শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

দেশীয় প্রযুক্তিতে ছুটবে ডেমু ট্রেন

দেড় বছরের চেষ্টায় মাত্র ৭২ দিন কাজ করে ব্যয়বহুল চীনা প্রযুক্তিকে সরিয়ে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহারে একটি ডেমু ট্রেনকে সচল করেছেন প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান

দিনাজপুর প্রতিনিধি

দেশীয় প্রযুক্তিতে ছুটবে ডেমু ট্রেন

কম দূরত্বে যাত্রী পরিবহন সেবা আরও উন্নত, সহজ এবং দ্রুতগামী করার জন্য আনা চীনা প্রযুক্তির সেই ডেমু ট্রেন মেয়াদের আগেই নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা সেই ডেমু ট্রেনে ব্যয়বহুল চীনা প্রযুক্তি সরিয়ে দেশীয় প্রযুক্তি দিয়ে সচল করেছেন বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা। তারা চীনের প্রযুক্তি সরিয়ে নিজেদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে দিনাজপুরের পার্বতীপুর ডিজেল ওয়ার্কশপে সচল করেন একটি ডেমু ট্রেন। এরই মধ্যে ৪ সেপ্টেম্বর থেকে দিনাজপুরের পার্বতীপুর রেলওয়ে জংশন থেকে ট্রায়াল রানে কিছু সংখ্যক যাত্রী নিয়ে পঞ্চগড়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশে ছেড়ে যায় সচল হওয়া ডেমু ট্রেনটি।

প্রায় এক বছর ধরে চেষ্টার পর  এটি মোটামুটি সফল। আগামী চার-পাঁচ মাস পর্যবেক্ষণ করার পর এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে এবং এটি সফল বলে মনে করা হবে। এর পরেও সব কিছু ঠিক থাকলে বাকি ১৯টি ডেমু ট্রেনই সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। পর্যবেক্ষণের পর এই ট্রেন চলাচল ও মেরামত সম্পর্কে সফলতার কথা আপনাদের মাধ্যমে জানানো হবে- এমনটাই বলছিলেন দিনাজপুরের পার্বতীপুরের কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানার (কেলোকা) প্রধান নির্বাহী (সিএক্স) মো. রফিকুল ইসলাম।

চীনের টেকনোলজি জটিল ছিল, সেটি সহজ করতে এই প্রক্রিয়া। তবে দেশীয় প্রযুক্তিতে এসব ডেমু ট্রেন পরিচালিত হলে একদিকে অর্থ সাশ্রয়, অন্যদিকে কম দূরত্বে রেলওয়ের যোগাযোগে যাত্রীদের সেবা আরও উন্নত, সহজ এবং দ্রুতগামী হবে। দেশীয় প্রযুক্তিতে ডেমু মেরামত বিশাল অর্জন। পর্যবেক্ষণের পর সফলতা ধরে রাখা গেলে এ প্রযুক্তিতে ট্রেন মেরামত করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে। তাই দেশের প্রকৌশলীদের চেষ্টায় আশার আলো দেখছেন দেশবাসী।

জানা যায়, ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট-ডেমু ট্রেনের দুই দিক দিয়ে দুটি ইঞ্জিন ও মাঝখানে বগি থাকে। একেকবার ১৪৯ জন যাত্রী আসনে বসতে পারেন, সেইসঙ্গে ১৫০ জন যাত্রী দাঁড়িয়ে যাতায়াত করতে পারেন। ডেমু ট্রেন মূলত কম দূরত্বে যাত্রী পরিবহনের জন্য। যাত্রীদের সেবা উন্নত, সহজ এবং দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দিতে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ রেলওয়েতে যুক্ত হয় ২০টি ডেমু ট্রেন। চীন থেকে এই ডেমু আমদানিতে খরচ হয় ৬৪৫ কোটি টাকা। বিশ্বমানের ও আধুনিক ডেমু ট্রেনগুলো কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত এক ধরনের বিশেষ সফটওয়্যার দিয়ে পরিচালিত। চীনের তানসন ইন্টারন্যাশনাল ও ডানিয়াল টেকনিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট ওই ডেমু ট্রেনের নির্মাতা। সে প্রযুক্তি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে হস্তান্তর করেনি। প্রযুক্তি হস্তান্তর না করায় একটার পর একটা ট্রেন বিকল হতে থাকে। একটি ডেমুতে ৪০টি মডিউল রয়েছে। অনবরত একটির পর একটি মডিউল নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করায় একপর্যায়ে এসব ট্রেন মেরামতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে ২০টি ডেমু ট্রেনই পার্বতীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে পড়ে রয়েছে। ট্রেনগুলোর মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০ বছর। সে হিসেবে ২০১৩ সালে তৈরি এসব ডেমু ট্রেনের চলার কথা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত। কিন্তু মেয়াদের অর্ধেক সময় আগেই অকেজো হয়ে পড়ে। ২০২০ সালে মেরামতের অভাবে ট্রেনগুলো বিকল হয়ে যায়।

এর মডিউল বিকল হলে নতুন মডিউলের সঙ্গে সফটওয়্যার সেটআপ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। মেরামতের জন্য চীনের সেই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান দাবি করে প্রায় বিক্রয় মূল্যের কাছাকাছি খরচ। পরে ট্রেনগুলো সচল করতে এগিয়ে আসেন দেশের প্রকৌশলীরা।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী ও আণবিক শক্তি কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামানের সহযোগিতা চাওয়া হয়। আসাদুজ্জামান ডেমু নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। গবেষণাগার হিসেবে তিনি বেছে নেন সৈয়দপুর রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাবের একটি কক্ষ। তিনি দীর্ঘ দেড় বছর গবেষণা করে সফল হন। দেড় বছরের চেষ্টায় মাত্র ৭২ দিন কাজ করে ব্যয়বহুল চীনা প্রযুক্তিকে সরিয়ে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহারে একটি ডেমু ট্রেনকে সচল করেছেন তিনি। ইতোমধ্যেই লোডসহ তিনবারের সফল ট্রায়াল হয়েছে। তার এই মেরামত কার্যক্রমে সহযোগিতা করেন প্রকৌশলীসহ পার্বতীপুর ডিজেল লোকো ওয়ার্কসপের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আর নতুন উদ্ভাবিত এ প্রযুক্তিতে মেরামত হলে খরচ অনেকটা কম পড়বে।

অকেজো ডেমু ট্রেন সচল হওয়ায় খুশি যাত্রীরাও। ট্রেনে চলাচলকারী কয়েকজন যাত্রী বলেন, প্রথমে ট্রেনগুলো চালু হওয়ার পর থেকেই নিয়মিত যাতায়াত করেছি। কিন্তু বন্ধ হওয়ায় কিছুটা ভোগান্তিতে পড়েছিলাম। এখন শুনছি, দেশীয় প্রযুক্তিতে একটি ট্রেন চালু করা হয়েছে। তাই আগের মতো এই ট্রেনে যাতায়াত করতে পারব। ডেমু ট্রেন অনেক দ্রুত চলে, আরামদায়ক, যাতায়াতে ভালোই লাগে। দেশের প্রকৌশলীরা সচল করায় তাদের ধন্যবাদ জানাই। এ ব্যাপারে পার্বতীপুরে কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানার (কেলোকা) প্রধান নির্বাহী (সিএক্স) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, অকেজো ডেমু মেরামত করে দেশের প্রকৌশলীরা যুগান্তকারী সাফল্য দেখিয়েছেন।  আগামী চার-পাঁচ মাস পর্যবেক্ষণের পরই এর সফলতা বলা যাবে। তখন সফলতা এলে বাকি ১৯ সেট ডেমু ট্রেনই সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর