শনিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা
এক ধান গাছে বছরে পাঁচবার ফলন

আবেদ চৌধুরীর ধান বিপ্লব

সৈয়দ বয়তুল আলী, মৌলভীবাজার

আবেদ চৌধুরীর ধান বিপ্লব

দীর্ঘদিন ধরেই ধান নিয়ে কাজ করছেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মৌলভীবাজারের জিনবিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী। সেই গবেষণার ফসল হিসেবে বোরো জাতের নতুন ধান গাছ উদ্ভাবন করে চমক সৃষ্টি করেছেন তিনি। প্রথমবারের মতো একবার একটি ধান গাছ রোপণ করে একই গাছ থেকে পাঁচবার ফলন পাওয়া গেছে।  এখন তিনি কাজ করছেন আরও একবার, অর্থাৎ বছরে ছয়বার ফসল পাওয়া নিয়ে।

 

♦ আবেদ চৌধুরী ধান গবেষণা করছেন ২০ বছর ধরে
♦ এ পর্যন্ত উদ্ভাবন করেছেন প্রায় ৩০০ রকম নতুন ধান
♦ লাল চাল ও রঙিন ভুট্টার উদ্ভাবকও তিনি
♦ রঙিন ভুট্টা ডায়াবেটিস ও ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবে সমাদৃত
♦ অস্ট্রেলিয়ায় ধান ও ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে চলছে গবেষণা
 

মূল রচনা

কৃষিতে কীভাবে আয় বাড়ানো যায় এবং ব্যয় কমানো যায় তা নিয়ে আমি সারাক্ষণ চিন্তা করি। আমার চিন্তা ছিল জমিতে একবার ধান রোপণ করে একাধিকবার ফসল কাটব। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমবে, বাড়বে আয়।  আমি এই জিনিসটাই করতে চেয়েছি, অত্যন্ত আনন্দের বিষয় আমি করতে পেরেছি।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কৃষি উর্বর জেলা মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় হাজীপুর ইউনিয়নের কানিহাটি গ্রামের দিগন্ত জোড়া আমন ফসলির মাঠের একাংশে প্রায় দুই বিঘা জমিতে উৎপাদন হয়েছে পাঁচ ফসলি ধান। এই গ্রামের সন্তান জিনবিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী এই পাঁচ ফসলি ধানের উদ্ভাবক। অবিশ্বাস্যভাবেই এই ধান একবার রোপণের পর পাঁচবার কাটা যায়। বছরে এই ধান গাছ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচবার ফসল পাওয়া যায়।

সরেজমিন কুলাউড়ার কানিহাটি গ্রামে দেখা যায়, গ্রামজুড়ে বিস্তীর্ণ সোনালি ফসলের মাঠ। এই ফসলের মধ্যে জন্মেছে নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী ধান। এই ধান একবার রোপণে বছরজুড়ে পাঁচবার ফলন পাওয়া যায়।

ধানের এ নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন জিনবিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী। প্রবাসী এ বিজ্ঞানী দীর্ঘদিন ধরে ধানের নতুন জাত আবিষ্কার নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসছেন। এক ধান গাছ থেকে পাঁচবার ফলন পাওয়াতে তিনি সন্তুষ্ট নন। যাতে ছয়বার একই গাছ থেকে ধান পাওয়া যায় এ নিয়ে বর্তমানে গবেষণা করছেন। একই সঙ্গে নতুন জাতের এ ধান যাতে সারা দেশে চাষাবাদ করা যায় সেই চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে শুরুটা কীভাবে হয়েছে সে বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা কৃষির ওপর খুব নির্ভরশীল ছিলাম। আমি দেখেছি যারা ধান চাষ করে তারা উন্নত জীবনযাপন করতে পারেন না। এটা আমার জন্য খুব পীড়াদায়ক ছিল। কারণ আমরা কৃষিনির্ভর পরিবারের মানুষ দেখেছি দেশে খুব অবহেলিত। মানুষ শুধু চায় কম দামে ধান পেতে। কিন্তু কৃষকরা ধানের মূল্য পাচ্ছে না। তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি আমার ব্যক্তিগতভাবে কৃষিতে কীভাবে আয় বাড়ানো যায় ব্যয় কমানো যায় এটা নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা করি। আমার চিন্তা ছিল জমিতে একবার ধান রোপণ করে একাধিকবার ফসল কাটব। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমবে, বাড়বে আয়। আমি এই জিনিসটাই করতে চেয়েছি। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় আমি করতে পেরেছি। বোরো হিসেবে বছরের প্রথমে লাগানো এ ধান ১১০ দিন পর পেকেছে। ওই গাছেই পর্যায়ক্রমে ৪৫ দিন পরপর একবার বোরো, দুবার আউশ এবং দুবার আমন ধান পেকেছে। কম সময়ে পাকা এই ধানের উৎপাদন বেশি, খরচও কম। তবে প্রথম ফলনের চেয়ে পরের ফলনগুলোতে উৎপাদন কিছুটা কম। কিন্তু পাঁচবারের ফলন মিলিয়ে উৎপাদন প্রায় পাঁচ গুণ বেশি।

আবেদ চৌধুরী আরও জানান, যে জাতগুলোর ধান পাকার পর কেটে নিয়ে গেলে আবার ধানের শীষ বের হয়, সেগুলো তিনি আলাদা করেন। এভাবে ১২টি জাত বের করেন। তিন বছর ধরে জাতগুলো চাষ করে দেখলেন, নিয়মিতভাবে এগুলো দ্বিতীয়বার ফলন দিচ্ছে। তারপর তিনি শুরু করেন একই গাছে তৃতীয়বার ফলনের গবেষণা। চারটি জাত একই গাছ থেকে পাঁচবার ফলন দিচ্ছে। এই চারটি জাতের ওপর ১০ বছর ধরে চলছে গবেষণা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বোরো ধানের এই চারটি জাত দুই বিঘা জমিতে রোপণ করা হয়। পরিমাণমতো ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা হয়। সঠিকভাবে সেচ ও পরিচর্যা করার পর ১১০ দিনের মধ্যে ৮৫ সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার উচ্চতার গাছে ফসল আসে। পরে মাটি থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার উচ্চতায় পরিকল্পিতভাবে ওই ধান কেটে ফেলা হয়। মে মাসের প্রথম দিকে প্রথমবার কাটা ধানে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হয়েছে চার টন। তারপর থেকে ৪৫ দিন অন্তর প্রতিটি মৌসুমে হেক্টরপ্রতি কখনো দুই টন, কখনো তিন টন ফলন এসেছে। সব জাত হেক্টরপ্রতি প্রায় ১৬ টন ফলন দিয়েছে। যেহেতু পাঁচবার চাষ হয় সেহেতু ‘পঞ্চব্রীহি’ নাম দিতে চাই। এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে আমার এলাকার নামেও দিতে পারি।

তিনি বলেন, বছরের যে কোনো সময়ে এ ধান রোপণ করা যায়। এখন পরের ধাপগুলোতে কিছুটা কম উৎপাদন হচ্ছে। আমার চেষ্টা থাকবে, আরও বেশি ফলন বের করার। এ ধানের বীজ সংগ্রহ সহজ। কৃষকরা নিজেরাই তা করতে পারবেন। অন্য ধানের মতো বীজতলায় রোপণের পর চারা তুলে চাষ করতে হয়।

পঞ্চমবার ফলন দেওয়া ধান উদ্ভাবন সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে আবেদ চৌধুরী বলেন, এর আগে আমি অন্য ধানের জাত উদ্ভাবন করেছি। দুবার ফসল হয়, এমন ধানও উদ্ভাবন করেছিলাম; যাকে আন্তর্জাতিক মিডিয়া রাইস টুআইস বলেছে। আবার অনেকে জীবন বর্ধিত ধান বলেছে। এই প্রথম সারা বছর আমার অন্য আরেকটি ধানের জাত মাঠে থাকল। এ ধানের চারা ৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে রোপণ করতে হয়। ফলে গাছটি মাটি থেকে ভালোভাবে শক্তি নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে এবং একটি ধান গাছ থেকে আরও বেশ কয়েকটি ধান গাছ গজাতে থাকে।

ড. আবেদ চৌধুরী একজন জিনগবেষক। একদল অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানীর সঙ্গে তিনি ফিস (ইন্ডিপেনডেন্ট সিড) জিন আবিষ্কার করেন। তিনি লাল রঙের চাল ও রঙিন ভুট্টাও উদ্ভাবন করেছেন। তার ডায়াবেটিস ও ক্যান্সার প্রতিরোধক রঙিন ভুট্টা বিশ্বব্যাপী আলোচিত। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদন ও ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে গবেষণা করছেন।

কুলাউড়ার কানিহাটি গ্রামের সন্তান আবেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে কৃষি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে চাকরি নিয়ে চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানকার জাতীয় গবেষণা সংস্থার প্রধান ধানবিজ্ঞানী হিসেবে ধানের জিন নিয়ে গবেষণা করে কাটিয়ে দিয়েছেন ২০ বছর। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩০০ রকমের নতুন ধান উদ্ভাবন করেছেন।  গ্রামের বাড়ি কানিহাটিতে গড়ে তুলেছেন কৃষি খামার। তার নামে আবেদ ধানও এলাকায় চাষ করে সফলতা পেয়েছেন কৃষকরা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর