শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা
সন্দ্বীপ পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়

জীর্ণ থেকে ‘বাতিঘর’

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

জীর্ণ থেকে ‘বাতিঘর’

চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার পশ্চিম দেওয়ান নগর সন্দ্বীপ পাড়া। পৌরসভা থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে। এখানে প্রায় আড়াই হাজার পরিবারের বসবাস। কিন্তু নেই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দূরত্ব আড়াই কিলোমিটার। এত দূরের স্কুলে সন্তানদের পাঠানোর ইচ্ছা-সামর্থ্য ও আগ্রহ কারও নেই। ফলে অকালেই উপার্জনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতো শিশুরা। 

১৯৯৭ সালে একটি উন্নয়ন সংস্থা ‘সন্দ্বীপ পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়’  প্রতিষ্ঠা করে। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর অর্থসংকটে খুঁড়িয়ে চলা বিদ্যালয়টি ক্রমে জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হতে থাকে। হয়ে পড়ে পাঠদান অনুপযোগী। কমে যায় শিক্ষার্থী। ২০১৯ সালের প্রথম দিকে বিদ্যালয়টি নজরে আসে হাটহাজারী উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তার। শুরু হয় পরিবর্তন। বদলে যায় জীর্ণ স্কুল। তৈরি করা হচ্ছে বাতিঘর নামে একটি তিনতলা শিক্ষা ভবন। ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে প্রথম তলার কাজ। সেই জীর্ণশীর্ণ স্কুল থেকে এটি এখন শিক্ষার বাতিঘর। মাত্র ৬০ জন শিক্ষার্থীর স্কুলে এখন প্রায় ৪০০ জন শিক্ষার্থী।

জানা যায়, সন্দ্বীপ পাড়ার মানুষ পেশায় কেউ দিনমজুর, কেউ রিকশাচালক, কেউ সিএনজিচালক, কেউ বর্গাচাষি, কেউ অন্যের বাসায় কাজ করেন, কেউ গার্মেন্ট কর্মী, কেউ বাবুর্চি। টাকা খরচ করে ভর্তি ও মাসে মাসে বেতন এবং আড়াই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর মানসিকতা ও সামর্থ্য কোনোটাই নেই। তাই সন্তান একটু বড় হলেই বাবার সঙ্গে উপার্জনে চলে যেত। এখন বিনামূল্যে ভর্তি করা হয় শিক্ষার্থীদের। স্কুল সুরক্ষায় দেওয়া হয়েছে সীমানা দেয়াল। নির্মাণ করা হয় দৃষ্টিনন্দন গেট। শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয় বৃত্তি। 

হাটহাজারী উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মাদ রুহুল আমীন বলেন, ‘২০১৯ সালের শুরুতে খবর পেয়েই বিদ্যালয়টি পরিদর্শনে যাই। কিন্তু নাজুক অবস্থা দেখে বিস্মিত হই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে চলেছেন, ঠিক তখনই একটি স্কুল এভাবে জরাজীর্ণ থাকাটা কল্পনাতীত। এরপর থেকেই উন্নয়ন কাজ শুরু করি। প্রথমেই শুরু হয় জরাজীর্ণ বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ। দরজা, জানালা, দেয়াল, ছাদ, সিলিং সব পরিবর্তন করা হয়। নতুন করে তৈরি করা হয় তিনটি শ্রেণিকক্ষ, টিচার্স রুম, অ্যাসেম্বলির জন্য নতুন ফ্লাগ স্ট্যান্ড, জাতীয় পতাকা, বেঞ্চ, বৈদ্যুতিক ফ্যান, ব্ল্যাকবোর্ডসহ নানা শিক্ষা উপকরণ। তিনি বলেন, ‘আগে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসতে চাইত না। এখন সময়ের আগেই তারা স্কুলে চলে আসে। যে ক্লাসে ছিল মাত্র দুই জোড়া বেঞ্চ, সেখানে এখন ১৫ জোড়া দিয়েও সংকুলান হয় না। এখন বাচ্চারা স্কুল ফেলে কাজে যেতে চায় না, বরং কাজ ফেলে স্কুলে চলে আসে। তাদের আগ্রহের কেন্দ্র এখন সন্দ্বীপ পাড়া স্কুল। স্কুলটির আমূল পরিবর্তনের কারণে এমনটি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তিনতলা বিশিষ্ট শিক্ষা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করি। ভবনটির নাম দিই বাতিঘর। ইতিমধ্যে একতলার কাজ শেষ।’ 

জানা যায়, স্কুলটিতে ছিল না কোনো শৌচাগার। প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের যেতে হতো নিজ বাড়ি কিংবা প্রতিবেশীদের বাড়িতে। এ কারণেও অনেক ছাত্রী স্কুলবিমুখ ছিল। শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল না সুপেয় পানির ব্যবস্থা, সক্ষমতা ছিল না শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার। এখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে মানসম্মত শৌচাগার। পাঠদান পরিবেশ নির্বিঘ্ন করতে নির্মাণ করা হয় সীমানা প্রাচীর। সীমানার মধ্যেই স্থাপন করা হয় গভীর নলকূপ। শিক্ষার্থীদের স্কুলের প্রতি আগ্রহী করতে সামনের জঙ্গল, খানাখন্দ এবং পরিত্যক্ত স্থাপনা ভেঙে প্রস্তুত করা হয় খেলার মাঠ। দেওয়া হয় ফুটবল ও ক্রিকেটসহ নানা ক্রীড়াসামগ্রী।  মেয়েদের জন্যও তৈরি করা হয় পৃথক মাঠ। নানা উদ্যোগের ফলে এক বছরের মধ্যে আলোকিত হয় প্রতিষ্ঠানটি। ৬০ জন শিক্ষার্থীর স্কুলে এখন ৪০০ জনে দাঁড়িয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর