শনিবার, ৭ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা
মানবিক উদ্যোগ

শেষ বিদায়ের স্বজন ওরা

মহিউদ্দিন মোল্লা, কুমিল্লা

শেষ বিদায়ের স্বজন ওরা

২০২০ সালের ১৮ মে। কুমিল্লা নগরীতে করোনায় প্রথম মৃত্যু। তিনি সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা মাহবুবে এলাহী। নগরীজুড়ে আতঙ্ক। করোনা আক্রান্তের বাড়ির পাশ দিয়েও হাঁটা যাবে না। তার খবর নেওয়া, মৃতের জানাজা দেওয়া তো দূরের কথা- তখন এমন ভুল ধারণা ছিল মানুষের মাঝে। ভয়ে সন্তানের জানাজাও দেননি পিতা। সেই সময় এগিয়ে আসেন একদল তরুণ। তারা শেষ বিদায়ের স্বজন হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ান। তারা এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এমন ৩৫৯ জন মানুষকে সম্মানের সঙ্গে শেষ বিদায় দিয়েছেন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিবেকের ব্যানারে কাজ করেন তারা।

সংগঠনের সূত্রমতে, করোনার প্রকোপকে কেন্দ্র করে বিবেক সংগঠনটি গড়ে উঠে গত বছরের ৩০ মার্চ। শুরুতে করোনা সচেতনতা, মাস্ক বিতরণ, রোগীদের বাসায় খাদ্য, ওষুধ ও ফলমূল পৌঁছে দেন সংগঠনের সদস্যরা। প্রথমে ১১ সদস্যের টিম কাজ শুরু করে। এখন তার সদস্য ৫০ জন। তারা নগরীসহ জেলার বিভিন্ন স্থানেও দাফন কার্যক্রম করেন। বিবেক-এর প্রতিষ্ঠাতা ইউসুফ মোল্লা টিপু বলেন, করোনা মহামারীতে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করছি। যে কাজটি মৃতের স্বজন সন্তানরা করতেন, তারা সে কাজ না করায় আমরা তা করেছি। এ কাজ করতে গিয়ে আমার পুরো পরিবারও আক্রান্ত হয়। বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত ৩৫৯ জন মানুষকে আমরা সম্মানের সঙ্গে শেষ বিদায় দিয়েছি। যার মধ্যে মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ রয়েছেন। দাফন কার্যক্রমের পাশাপাশি দরিদ্র পরিবারের রোগীর জন্য বিনামূল্যে অ্যাম্বুলেন্স সেবা, অক্সিজেন প্রদান ও ওষুধ দিয়ে থাকি।

শুরুর দিকের বিষয়ে তিনি বলেন, ঢাকায় মারকাজুল ইসলাম করোনায় মৃতদের দাফন শুরু করে। নারায়ণগঞ্জে খোরশেদ আলম। ফেসবুকে দেখলাম আশুগঞ্জের এক লোকের লাশ পড়ে আছে। কেউ এগিয়ে আসছেন না। বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তুলল। সহপাঠীদের নিয়ে সৈয়দবাড়ি মসজিদে বসলাম। তাদের বললাম, কুমিল্লায় করোনায় কেউ মারা গেলে কী হবে? সেই থেকে শুরু। আমরা এক দিনে ১২ জনের দাফনের কাজও করেছি।

কষ্টের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে তিনি জানান, প্রথম দাফনের সময়। আমাদের অভিজ্ঞতা কম। ১৯৯৭ সালে বাবা মারা যান। তখন বয়স কম। সেই প্রথম কবরে নামি। করোনায় মৃত ব্যাংকারের দেহ কোন কক্ষে আছে কেউ দেখিয়ে দিচ্ছেন না। স্বজনরা এগিয়েও আসছেন না। দাফনের প্রথমদিকে অনেকে আমাদের দেখলে ভয়ে সরে যেত। যেন আমাদের পাশে এলেই করোনা ধরে মরে যাবে। আরেকটি ঘটনা মৌলভীপাড়ার। একজন মাওলানা মারা যান। ওই বাড়ির মালিক তার স্বজনদের তালাবন্দী করে রাখেন। তার ভয় তারা বাসা থেকে বের হলে করোনায় সবাই মারা যাবে। বেশি কষ্টের ঘটনা সদর দক্ষিণ উপজেলার বেলতলী এলাকায়। এক লোকের ছেলে মারা গেছে। আমরা দাফন করতে গেছি। গোসলের জন্য একটি ভালো জায়গা দেননি বাবা। তিনি ভয়ে জানাজায় ছিলেন না। একটি খাটিয়া পাওয়া যায়নি। মসজিদে তালা। আধা কিলোমিটার দূরে ধান খেতের আইল দিয়ে স্ট্রেচারে করে লাশ নিয়ে দাফন করতে হয়েছে।

সুখের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জানান, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করছি। বাহবা বা প্রচারের জন্য নয়। তবু দলমত নির্বিশেষে মানুষের শুভকামনা শুনলে ভালো লাগে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানুষের পাশে মানুষকেই দাঁড়াতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর