে মাত্র ২৬ বছর বয়সেই মিলিয়নিয়ার বনে যান যুক্তরাজ্য প্রবাসী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মুকিম আহমেদ।  লন্ডনের ব্রিকলেনে সবচেয়ে বড় রেস্তোরাঁ ক্যাফে নাজের স্বত্বাধিকারী তিনি। ব্রিটেনের কনজারভেটিভ পার্টির রাজনীতিতেও সমান সক্রিয়। মুকিম আহমেদের জন্ম সিলেটে ১৯৫৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর। বাবা মোবারক আহমদ ও মা ওমরজান বিবি। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বন্টু বার্ড স্কুলের প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যাচের ছাত্র মুকিম আহমেদ। সেখান থেকে ভর্তি হলেন কুমিল্লার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আওয়ার লেডি ফাতিমা কনভেন্টে। সে সময় স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন মার্কিন নাগরিক সিস্টার লিও। ভালো ছাত্র বলে এই শিক্ষিকার নজরে পড়েন মুকিম। সিস্টার লিও স্বদেশে চলে যাওয়ার সময় মুকিম আহমেদকে যশোরের দাউদ পাবলিক স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে যান। সেই স্কুল থেকে ১৯৬৯ সালে চারটি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে সিলেট সরকারি কলেজে ভর্তি হন। সেখানে উচ্চমাধ্যমিক এবং পরে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকে ভর্তি হন। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষার আগেই ১৯৭৪ সালে প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়তে চলে যান ব্রিটেন।

বাংলাদেশে ছিল মুকিম আহমেদের বাবার ইলেকট্রনিক্সের ব্যবসা। তাই ব্রিটেনে লেখাপড়ার পাশাপাশি ধীরে ধীরে পা বাড়ান ব্যবসার দিকে। প্রথমে ব্রিটেন থেকে দেশে আমদানি-রপ্তানি শুরু করেন। নিজেদের ইলেকট্রনিক্সের ব্যবসার লন্ডনের বায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ছাড়াও ব্রিটেন থেকে বেডফোর্ড ট্রাক এবং জাপান থেকে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি বাংলাদেশে আমদানি শুরু করেন। সে সময় গড়ে প্রতি মাসে ব্রিটেন থেকে পাঁচটি এবং জাপান ও হল্যান্ড থেকে দুটি কনটেইনার বাংলাদেশে পাঠাতেন মুকিম আহমেদ।

এভাবেই ১৯৭৭ সালে মুকিম আহমেদ পুরোপুরি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। আর সে বছরই তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় মিলিয়নিয়ার তকমা। মাত্র ২৬ বছর বয়সে ব্রিকলেনের প্রথম বাংলাদেশি মিলিয়নিয়ার হন তিনি। তবে স্বীকৃতিটা আসে অনেক পরে। ১৯৮৫ সালে ব্রিটিশ টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আইটিভি প্রথম বাংলাদেশি ‘মিলিয়নিয়ার’ হিসেবে ঘোষণা করে তাঁর নাম। এরপর শুধু ব্রিটেনই নয়, ইউরোপসহ বিশ্বের অন্য দেশগুলো থেকেও হরেক রকম যন্ত্রপাতি আমদানি-রপ্তানির কাজ শুরু করেন তিনি।

সত্তর দশকেই একের পর এক ব্যবসায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন মুকিম আহমদ। কারি থেকে শুরু করে প্রপার্টি ব্যবসা, ট্রাভেলস, আমদানি-রপ্তানি, বিনোদন, প্রকাশনা, রিটেইলিং ব্যবসা-সব ক্ষেত্রেই তিনি সফল। নানামুখী ব্যবসার সাফল্য আর নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা তাকে পৌঁছে দিয়েছে খ্যাতির শিখরে। এক সময় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশ বিমানের সর্ববৃহৎ অপারেটর হিসেবে। বিনোদনের প্রতি রয়েছে মুকিম আহমেদের বাড়তি ঝোঁক। তাই ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটিতে বাংলা সংস্কৃতি চর্চার একটি সুযোগও সৃষ্টি করেন তিনি। ১৯৭৮ সালে শুরু করেন মিউজিক প্রোডাকশন ব্যবসা। বাংলাদেশ থেকে শিল্পীদের এনে নিজের স্টুডিওতে গান রেকর্ডিং ও সেগুলো ইংল্যান্ডের বাজারে ছাড়তে শুরু করেন মুকিম আহমেদ। নিজ সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে এ ব্যবসায় নেমেছিলেন বলেও জানান তিনি। সত্তর দশকে বাংলাদেশি চলচ্চিত্র তৎকালীন ব্রিটেন প্রবাসীদের কাছে পৌঁছে দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। এ ছাড়াও ব্রিটেনের বেতার বাংলার চেয়ারম্যান  মুকিম আহমেদ। ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২৪ ঘণ্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে রেডিওটি। বেতার বাংলা সম্পর্কে মুকিম আহমেদ বলেন, বেতার বাংলা যখন শুনি, তখন মনে হয় দেশেই আছি। এর মধ্য দিয়ে আমাদের আগামী প্রজন্ম, বাংলাদেশ, এর সংস্কৃতি, সংগীত ও নাটক সম্পর্কে ধারণা লাভ করবে।’

সত্তর দশকের শেষের দিকে পূর্ব লন্ডনে মুকিম আহমেদ প্রতিষ্ঠা করেন ‘সিলটো ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি’। প্রতিষ্ঠানটি রেডিও, টেলিভিশন, ক্যাসেট, ক্যালকুলেটর ইত্যাদি ব্রিটেনজুড়ে বাজারজাত করত। আশির দশকে প্রতিষ্ঠানটির দৈনিক আয় ছিল  ২০ হাজার পাউন্ড। ভাইদের সঙ্গেও যৌথভাবে শিপিং ব্যবসা পরিচালনা করেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক ছেলে ও মেয়ের বাবা। সপরিবারে এখন ব্রিটেনে। একজন সফল ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও কমিউনিটি নেতা হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। মুকিম আহমেদ কনজারভেটিভ ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ব্যবসা-বাণিজ্য ও ইস্ট লন্ডনের কমিউনিটিতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ম্যারি কুইন কলেজ তাকে অনারারি ফেলো নির্বাচিত করে। তিনি ব্রিটিশ-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের তিনবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালে ব্রিটেনে এশিয়ার শীর্ষ ২০০ ধনীর একজন নির্বাচিত হন মুকিম আহমেদ । ২০০৫ সালে তাকে কিং অব ব্রিকলেন এবং ২০০৭ সালে কারি কিং হিসেবে আখ্যায়িত করে ব্রিটেনের শতবর্ষের পুরনো প্রোপার্টি জার্নাল ‘এস্টেট গেজেট’। প্রপার্টি কিং নামেও তিনি সুপরিচিত। ২০১২ সালে ক্ষমতাধর ১০০ ব্রিটিশ-বাংলাদেশির তালিকায় উঠে আসেন মুকিম আহমেদ। ১৯৯১ সালে বিবিসি টেলিভিশন তাকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম প্রচার করে।

সর্বশেষ খবর