শনিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা
মোহাম্মদ আলীর মহানুভবতা

ক্যান্সার রোগীদের দান করলেন সারা জীবনের সঞ্চয়

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

ক্যান্সার রোগীদের দান করলেন সারা জীবনের সঞ্চয়

সঞ্চয়ের টাকা রোগাক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা ব্যয় বহনের জন্য মনস্থির করেন। পরে একটি ব্যাংকে ওয়াকফ হিসাব খুলে ৫০ লাখ টাকা জমা করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির নামে...

আজ থেকে ২০ বছর পর আমি বেঁচে থাকব না। কিন্তু আমার দান করা টাকায় অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের শিশু সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে।  এ চিত্র দেখে আমার আত্মা শান্তি পাবে - মোহাম্মদ আলী

আশি বছর বয়স্ক কাজী মোহাম্মদ আলী। ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে পেশা শুরু করা এ ব্যক্তিকে কয়েক দিন আগেও গন্ডির বাইরে কেউ চিনত না। অথচ মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। তাঁর কর্মকান্ড মানবিক কাজের দৃষ্টান্ত হিসেবেও মনে করা হচ্ছে। এক সময় পেশার সুবাদে নিয়মিত যাতায়াত ছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তখন কাছ থেকেই দেখেছেন অসহায় ও গরিব রোগীদের টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে না পারার দুঃখকষ্ট। রোগীদের এ অসহায়ত্ব দেখে পণ করলেন তাদের জন্য কিছু করার। গাড়ি ভাড়া, নাশতা কিংবা নিজের শৌখিনতা বিসর্জন দিয়ে এক এক করে সঞ্চয় করতে থাকেন টাকা। শুরুতে মাটির ব্যাংক ও টিনের পটে রাখলেও টাকার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় খোলেন ব্যাংক হিসাব। ৪১ বছরে ওই ব্যাংক হিসেবে জমা হয় ৫০ লাখ টাকা। যা তিনি দান করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল রোগী কল্যাণ সমিতিতে। এ টাকার লভ্যাংশ থেকে অসহায় ও গরির ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করা হবে।

মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমার পেশা শুরু হয় ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে। চিকিৎসকদের সঙ্গে দেখা করতে নিয়মিত যেতে হতো হাসপাতালে। টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে না পারার চিত্র দেখেছি অসংখ্য। তা দেখে বিবেক দংশন করত। টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে না পারা রোগীদের জন্য কিছু করার চিন্তা থেকেই সঞ্চয় শুরু করি। আমার সঞ্চয়ে ৫০ পয়সা যেমন রয়েছে, তেমনি ইনসেনটিভ ও নাশতার টাকাও রয়েছে। ৪১ বছরে ৫০ লাখ টাকা সঞ্চয় করে রোগী কল্যাণ সমিতিকে দান করেছি।’ তিনি বলেন, ‘আজ থেকে ২০ বছর পর আমি বেঁচে থাকব না। কিন্তু আমার দান করা টাকায় ১৮ বছরের শিশু সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে। এ চিত্র দেখে আমার আত্মা শান্তি পাবে।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল রোগী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক অভিজিত সাহা বলেন, ‘আলী সাহেব এসে যখন ৫০ লাখ টাকা দান করার কথা বলেন, তখন শিহরিত হয়ে উঠি। তা বিশ্বাস করতেই পারিনি। তাঁর এ দান অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন ধনাঢ্য না হয়েও কীভাবে সঞ্চয় করে অসহায় রোগীদের জন্য বড় অবদান রাখা যায়।’

চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বিএসসি পাস করার পর মোহাম্মদ আলী ১৯৬৬ সালে ফাইজার ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। পেশাগত কারণে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হতো নিয়মিত। এসময় অসহায় দরিদ্র রোগীদের টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে না পারার চিত্র তার হৃদয়কে পীড়া দিত। তাই নিজের বেতনের একটি অংশ দিয়ে রোগীদের ওষুধ কিনতে সাহায্য করতেন। ১৯৮০ সালে তাঁর মাথায় এলো অন্য চিন্তা। অসহায় রোগীদের জন্য বড় কিছু করার চিন্তা থেকে সঞ্চয় ুকরা শুরু করলেন। শুরুতে মাটির ব্যাংক ও টিনের কোটায় টাকা জমাতেন। ইনসেনটিভ, যাতায়াত এবং চা-নাশতার মিতব্যয়ী হয়ে সেই টাকা সঞ্চয় করতে থাকেন ঘরের ব্যাংকে। ২০০০ সালে সঞ্চয়ের ২০ বছরের মাথায় টাকার অংক বড় হলে পিতা-মাতার নামে ‘কাজী অ্যান্ড হোসনে ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ব্যাংক হিসাব খোলেন। এরই মধ্যে জমানো টাকা বৃদ্ধির জন্য অন্য পন্থা অবলম্বন শুরু করেন। ব্যাংক মুনাফার হারে সঞ্চয়ের টাকা থেকে মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়া শুরু করলেন। মুনাফাসহ ওই টাকা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাবে জমা রাখতেন।

এরই মধ্যে সারা জীবনের সঞ্চয়ের টাকা কী করা যায় তা নিয়ে ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শ করেন। তাদের কেউ এ টাকা মাদরাসা ও এতিমখানায় দান করতে পরামর্শ দিলেও মোহাম্মদ আলী চিন্তা করলেন ভিন্ন কিছু। সঞ্চয়ের সেই টাকা রোগাক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা ব্যয় বহনের জন্য মনস্থির করেন। পরে একটি ব্যাংকের ওয়াকফ হিসাব খুলে ৫০ লাখ টাকা জমা করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির নামে। জমানো সেই অর্থ থেকে বছরে চার লাখ টাকা মুনাফা পাবে রোগী কল্যাণ সমিতি। যা ১৮ বছরের কম বয়সী ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার জন্য ব্যয় হবে।

সারা জীবনের সঞ্চয়ের টাকা ক্যান্সার রোগীর পেছনে ব্যয় করার রয়েছে নেপথ্য কারণ। এ নিয়ে মোহাম্মদ আলী বলেন, ৪০ বছর আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন নিজের মা হোসনে আরা বেগম। চার-পাঁচ বছর আগে মারা যান তার ভাগনি নাহিদা সোমা। একই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তার কয়েকজন নিকটাত্মীয়। তাই ক্যান্সার নিরাময়ের জন্য সঞ্চয়ের টাকা দান করার মনস্থির করেন।

মোহাম্মদ আলীর গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়ির ফরহাদাবাদ হলেও বসবাস করেন নগরীর মুরাদপুরের হামজারবাগ এলাকার পৈতৃক বাড়িতে। একতলা বাড়িতে দুই ছেলে ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে বসবাস করেন। ২০০৫ সালে তিনি রেনেটা লিমিটেডের সেলস ম্যানেজার হিসেবে অবসরে যান।

সর্বশেষ খবর