শনিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা
বিজ্ঞানী ফারহানার চমক

পাট থেকে স্যানিটারি প্যাড

উদ্ভাবন

জামশেদ আলম রনি

পাট থেকে স্যানিটারি প্যাড

ফারহানা সুলতানার জন্ম ঠাকুরগাঁওয়ে। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। ফারহানা সুলতানা বলেন, ‘আমি পাট দিয়ে স্যানিটারি প্যাড তৈরির জন্য মেশিনের কথা জানিয়েছিলাম প্রতিযোগিতায়। এ নিয়ে ভিডিও উপস্থাপনা জমা দিয়েছিলাম। এতে বিভিন্ন দেশের বিচারকদের পাশাপাশি অডিয়েন্স পোলের মাধ্যমে ভোটের সুযোগ ছিল। সব বিবেচনায় আমি প্রথম হয়েছি।’ 

পাটের সেলুলোজ একটি নতুন উপাদান। বর্তমানে দেশে প্যাড তৈরির কোনো মেশিন নেই। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ফারহানার উদ্ভাবিত মেশিন দিয়ে সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব স্যানিটারি প্যাড তৈরি করা যাবে, যা বাংলাদেশের নারীদের মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষায় ভূমিকা রাখবে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সহকারী বিজ্ঞানী ফারহানা সুলতানা। সম্প্রতি পাট থেকে প্রাপ্ত সেলুলোজ দিয়ে স্যানিটারি প্যাড তৈরির মেশিন বানিয়ে সাড়া ফেলেছেন তিনি। এর স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন আন্তর্জাতিক পুরস্কার। আমেরিকান সোসাইটি অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন (এএসটিএমএইচ)-এর ২০২১ সালের অ্যানুয়াল ইনোভেশন পিচ কম্পিটিশনের ‘গ্র্যান্ড প্রাইজ উইনার’ হয়েছেন বাংলাদেশি এই বিজ্ঞানী।

২০১৮ সাল থেকে চালু হওয়া এই সম্মাননার চতুর্থ বর্ষে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এই পুরস্কার অর্জন করেন তিনি।

ফারহানা যে যন্ত্রটি উদ্ভাবন করলেন তা পাটের সেলুলোজ দিয়ে স্যানিটারি প্যাড তৈরি করতে সক্ষম। এর মাধ্যমে আরও সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব স্যানিটারি প্যাড তৈরি করা যাবে, যা বাংলাদেশের নারীদের মাসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষায় ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ড. মোবারক আহমেদ খানের সহযোগিতায় আইসিডিডিআরবি’র গবেষক ফারহানা সুলতানা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে পাটের সেলুলোজভিত্তিক ডিসপোজেবল প্যাড তৈরির জন্য তার যন্ত্রটিতে পরীক্ষা চালিয়েছেন। এ প্যাডটি বাংলাদেশের নারী ও মেয়েদের মাসিকের স্বাস্থ্য এবং পরিচ্ছন্নতার জন্য একটি বিকল্প সমাধান। পাটের সেলুলোজ একটি নতুন উপাদান এবং দেশে বর্তমানে এমন প্যাড বানানোর কোনো ধরনের মেশিন নেই, যা দিয়ে প্যাড উৎপাদন করবে। এএসটিএমএইচের এই প্রতিযোগিতার পুরস্কার হিসেবে ৫ হাজার মার্কিন ডলার পাবেন ফারহানা। ২০২২ সালে এই প্রতিযোগিতার পরবর্তী আসরে বিচারকের ভূমিকা পালন করবেন তিনি।

জানা গেছে, পুরস্কারের অর্থ দিয়ে বিজ্ঞানী ফারহানা আরও বেশি সংখ্যক প্যাড উৎপাদনের জন্য পরীক্ষা চালাবেন। একই সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে এটি উৎপাদনের পরিকল্পনাও রয়েছে তার। নিজের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করবেন, পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে চালাবেন গবেষণা।

এবারের এই ইনোভেশন পিচ প্রতিযোগিতার প্রতিপাদ্য ছিল- মহামারী ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় স্বাস্থ্যসম্মত বিশ্ব সম্প্রদায়।

এর আওতায় মহামারী মোকাবিলা করে ফের সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলা- এই দুটি হুমকি মোকাবিলাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে এই প্রতিযোগিতায় এমন সব সরঞ্জাম ও পদ্ধতি বেছে নেওয়া হয়েছে যা এই দুটি হুমকির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একটি স্বাস্থ্যকর ও টেকসই বিশ্ব গড়তে ভূমিকা রাখবে।

প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে পাট দিয়ে প্যাড তৈরি প্রকল্পের জন্য ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের পক্ষ থেকে ১ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ৮৪ লাখ টাকা) মূল্যমানের পুরস্কার জিতেছিলেন ফারহানা সুলতানা। এক গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন, বাজারে বাণিজ্যিকভাবে যেসব স্যানিটারি প্যাড বিক্রি হয়, তাতে ৩ দশমিক ৪ গ্রাম প্লাস্টিক থাকে। সারা জীবন একজন নারী প্যাড ব্যবহার করলে প্লাস্টিকের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৩ কিলোগ্রাম। এটি মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ৫০০ থেকে ৮০০ বছর সময় লাগতে পারে।

মাসিকের কারণে বাংলাদেশের স্কুলছাত্রীদের ক্লাসে অনুপস্থিতির তথ্য নিয়ে ২০১৮ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে ‘মেন্সট্রুয়াল হাইজিন ম্যানেজমেন্ট অ্যামং বাংলাদেশি অ্যাডলোসেন্ট স্কুল গার্লস অ্যান্ড রিস্ক ফ্যাক্টরস এফেক্টিং স্কুল অ্যাবসেন্স : রেজাল্টস ফ্রম আ ক্রস-সেকশনাল সার্ভে’ শীর্ষক নিবন্ধে বলা হয়, মাসিকের কারণে দেশের ৪১ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী মাসে গড়ে প্রায় তিন দিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। প্রায় ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থীই মাসিকের সময় স্কুলে অস্বস্তিতে ভোগে। ফারহানা সুলতানা জানান, দেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট উন্নত নয়।  বাজারে যেসব প্যাড বিক্রি হচ্ছে, তার বেশির ভাগই পরিবেশবান্ধব নয়। ফলে, ব্যবহৃত প্যাড নিয়ে এক ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।  তাই তিনি পরিবেশবান্ধব স্যানিটারি প্যাডের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর