শনিবার, ১২ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা
ফিনল্যান্ডের একটি স্কলারশিপ বদলে দেয় জীবন

জেলেপাড়া থেকে মাইক্রোসফটে নিখিল

জামশেদ আলম রনি

জেলেপাড়া থেকে মাইক্রোসফটে নিখিল

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। চট্টগ্রামের পতেঙ্গার জেলেপাড়ার সন্তান নিখিল দাশ ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন বৃহৎ কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করার। কঠোর অধ্যবসায় আর একাগ্রতার ফলে সেই স্বপ্ন তিনি বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। টিউশনির টাকায় স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করা নিখিলের জন্য ছিল বেশ চ্যালেঞ্জের। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তিনি সফলভাবে শেষ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা। অবশেষে ফিনল্যান্ড থেকে পাওয়া একটি বৃত্তি বদলে দেয় নিখিলের জীবনের গতিপথ। এখন তিনি কাজ করছেন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী নিখিল ইতিমধ্যে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকির এসপো সিটিতে মাইক্রোসফটের অফিসে ল্যাব ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগদান করেছেন।

নিখিল চট্টগ্রামের কাটগড় মুসলিমাবাদ জেলেপাড়ার বাসিন্দা নিরাঞ্জন জলদাশ ও কমলা দাশের একমাত্র সন্তান। পতেঙ্গা ইস্টার্ন রিফাইনারি মডেল হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাস করেন তিনি। ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। সেখান থেকে ২০১৫ সালে স্নাতক ও ২০১৬ সালে স্নাতকোত্তর শেষে স্কলারশিপ নিয়ে পাড়ি জমান ফিনল্যান্ডে। ফিনল্যান্ডের ত্যামপেরে ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্সে পড়াশোনা করেন তিনি। এরপর গত ১২ এপ্রিল যোগ দেন মাইক্রোসফটে। নিখিল বলেন, ‘যখন বাবা মারা যান, তখন আমার বয়স ছিল সাড়ে তিন বছর। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। মা গার্মেন্টে চাকরি করেছেন, পরে একটি এনজিওতে চাকরি নেন। এসএসসির পর নিজের খরচ চালানোর জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করতে শুরু করি।’

তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার পর গবেষণার প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়। কিন্তু আমার পিছুটান ছিল। টাকার অভাবে আমাকে মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে টিউশনি করতে হতো। তাই গবেষণার সুযোগ পাইনি। পরে চট্টগ্রামের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেছি। পাশাপাশি স্কলারশিপের জন্য চেষ্টা করেছি। ২০১৮ সালে আমি স্কলারশিপ নিয়ে ফিনল্যান্ডে আসি। এরপর আমাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। মাইক্রোসফটে চাকরি হওয়ার আগে আমি এখানে আরেকটি প্রতিষ্ঠানে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করি।’

‘আমি পোশাক কারখানায় চাকরি করেছি, ৬০০ টাকা বেতনে এনজিওতে কাজ করেছি। অনেক কষ্টে সন্তানকে মানুষ করেছি। আমার চাওয়ার চেয়েও আমার ছেলে বেশি কিছু হয়েছে। আমি অনেক খুশি।’

সাফল্যের পেছনে মায়ের অসাধারণ ভূমিকার কথা অকপটে স্বীকার করেন নিখিল। তিনি বলেন, ‘বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট। এখানে কাজ করতে পারা গর্বের। সৃষ্টিকর্তা আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। তবে আমার মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে আমি এতদূর আসতে পেরেছি।’ একমাত্র ছেলের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন নিখিলের মা কমলা দাশ। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নিখিলের বয়স যখন সাড়ে তিন বছর তখন তার বাবা মারা যান। এরপর আমি কিছুদিন একটা পোশাক কারখানায় কাজ করি। এরপর ৬০০ টাকা বেতনে একটি এনজিওতে চাকরি করেছি। পাশাপাশি টিউশনিও করেছি। নিখিলের পড়াশোনা চালানো এবং সংসার চালাতে সেটি করতে হয়েছে। আমাদের একমাত্র সন্তান নিখিল। বাপের বাড়ি থেকে আমাকে বিয়ে দিতে অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নিখিলের দিকে তাকিয়ে আমি আর বিয়ে করিনি। অনেক কষ্টে সন্তানকে মানুষ করেছি। আমার চাওয়ার চেয়েও আমার ছেলে বেশি কিছু হয়েছে। আমি অনেক খুশি।’

কমলা দাশ আরও বলেন, ‘টানাটানির সংসার ছিল। ভালো খাওয়াতে পারিনি ছেলেকে। ভালো জামা পরতে দিতে পারিনি। ছেলে এসব বুঝত। তাই এসএসসি পাস করে টিউশনি করা শুরু করে। নিজের খরচ নিজে জোগাত। তারপর থেকে আমার আর চিন্তা করতে হয়নি তাকে নিয়ে। সে এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে সবকিছু নিজের প্রচেষ্টায়। অনেক কষ্টে নিখিলকে এখানে আনতে পেরেছি। এতদূর  যে তাকে আনতে পারব তা কল্পনাও করিনি। আশা করি, আমার ছেলে প্রত্যেক দরিদ্র পরিবারের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। প্রতিটি মা-বাবা সন্তানের প্রতি নিবিড় যত্নবান হলে সে সন্তান সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে বলেও মনে করেন এই গর্বিত মা।’ নিখিলের এ সাফল্যে খুশি পতেঙ্গাবাসীও। তরুণদের উদ্দেশে নিখিল বলেন, স্বপ্ন দেখলে বড় স্বপ্ন দেখতে হবে। লেগে থাকলে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব। লক্ষ্য ঠিক থাকলে সেটি পূরণ হবেই। হতাশ হলে চলবে না। কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত লেগে থাকতে হবে। নিখিল বলেন, ইতিমধ্যে আমি মাইক্রোসফটে ল্যাব অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেছি। সারা জীবন আমি মাইক্রোসফটের বিভিন্ন প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে করতে বড় হয়েছি। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল জায়ান্ট কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করার। মাইক্রোসফটের পরিধি অনেক বড়। এখানে আমার মেধার পুরোটাই দেওয়া যাবে। আমি নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করব, যাতে দেশের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে পারি।  এ জন্য আমি সবার কাছে দোয়া প্রার্থী। 

সর্বশেষ খবর