শনিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

নওগাঁয় জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে শতবর্ষী দুই লাইব্রেরি

হাতে লেখা কোরআন শরিফ ও তালপাতায় লেখা পুঁথির সংগ্রহশালা

বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ

নওগাঁয় জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে শতবর্ষী দুই লাইব্রেরি

নওগাঁর বদলগাছীর প্রত্যন্ত গ্রামে রয়েছে দুটি শতবর্ষী লাইব্রেরি। ওই লাইব্রেরিগুলো ছড়িয়ে যাচ্ছে জ্ঞানের আলো। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি লাইব্রেরিগুলোতে। অথচ লাইব্রেরিগুলোতে রয়েছে হাতে লেখা কোরআন শরিফ ও তালপাতায় লেখা পুঁথিসহ নানা বই। কিন্তু সংস্কারের অভাবে নষ্ট হচ্ছে শত বছরের নিদর্শনগুলো।

ভাতসাইল গ্রামের মরহুম মোশাররফ হোসেন চৌধুরী জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ১৯৫০ সালে স্থাপন করেন ভাতসাইল প্রগতিশীল লাইব্রেরি। সেখানে রয়েছে হাতে লেখা কোরআন শরিফ। তালপাতা ও কলাপাতায় লেখা শত বছরের পুরনো পুঁথি। সেই মোশারফ আর নেই। রেখে গেছেন তার জীবনভর সংগ্রহের দুর্লভ স্মৃতি। ছোটবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি তার দুর্বার আকর্ষণ। বই পেলে আর কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। সেই সূত্র ধরেই চাকরাইলের রেজওয়ান লাইব্রেরির সদস্য হন। তখন তিনি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। এক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় সেখানে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল তার। জুড়ে দেন কান্না-বই যে তাকে পড়তেই হবে। শেষে মা বললেন, ঠিক আছে তুই নিজেই লাইব্রেরি কর, আমি তোকে বছরে ১০০ টাকা করে দেব। দাদিও রাজি হলেন ১০০ টাকা করে দিতে আর চাচা শফিউদ্দীন চৌধুরী তার বৈঠকঘর ব্যবহারের অনুমতি দিলেন। নিজের সংগ্রহের পাঁচটি বই ঠাকুরমার ঝুলি, আলীবাবা, আনোয়ারা, সালেহা আর মুসলিম পঞ্চসতী- এই নিয়ে শুরু হলো যাত্রা। সেটা ছিল ১৯৪৭ সাল। ধীরে ধীরে যুক্ত হলেন গ্রামের প্রবীণরা। মোশারফ হোসেন চৌধুরী ঝোলা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বই সংগ্রহে, বন্ধু-আত্মীয়, পরিচিত-অপরিচিত যার কাছে যেটা পাওয়া যায়। আর লোভনীয় কোনো বই পেলে তো কথাই নেই। গ্রামের পর গ্রাম, মাইলের পর মাইল হাঁটতেও তখন কোনো ক্লান্তি নেই। ১৯৫০ সালে এসে গঠিত হলো কমিটি। দেখতে দেখতে সাতটি আলমারি বইয়ে ভরে গেল। শফিউদ্দীন চৌধুরীর বৈঠকখানায় আর সংকুলান হয় না। তাই নতুন জায়গা নির্ধারণ করা হলো। তার আরেক চাচা আলহাজ আবদুল মতিন চৌধুরী তার ফাঁকা ১৫ শতাংশ জমি দান করেন। সেখানে মাটির ঘর তুলে দিলেন শফিউদ্দীন চৌধুরী। এ থেকে ভাতসাইল প্রগতি সংঘ পাঠাগার পেল নিজস্ব ঠিকানা। পড়াশোনার জন্য গ্রাম ছাড়তে হয় মোশারফ চৌধুরীকে। ঢাকায় এসে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। ১৯৫২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তাঁর চোখের সামনে সংঘটিত হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। বদলে দেয় তাঁর জীবনবোধ, জীবনদর্শন। জন্ম নেয় নতুন উপলব্ধি। তার ভাষায়, আমরা যতই বড় বড় কথা বলি না কেন, আমাদের ভিতর খুব বড় একটা ফাঁক রয়েছে। নিজেদের ঐতিহ্য আছে, ভাষা আছে, সংস্কৃতি আছে, ইতিহাস আছে কিন্তু আমাদের মধ্যে চেতনা নেই। ফলে সব কিছুই হয়ে পড়ে অন্তসারশূন্য। কাজেই সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষা, যা গ্রাম থেকেই শুরু করতে হবে। এর মধ্যে ব্যক্তি জীবনেও বয়ে যায় ঝড়। খুব কাছাকাছি সময়ে মারা যায় তাঁর মা, দাদি ও আদরের বোন। তিনটি মৃত্যু তাকে অসহায় করে তোলে। লেখাপড়ার ইতি টেনে ফিরে আসেন গ্রামে। অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরেন লাইব্রেরিটিকে। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে প্রখ্যাত ব্রিটিশ লাইব্রেরি বিশেষজ্ঞ জে. স্টিফেন পার্কার এসেছিলেন লাইব্রেরিটি দেখতে। যাওয়ার সময় পরিদর্শন বইয়ে তিনি লিখেন, পৃথিবীর বহু দেশের অনেক লাইব্রেরি দেখেছি কিন্তু বাংলাদেশের সুদূর পল্লীতে এমন বৈশিষ্ট্যমন্ডিত লাইব্রেরি খুবই কম দেখেছি। সত্যিই বিস্মিত। গবেষণা বিভাগে রয়েছে ৭৭টি প্রাচীন পান্ডুলিপি। এগুলো তালপাতা, কলম গাছের বাকল এবং হাতে তৈরি কাগজের লেখা। এর কোনো কোনোটি ২০০ থেকে ২৫০ বছর বা তারও আগের বলে ধারণা করেন প্রাচীন পুঁথি সংগ্রাহক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ খান। মনসামঙ্গল, গাজী কালু চম্পাবতী, ছহি ইউসুফ জোলেখা, ছহি শেখ ফরিদ, ছহি চাহার দরবেশ, ছহি বড় সোনাভান, গোলে বাকাওলি, জঙ্গে খয়বর প্রভৃতি প্রাচীন পুঁথি আছে ১৫০টি। লোককবিদের কাহিনিমূলক বই আছে ২৫০টি। রয়েছে প্রায় ৩০০ বছর আগের হাতে লেখা কোরআন শরিফ। এ ছাড়াও উনিশ ও বিশ শতকের প্রথম দিকের বেশ কিছু মূল্যবান বই। ১৯৯১ সালে বন্যায় ৩০০ বইয়ের সঙ্গে বেশ কিছু পত্রিকাও নষ্ট হয়ে যায়। তারপরও  সওগাত, মাহে নওসহ রয়েছে হাজারখানেক পুরনো পত্রিকা। বর্তমানে লাইব্রেরিতে ২০ থেকে ২২ হাজার বই সংরক্ষিত আছে।

এদিকে কবি তালিম হোসেন চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি নওগাঁর বদলগাছীর চাকরাইল গ্রামে। তিনি গ্রামের মানুষকে বই পড়ার অভ্যাস তৈরির লক্ষ্যে ১৯৩৬ সালে স্থাপন করেন চাকরাইল রিজওয়ান লাইব্রেরি। সেখানে রয়েছে তালপাতায় লেখা পুঁথিসহ শত বছরের হাজারও বই। ভাতসাইল প্রগতিশীল পাঠাগারের লাইব্রেরিয়ান মুনতাছির আরিফ বলেন, লাইব্রেরিগুলো শত বছরের পুরনো হওয়ায় অনেক বই রয়েছে। টিনগুলো ফুটো হওয়ায় পানি পড়ে। তাই আধুনিকায়ন করা হলে বর্তমান প্রজন্ম লাইব্রেরিমুখী হবে আর অনেক কিছু শিখবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লাইব্রেরিগুলোকে আধুনিকায়ন করা দরকার।  প্রত্যন্ত গ্রামে লাইব্রেরিগুলো হওয়ায় অনেক সমস্যা রয়েছে।  আর সংস্কার না করায় নষ্ট হচ্ছে শত বছরের পুরনো বইসহ বিভিন্ন নিদর্শন। বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলপনা ইয়াসমিন লাইব্রেরি দুটি পরিদর্শন করে সব পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেন।

সর্বশেষ খবর