শনিবার, ১৮ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

ইউপি সদস্য খোদেজা খাতুনের ব্যতিক্রমী জীবন সংগ্রাম

দিনে পারিশ্রমিক পান ১৫০ টাকা, সঙ্গে দুই বেলা খাওয়া, থাকেন টিনের চালা ঘরে

আবদুস সামাদ সায়েম, সিরাজগঞ্জ

ইউপি সদস্য খোদেজা খাতুনের ব্যতিক্রমী জীবন সংগ্রাম

হোটেলে বাসন ধোয়া, মাছ-তরকারি কাটা ও মসলা বাটার কাজ করেন খোদেজা

মোছা. খোদেজা খাতুন। তিনি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বারুহাস ইউনিয়নের ৩ নম্বর সংরক্ষিত আসনের (৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড) দুবারের নির্বাচিত ইউপি সদস্য। একজন জনপ্রতিনিধি হয়েও তিনি হোটেলে বুয়ার কাজ করে সংসার চালান। তাঁর স্বামী আবু তাহের একজন পান দোকানদার। স্বামীর নামে একটি ভিজিডি কার্ড ছিল। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পর সেই কার্ডটি অন্যকে দিয়ে দেন। তাঁর সততায় মুগ্ধ ইউনিয়নবাসী। এলাকার মানুষের কাছে তিনি সততার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তিনি বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। চিকিৎসার অর্থ নেই। ইউপি চেয়ারম্যানসহ কতিপয় হিতৈষী ব্যক্তির সহায়তায় চলছে তাঁর চিকিৎসা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাড়াশ উপজেলার বিনসাড়া গ্রামে তার পৈতৃক বাড়ি। বাবার নাম কেতাব আলী। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী খোদেজা খাতুনের জন্ম ১৯৫২ সালের ২০ নভেম্বর। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার বড় খোদেজা ছোটবেলায় গ্রামের স্কুলে পড়ালেখা শুরু করলেও তা আর এগোয়নি। অভাবের সংসারে কাজ করতেন অন্যের বাড়িতে। একসময় রাস্তায় মাটি কাটার কাজও করেন। স্বাধীনতার তিন বছর পর পার্শ্ববর্তী খুটিগাছা গ্রামে আবু তাহেরের সঙ্গে বিয়ে হয়। দরিদ্র সংসারে স্বামীর সামান্য জমি থাকায় সেটুকু দুজনে মিলে চাষাবাদ শুরু করেন। এরই মধ্যে তাঁদের পর পর তিন সন্তানের জন্ম হয়। সন্তানের ভরণপোষণ দুঃসাধ্য হয়ে পড়ায় জমি বিক্রি করে স্বামী-সন্তান নিয়ে বাবার বাড়ি বিনসাড়ায় চলে আসেন। সেখানে বাজারের পশ্চিম পাশে মনিপুকুরপাড়ে সরকারি খাসজমিতে এক কক্ষের একটি টিনের ঘর তোলেন। স্বামী আবু তাহের বিনসাড়া বাজারে একটি পানের দোকান শুরু করেন। অভাবের সংসারে হাল ধরতে খোদেজা শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। মানুষের জমিতে কাজ করে যা পেতেন তাই দিয়ে সংসার চালাতেন। তিন সন্তান বড় হওয়ার পর বিয়ে করে প্রায় ২০ বছর আগে সবাই আলাদা হয়ে যান। সততার সঙ্গে এবং বিপদ-আপদে অর্থ দিয়ে না হলেও সহানুভূতির সঙ্গে পাশে থাকায় মানুষের কাছে প্রিয় মানুষ হয়ে ওঠেন। কখনো শ্রমিক আবার কখনো হোটেলের বুয়ার কাজ করা অবস্থায় এলাকাবাসীর অনুরোধে সংরক্ষিত আসনে নির্বাচন করেন। প্রথমবার ফেল করেন। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে নির্বাচনে তিনি ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হলেও তাঁর কোনো আর্থিক মোহ ছিল না। যখন ইউনিয়ন পরিষদে কাজ থাকে- যান। বর্তমানে খোদেজার বয়স প্রায় ৭০। বয়স হলেও জনপ্রতিনিধি ও সংসারের দায়িত্ব তাঁকে কাবু করতে পারেনি। এ বয়সেও তিনি সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রায় ৭ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে তাড়াশ বাজারের হোটেলে বুয়ার কাজ করতে যান। হোটেলে কাজ করে যে ১৫০ টাকা পান আর স্বামী পান বিক্রি করে যা পান তা দিয়ে এ দম্পতি সংসার চালিয়ে যান। বর্তমানে তাঁদের বসবাসের ঘরটিও নড়বড়ে। টিনের চালা ঘরের চালে ফুটো, বেড়াগুলো নষ্ট ও মাটির মেঝের ঘরটিতে গরম-শীত সব ঋতুতেই কষ্ট হয়। নেই স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের ব্যবস্থা।

খোদেজা খাতুন জানান, আমার এলাকার লোকজন আমাকে ভালোবেসে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। তারা যখন যে কাজে ডাক দেয় আমি ছুটে যাই। সরকারি যত সুবিধা পাই, তা গরিব মানুষের মধ্যে বণ্টন করে দিই। আর নিজের সংসার চালানোর জন্য হোটেলে কাজ করি। প্রতিদিন দুই বেলা খাবার ও ১৫০ টাকা করে পাই। তিনি জানান, যখন পরিষদে কাজের ডাক পড়ে তখন ছুটি নিয়ে সেখানে চলে যাই। হাসপাতাল বেডে শুয়ে থেকে তিনি জানান, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যেন মানুষ ভালোবেসে যে দায়িত্ব দিয়েছে তা সততার সঙ্গে পালন করতে পারি।

 

দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে

খোদেজার ছেলে হাফেজ খিজির জানান, গত রবিবার হোটেলের কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে মা উপজেলার আসানবাড়ি এলাকায় একটি ব্যাটারিচালিত ভ্যান থেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন। স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগে ভর্তি করা হয়। তিনি মাথায়, হাতের কবজিসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত পেয়েছেন। তিনি জানান, হাতে চিকিৎসার টাকা নেই। ইউপি চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন হিতৈষী ব্যক্তি হাসপাতালে দেখতে গিয়ে যা সহায়তা  করছেন তা দিয়েই চিকিৎসা চলছে।

সর্বশেষ খবর