শনিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা
অনুপ্রেরণীয়

বদলে যাওয়া বেদেদের সঙ্গী হাবিবুর রহমান

আবদুল কাদের

বদলে যাওয়া বেদেদের সঙ্গী হাবিবুর রহমান

হাবিবুর রহমান

বিচিত্র জাতি বেদেরা। ধর্মে ইসলাম, আচারে পুরা হিন্দু। যাযাবর জীবনযাপনই এদের ঐতিহ্য। প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ নারী-পুরুষ ভাসমান জীবনযাপনে অভ্যস্ত। কথিত আছে, তাদের আদি গোষ্ঠী আরাকান রাজ্যের মনতং আদিবাসী গোত্রের দেশত্যাগী অংশ। জীবিকার তাগিদে এরা ঘুরে বেড়ায় গ্রামে, শহরে ও বন্দরে। সাধারণ মানুষকে দেখিয়ে থাকে সাপ-বানরের খেলা, জাদুবিদ্যাসহ নানাবিধ অদ্ভুত কাজ। বেদেদের জীবনযাপন, আচার-আচরণ এবং সংস্কৃতি সাধারণ মানুষের থেকে অনেকটাই আলাদা। বেদেরা মূলত নৃগোষ্ঠী। বাইদ্যা নামে এরা সর্বাধিক পরিচিত। ইতিহাসবিদের মতে, ১৬৩৮ সালে শরণার্থী আরাকানরাজ বলালরাজের সঙ্গে মনতং জাতির যে ক্ষুদ্র অংশ বাংলাদেশে প্রবেশ করে তারা আশ্রয় নেয় বিক্রমপুরে। পরবর্তীতে এরা ছড়িয়ে পড়ে মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, শেরপুর, বগুড়াসহ দেশের প্রায় ৫৩ জেলায়। এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামেও দেখা মেলে বেদে জনগোষ্ঠীর। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৭.৮০ লাখ বেদে জনগোষ্ঠী রয়েছে। বেদেরা শতকরা ৯০ ভাগই নিরক্ষর। উপার্জনের ক্ষেত্রে বেদেরা নারীনির্ভরশীল। তবে সম্প্রদায়ভিত্তিক পেশার ক্ষেত্রে এরা নারী-পুরুষ মিলেই উপার্জন করে থাকে। বেদেরা ঝাড়ফুঁক, শিঙা লাগানো, তাবিজ-কবচ বিক্রি করা, জাদুটোনা, সাপ ধরা, সাপের খেলা, বাঁদরের খেলা দেখিয়ে উপার্জন করে থাকে। তবে তাদের সংখ্যা অনেক কম। কালের বিবর্তনে মানুষ এসবে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে বলে তারা নিজেদের পেশায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে। তবে শিক্ষার অভাব, আধুনিক নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত হওয়ায় পিছিয়ে পড়ছে দেশের প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠী। তাদের অনেকে আজ পার করছে মানবেতর জীবন।

শিক্ষার অভাব, আধুনিক নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত হওয়ায় পিছিয়ে পড়ছে দেশের প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠী। তাদের অনেকে আজ পার করছে মানবেতর জীবন

অবহেলিত এসব বেদে জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারায় উঠিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন একজন মানবিক পুলিশ অফিসার। নাম হাবিবুর রহমান। পেশায় তিনি পুলিশের ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি (উপ-মহাপরিদর্শক)। ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার থাকাকালীন তিনি লক্ষ্য করেন বেদেরা জড়িয়ে পড়ছে অপরাধমূলক পেশায়। সে সময় অনেকটা ব্যক্তি উদ্যোগে অবহেলিত বেদে সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়ান হাবিবুর রহমান। অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘উত্তরণ ফাউন্ডেশন’। ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘২০১৪ সালে সাভারের বেদেপল্লীতে মাদকবিরোধী অভিযান চালানোর সময় পুলিশের কাছে বেদেরা অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। তখন থেকে বেদে পল্লীর পুনর্বাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আয়োজিত বিভিন্ন সভায় বেদে প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের রীতি চালু করি। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর জন্য পুনর্বাসন, উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে সম্পৃক্ত করার জন্য বিভিন্ন কাজ করে চলেছি। তাদের সন্তানদের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শিক্ষালয়। এই শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে শিক্ষা উপকরণ যেমন স্কুলব্যাগ, খাতা-বই-কলম, টিফিন বক্স, দুধের ফিডারসহ নানা ধরনের উপকরণ তুলে দেওয়া হচ্ছে।’ হাবিবুর রহমান পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে জানতে পারেন তাদের স্বতন্ত্র ভাষা সম্পর্কে। ভাষাটির নাম ‘ঠার’ বা ‘ঠেট’ বা ‘থেক’ ভাষা। ২০২২ জাতীয় বইমেলা উপলক্ষে ‘ঠার’ ভাষাভাষীদের নিয়ে বই লেখেন ডিআইজি হাবিবুর রহমান। বইটির নাম ‘ঠার’, বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা।

ডিআইজি হাবিবুর রহমান ব্যক্তি উদ্যোগে বেদেদের পুনর্বাসন এবং বিলুপ্ত প্রায় ‘ঠার’ ভাষার গবেষণার কাজ করেন। দীর্ঘ এই গবেষণা যাত্রায় তাকে তথ্যউপাত্ত সংগ্রহে ঘুরতে হয়েছে জেলায় জেলায়। দীর্ঘ আট বছর মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় তাকে সাহায্য করেন তার সহকর্মীরাও। গ্রন্থটি তথ্যসমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন গুণগ্রাহী ব্যক্তিবর্গ। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে বসবাসরত বেদে জনগোষ্ঠীর ঠারভাষী প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকার ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে ঠার ভাষাবিষয়ক এক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। ওই সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও সাবেক চেয়ারম্যান ও চীনের ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান এবং সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল মনসুর আহমেদ। উপস্থিত অতিথিদের সামনে ঠারভাষী প্রতিনিধিদের সম্মতিক্রমে ভাষাটির শব্দ, উচ্চারণ, বাক্যগঠন এবং ব্যাকরণ ইত্যাদি যাচাইবাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ‘বইমেলা ২০২২’-এ বইটি ‘ঠার’ ভাষা বইটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়।  বইটি মেলায় পাওয়া যাচ্ছে। অবহেলিত বেদে সম্প্রদায়ের পাশাপাশি হিজড়া জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনেও নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন পুলিশের এ কর্মকর্তা। তাদের জন্য গড়ে তুলেছেন বুটিক, পারলারসহ নানা প্রতিষ্ঠান।

সর্বশেষ খবর