শনিবার, ১৬ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া শতবর্ষী কছিরের গল্প

বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ

বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া শতবর্ষী কছিরের গল্প

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ব্রিটিশ বাহিনীর হয়ে অংশ নেওয়া নওগাঁ সদর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের নগর কুসুম্বি গ্রামের মৃত রসুল্লা আকন্দের ছেলে কছির উদ্দিন আকন্দের বয়স প্রায় ১০০ ছুঁইছুঁই। ১৯২৫ সালে জন্ম নেওয়া এ বৃদ্ধকে দেখে বোঝার উপায় নেই পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহতম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীর সৈনিক তিনি। বীরত্বের জন্য বেশকিছু পদকও পেয়েছেন। যুদ্ধের ভয়াবহতার প্রত্যক্ষদর্শী কছির উদ্দিন আকন্দ পরে চাকরি ছেড়ে বেসামরিক জীবনে ফিরেও এসেছিলেন। পরিবার ও স্থানীয়দের দাবি, এলাকায় কছির উদ্দিনের নামে এমন কিছু তৈরি করা হোক যার মাধ্যমে কছির উদ্দিন প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন। কছির উদ্দিন আকন্দ এখনো কারও সহায়তা ছাড়াই ঘরে-বাইরে চলাফেরা করতে পারেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন মসজিদে গিয়ে। চশমা ছাড়াই বাড়িতে কোরআন শরিফ ও পত্রিকা পড়ে সময় কাটে তাঁর। স্মরণশক্তিও আছে আগের মতো। জীবনের শেষ সময়ে এসে তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেতে চান। কছির উদ্দিন আকন্দ দেশ তথা নওগাঁর জন্য এক জীবন্ত গৌরব। তাই এই ব্রিটিশ সৈনিকের নামে এলাকায় এমন কিছু স্থাপনা নির্মাণ করা হোক যা দেখে বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম জানবে কছির উদ্দিন সম্পর্কে। কছির উদ্দিনের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর শুরু এবং ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক পক্ষে ছিল ব্রিটিশ, আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্য পক্ষে ছিল জার্মানি, জাপান ও ইতালি। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির হয়ে বিশ্বযুদ্ধে লড়াইকারী পূর্ববাংলার যুদ্ধফেরত নয়জন বাংলাদেশি সৈনিকের তথ্য পাওয়া যায়, যারা এখনো বেঁচে রয়েছেন। বিশ্বযুদ্ধে অবদান ও ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক সদস্য হিসেবে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ভাতা-সহায়তাও পাচ্ছেন তাঁরা। পিএনআর (পাইওনিয়ার কোর) কছির উদ্দিন আকন্দ এদের মধ্যে অন্যতম। পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশে যারা এখনো বেঁচে রয়েছেন তাঁরা হলেন- পিএনআর (পাইওনিয়ার কোর) কছির উদ্দিন আকন্দ, হাবিলদার সাবেদ আলী সরকার, ল্যান্স নায়েক আবদুল মান্নান, ল্যান্স করপোরাল সামছুদ্দিন, সৈনিক মতিয়ার রহমান, সৈনিক আবুল হোসেন, স্যাপার নূর মোহাম্মদ, ল্যান্স করপোরাল নূর মোহাম্মদ ও হাবিলদার নজির আহমেদ।

এক আলাপচারিতায় ব্রিটিশ সৈনিক কছির উদ্দিন আকন্দ জানান, ওই সময় আমার পরিবারে খুব অভাব ছিল। সংসারের অভাবের তাড়নায় ১৯৪৪ সালের ৫ মার্চ নওগাঁর তৎকালীন কালেক্টরেট চত্বরে এসে দেখি ব্রিটিশ বাহিনীর জন্য সৈনিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। লাইনে দাঁড়ানোর পর তিনি ব্রিটিশ বাহিনীর সৈনিক হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর সেখান থেকে কলকাতায় এক মাসের রাইফেল ট্রেনিংয়ের পর ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির পাইওনিয়ার (পিএনআর) পদে যুক্ত হন। বোম্বাইয়ে জাপানি বিমান হামলার পর বেশ কিছুদিন শহরটির পুনর্নির্মাণ কাজে অংশ নেন। এরপর পুনেতে সম্মুখযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁকে পাঠানো হয় বার্মায়। সেখানে বিশাল এবং ঘন অরণ্যে হিংস্র নানা জীবজন্তুর মধ্যে অত্যন্ত কষ্টকর দিন কেটেছে তাঁদের। সেখানে বাহিনীর অন্য সদস্যদের সঙ্গে কথা বলাও ছিল দুষ্কর। সেখানে আফ্রিকানসহ ১১ জাতির সৈন্য দিয়ে তাদের ইউনিটটি গড়ে তোলা হয়েছিল। প্রায় এক বছর জঙ্গল থেকে যুদ্ধ করার পর জাপানি বাহিনীকে দমনে সক্ষম হন তাঁরা। এরপর আত্মসমর্পণকারী কয়েক হাজার জাপানি সৈনিকসহ ব্রিটিশ বাহিনীর সৈনিকরা মিয়ানমার শহর পুনরায় গড়ে তোলার কাজে লেগে যান। আর এক মাসের ছুটি নিয়ে নওগাঁয় নিজ বাড়িতে চলে আসেন তিনি। ছুটি কাটানোর পর তিনি যোগ দেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। এরপর আবারও তাঁকে পাঠানো হয় বার্মায়। সেখানে জাপানি যুদ্ধবন্দিদের দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার পুনর্গঠন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘যুদ্ধে অংশগ্রহণের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৩৯-৪৫ স্টার, বার্মা স্টার মেডেল, ওয়ার মেডেল ১৯৩৯-৪৫ পেয়েছি। ১৯৪৮ সালের ১৭ আগস্ট সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। বাড়িতে ফিরে আসার পর অভাবের তাড়নায় ১৯৪৭ সালের পর খুলনা আদমজী জুট মিলে নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি করে কোনোমতে সংসার চালাতাম। এরপর দেশ স্বাধীন হলে জুট মিল বন্ধ হয়ে গেলে আবার আমি এলাকায় এসে দিনমজুর ও কৃষিকাজ করে পরিবার নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। বার্ধক্যজনিত কারণে বিভিন্ন রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে শরীরে। বর্তমানে আমি অনেক রোগে আক্রান্ত। ব্রিটিশ ভাতা দিয়ে রোগের চিকিৎসা ও সংসার চালাতে আমি হিমশিম খাচ্ছি।’

সর্বশেষ খবর