শনিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

মাঠ গড়ার শিল্পী ইয়াহিয়া

রাশেদুর রহমান

মাঠ গড়ার শিল্পী ইয়াহিয়া

ভারতের পাতিয়ালায় অবস্থিত নেতাজি সুভাষ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটের সবুজ মাঠে বসে প্রায়ই সময় কাটাতেন মোহাম্মদ ইয়াহিয়া। আশির দশকের শুরুর দিকে তিনি বাংলাদেশ সরকারের বৃত্তি নিয়ে সেখানে প্রশিক্ষণ নিতে যান। সে সময় ভারতীয় কিংবদন্তি অ্যাথলেট পিটি ঊষা পাতিয়ালায় অনুশীলন করতেন। মাঠে বসে তাদের অনুশীলন দেখতে দেখতে স্বপ্নালু চোখে মনের ক্যানভাসে এক সুন্দর বাংলাদেশের ছবি আঁকেন ইয়াহিয়া।  ঢাকাতেও একদিন গড়ে উঠবে আন্তর্জাতিকমানের মাঠ। তারপর তার দেখাদেখি দেশের প্রতিটি জেলায় শুরু হবে এক মহাকর্মযজ্ঞ। একের পর এক দৃষ্টিনন্দন মাঠ গড়ে উঠবে। সেসব মাঠে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিশ্বসেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে গড়ে উঠবে তরুণ-তরুণীরা। বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্সে অবস্থিত বসুন্ধরা কিংস অ্যারিনার সবুজ মাঠে বসে প্রায় চার দশক আগে দেখা স্বপ্নের কথা বলছিলেন ইয়াহিয়া।

বাংলাদেশে নানা রকম শিল্পীর ভিড়। তবে ইয়াহিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের এক শিল্পকে বেছে নেন। মাঠ তৈরির শিল্পী হয়ে ওঠেন তিনি। যে মাঠে খেলে ভবিষ্যতের তারকা হয়ে উঠেছেন অনেকেই। ধানমন্ডিতে শেখ জামালের মাঠ তারই হাত দিয়ে তৈরি হয়। গোপীবাগে ব্রাদার্সের মাঠ, মিরপুর স্টেডিয়ামের ঘাসের মাঠ, কমলাপুরের ঘাসের মাঠ, ফতুল্লার ঘাসের মাঠ, আশুলিয়ায় অবস্থিত ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ, রহমতগঞ্জের মাঠ, নারায়ণগঞ্জে জিমখানা মাঠসহ দুটি এবং কুমিল্লা স্টেডিয়ামের মাঠসহ আরও কয়েকটি মাঠ গড়ার শিল্পী ইয়াহিয়া।

যে কোনো খেলার মাঠ তৈরির পদ্ধতি বেশ কঠিন ও শ্রমসাধ্য বিষয়। এ শিল্প সম্পর্কে পুঁথিগত বিদ্যা থাকলেই হয় না। প্রয়োজন পড়ে হাতে-কলমের অভিজ্ঞতাও। পাতিয়ালাতে থাকাবস্থায় মাঠকর্মীদের কাজ গভীর মনোযোগে দেখতেন ইয়াহিয়া। বিভিন্ন বিষয় নোটবুকে টুকেও রাখতেন। একটা মাঠ তৈরির জন্য কয়েকটা ধাপ অনুসরণ করতে হয়। প্রথম ধাপে বালির স্তর দিতে হয়। এরপর জিও এবং ছিদ্রযুক্ত পাইপ ব্যবহার করা হয়। ক্রমান্বয়ে আরও ব্যবহার করা হয় জিও, স্টোন চিপস, মাটি ও মিক্সড সয়েল। এসব ব্যবহার করে মাঠ গঠনের পর উপযোগী ঘাস রোপণ করতে হয়। ইয়াহিয়া বলেন, ‘বিভিন্ন স্থান থেকে দূর্বা ঘাস খুঁজে এনে রোপণ করেছি আমরা। এই মাঠে ইনজুরির কোনো ভয় নেই। ফুটবলাররা পড়ে গেলেও নরম ঘাসে তাদের কোনো ক্ষতি হবে না।’ এখানেই শেষ নয়। মাঠ তৈরির পর নিয়মিত যত্ন নেওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় নানা রকমের যন্ত্রপাতি এবং মানুষের ঘাম ঝরানো শ্রম। মাটির গভীরে থাকা ঘাসের শিকড়ে অক্সিজেন পৌঁছার জন্য প্রায়ই কাঁটাযুক্ত মেশিন ব্যবহার করা হয় মাঠে। ছয় থেকে সাত ইঞ্চি মাটির গভীরে পৌঁছে যায় অক্সিজেন। এতে ঘাস ভালো থাকে। এভাবেই দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রমে মাঠের যত্ন নিতে হয়।

ইয়াহিয়া দীর্ঘদিন ধরেই স্বপ্নের মাঠ তৈরি করার চেষ্টা করছিলেন। শতভাগ সুযোগ এসে ধরা দেয় বসুন্ধরা কিংস অ্যারিনায়। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের আগ্রহ ও সহযোগিতায় ইয়াহিয়া তৈরি করেন আন্তর্জাতিকমানের দৃষ্টিনন্দন ফুটবল মাঠ। যে মাঠ দেখে জাতীয় দলের স্প্যানিশ কোচ হাভিয়ের কাবরেরাও অভিভূত হয়েছেন। প্রতিপক্ষের ফুটবলাররা এ মাঠে খেলার পর ইয়াহিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে যান। ইয়াহিয়া বলেন, ‘বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেবের সদিচ্ছা ও সবরকম সহযোগিতায় বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্সে এমন মাঠ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। আমাকে এমন একটা মাঠ তৈরির সুযোগ দেওয়ার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই।’ ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে উঠছে বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্স। এখানে ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির পাশাপাশি থাকছে নানা খেলার আয়োজন।

চল্লিশ বছর আগে দেখা ইয়াহিয়ার স্বপ্ন বসুন্ধরা কিংস অ্যারিনার মাধ্যমে এখন অনেকটাই বাস্তবে রূপ নিয়েছে। তবে এখানেই থেমে থাকতে চান না তিনি। সময় ও সুযোগ পেলে এমনই আরও মাঠ তৈরির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে চান। যেসব মাঠে ভবিষ্যতের বিশ্বসেরা তারকা খেলোয়াড় তৈরি হবে।

মাঠ গড়ার শিল্পী হওয়ার আগে ইয়াহিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া পরিচালক ছিলেন। বিমল চন্দ্র তরফদার এবং সাবেক দ্রুততম মানব মাহবুবদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। এখন ৬৪ বছর বয়সী ইয়াহিয়ার স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ তারকা হওয়ার মতো উপযোগী মাঠ ও পরিবেশ তৈরি করা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর