শনিবার, ২১ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

শিক্ষক থেকে সফল কৃষি উদ্যোক্তা

সৈয়দ নোমান, ময়মনসিংহ

শিক্ষক থেকে সফল কৃষি উদ্যোক্তা

বাবার মতো এক সময় সেনা কর্মকর্তা হতে চেয়েছিলেন। তবে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ছোটবেলা থেকে কৃষির প্রতি ঝোঁক ছিল তার। সেই আগ্রহ থেকেই শিক্ষাজীবনে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেও এখন তিনি একজন কৃষি উদ্যোক্তা। তার নাম ড. আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্স। ডক্টরেট ডিগ্রিধারী এই ব্যক্তি বর্তমানে আলোচনায় এসেছেন ফেসবুকে নিজের একটি ছবি ভাইরাল হওয়ার মাধ্যমে। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নে বাবুলের বাজারে নিজের খামারে উৎপাদিত কচুর লতি বিক্রি করছিলেন তিনি। সেই মুহূর্তের ছবি ভাইরাল হয় ফেসবুকে। এরপর থেকেই সাইবার দুনিয়ায় ঘুরতে থাকে সেই ছবি। আর সেখানেই তাকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন নেটিজেনরা।

তবে ভাইরাল হওয়ার বিষয়টি নিয়ে শুরুতে তিনি অনেকটাই বিব্রত ছিলেন। অবশ্য অগণিত মানুষের বিপুল ভালোবাসা আর উৎসাহে একটা পর্যায়ে ড. প্রিন্স বিষয়টিকে উপভোগ করছেন। ভাইরাল হওয়ার পেছনের গল্পটিও তিনি জানিয়েছেন এই প্রতিবেদকের কাছে। তিনি বলেন, সেদিন আমার খামারের জন্য কিছু বাজার করার কথা। এমন সময় আমাকে বাজারের কথা বলা হয়েছিল যখন হাতে টাকা ছিল না। ঠিক করি কচুর লতি বিক্রি করে সন্ধ্যায় বাজার করব। যে লোক আমার এই লতিগুলো বিক্রি করে দেন সেদিন তিনি কাজে আসেননি। সন্ধ্যার পর বাজার যেহেতু করতেই হবে তাই কচুর লতি নিয়েই বাজারে যাই। ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি। তখন অনেকেই আমার ছবি তুলে। পরে খামারের জন্য বাজার করে বাড়ি ফিরি। এরপর ফেসবুকে লতি বিক্রির ছবি দেখি। কিছু সময়ের মধ্যেই একজনের ওয়াল থেকে আরেকজনের ওয়ালে ছড়িয়ে পড়ে ওই ছবি। একটা ছবি এরকম আলোড়ন ফেলবে আমি বুঝতে পারিনি। বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন আসে। অনেকেই জানতে চাচ্ছে আমি কী করি? আমার খামারে কী কী পাওয়া যায়? নানান কথা জানতে চেয়ে মানুষ ফোন করে। সবার সঙ্গেই প্রায় একই রকম কথা বলতে হচ্ছে। জানা যায়, ড. প্রিন্সের আদি নিবাস ঝালকাঠি জেলার রাজাপুরে। বর্তমান ঠিকানা গাজীপুরে। তিনি মিরপুরের রোটারী হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও আদমজী ক্যান্টনমেন্ট থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ২০০২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর, ২০০৮ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (এআইইউবি) থেকে অ্যাগ্রি বিজনেসের ওপর এমবিএ করেন। এরপর ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন।

ড. প্রিন্স জানান, যখন তিনি স্কুলে পড়তেন তখন মাকে দেখতেন বাড়ির সামনে লাউ-শিমসহ বিভিন্ন শাক-সবজির গাছ লাগাতে। তখন থেকেই মূলত কৃষির প্রতি তার আগ্রহ জন্মে। তারপর ২০০৬ সালে ভারতের পাঞ্জাবে গিয়েছিলেন একটি প্রশিক্ষণ নিতে। সেখানকার কৃষিব্যবস্থা দেখে আরও আকৃষ্ট হন কৃষিকাজের প্রতি। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি এলাকা ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের হাতিলেইট গ্রামটি ভালো লেগে যায় প্রিন্সের। যেহেতু আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল কৃষি ভিত্তিক কোনো ব্যবসা করবেন তাই এ এলাকাতেই ২০১৪ সালে ‘কৃষাণ সমন্বিত কৃষি উদ্যোগ’ নামে খামার করে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ শুরু করেন ড. প্রিন্স।

অন্যরা যখন উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে ভালো চাকরি করছেন তখন গ্রামে এসে কৃষির উৎপাদন ভিত্তিক ব্যবসা বেছে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে ড. প্রিন্স বলেন, এটা যে শুধু নিতান্তই শখের বসে তা কিন্তু নয়। আমার মন ও মগজে রয়েছে কৃষি, অর্থাৎ এটিই আমার এখন ধ্যান-জ্ঞান। আমি মনে করি, পরিকল্পিতভাবে আধুনিক উপায়ে খামার ব্যবস্থাপনা করা গেলে এখানে ব্যবসা রয়েছে। প্রশিক্ষিত একজন কৃষক সাধারণ কৃষকের চেয়ে অনেক বেশি ফসল ফলাতে পারে। আধুনিক কৃৃষিকাজে মেধাও অনেক প্রয়োজন। আমি ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারমুক্ত কৃষি পণ্য উৎপাদন করি। কারণ যখন চারদিকে ভেজালের পরিমাণ বাড়বে তখন খাটি পণ্যের গুরুত্ব বাড়বে। মানুষ খুঁজে খুঁজে ভালো পণ্য কিনতে চাইবে। তাই এই সেক্টরে ব্যবসার সুযোগ রয়েছে।

২০১৪ সালে নিজের কেনা সাড়ে তিন একর জায়গায় ২২ হাজার ৫০০ টাকার গাছের চারা রোপণ করে শুরু করেছিলেন কৃষি খামার। পরে ধীরে ধীরে গাছের সংখ্যা বাড়াতে থাকেন। সঙ্গে ধানের জমিও ছিল। প্রথমে নিজের পুঁজি ও ধার-দেনা করলেও পরবর্তীতে ব্যাংক লোন নিয়ে এগিয়ে যান তিনি। বর্তমানে প্রায় সাত একর জায়গায় ধান, সরিষা, ড্রাগন ফল বাগানে তিন প্রজাতির ৫ হাজার গাছ আছে। আছে মাহালিশা, কিউজাই, ব্রুুনাই কিং, বাউ-৪, কাঁচামিঠা, তাইওয়া গ্রিন, কাটিমন, পালমার, মল্লিকাসহ ১০ প্রজাতির আম, এভোক্যাডো, চায়না থ্রি, মঙ্গলবারিসহ তিন প্রজাতের লিচু, মিসরীয় শরিফা, স্ট্রবেরি, চেরি, থাই পেয়ারা, আম, লেবু, জাম্বুরা, মাল্টা, সফেদা, আতাফল, কদবেল, আমলকী, ডেউয়া, ডুমুর, কাঠবাদাম, জামরুল, থাই জাম্বুরা, লটকন ও কলাগাছ। দেশি-বিদেশি ৫ হাজার ফলগাছের একটি নার্সারি রয়েছে বাগানে।

কৃষির পাশাপাশি ড. প্রিন্স ২০২১ সাল থেকে বরিশাল ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ও মার্কেটিং বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।  খামারে সময় দেওয়ার জন্য বছরে ছয় মাস ছুটি নেন তিনি। আর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে বেতন তিনি পান তা অর্থ সংকটে থাকা শিক্ষার্থীদের সহযোগিতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে দিয়ে দেন।

সর্বশেষ খবর