শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
দেশে ফিরে কাজ করতে চান শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে

উখেংচিং মারমার এমআইটি যাত্রা

‘আমি পরিবার ও পরিবেশে যেসব সুযোগ পেয়েছি, পাহাড়ের বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে তা পায় না। পাহাড় শিক্ষায়, চিকিৎসায় এখনো অনেক পিছিয়ে...

জামশেদ আলম রনি

উখেংচিং মারমার এমআইটি যাত্রা

বিশ্বখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ম্যাসাচুয়েটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) পড়ার সুযোগ পেয়েছেন পাহাড়ের মেয়ে উখেংচিং মারমা। এমআইটির লিঙ্গুইস্টিক অ্যান্ড ফিলোসফি বিষয়ে মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন উখেংচিং। তার জন্ম খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার চোংড়াছড়ি গ্রামে। মা-বাবার চাকরি সূত্রে তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে খাগড়াছড়ি সদরে। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনি বড়।

উখেংচিং মারমা এমআইটিতে তার বিভাগ থেকে ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পেয়েছেন। একই সঙ্গে পেয়েছেন দুই বছরের ফেলোশিপ। প্রথম বছর কোর্সওয়ার্ক করবেন, দ্বিতীয় বছর করবেন গবেষণা। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য প্রযুক্তিকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, প্রযুক্তির বাইরে আর কী কী করা দরকার সে বিষয়ে গবেষণার ইচ্ছা আছে বলে জানান উখেংচিং। তিনি বলেন, ‘যে ব্যাকগ্রাউন্ড থেকেই যান না কেন, এমআইটিতে দেখা হয় আপনি নতুন কী উদ্ভাবন করতে পারবেন। কোনো শিক্ষার্থীকে ভর্তি করার সময় মূলত এ বিষয়টা তারা দেখে। সঙ্গে সহশিক্ষা কার্যক্রম।’ এমআইটিতে পড়ার সুযোগ পাওয়ায় উখেংচিংকে অভিনন্দন জানিয়েছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। তাদের ফেসবুক পেজে লিখেছে, ‘আসুন, আমরা রানি উখেংচিং মারমাকে অভিনন্দন জানাই! তিনি বাংলাদেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী প্রথম ব্যক্তি যিনি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে অবস্থিত ম্যাসাচুয়েটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) স্নাতকোত্তর কার্যক্রমে ভর্তি হয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক ব্যুরোর সহায়তাপুষ্ট গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের শিক্ষার্থী ছিলেন।’ উখেংচিং বোস্টনে দেড় বছরের শিশুসন্তান পেং উ প্রু চৌধুরীকে নিয়ে গেছেন। সঙ্গে আছেন তার মা। উখেংচিং মনে করেন, পাহাড়িদের সম্পর্কে এখনো অনেকের নেতিবাচক ধারণা আছে। নারীরা সেখানে নিগ্রহের শিকার হন। বড় জনগোষ্ঠীর নেতিবাচক মনোভাবের অধিকারীদের কাছে থেকেই পাহাড়ি নারীরা নিপীড়নের শিকার হন। নারীদের ওপর নিগ্রহ নিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই লেখালেখি করেছেন। নিগ্রহের এসব ঘটনা বন্ধ করতে পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে শিক্ষা জরুরি বলে মনে করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই চেয়েছেন নিজ জনগোষ্ঠীর পিছিয়ে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়াতে। করোনা মহামারির সময় কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারির মাধ্যমে রাজার সহযোগিতায় খাগড়াছড়ির অনেক দরিদ্র পরিবারের মাঝে খাবার দিয়েছেন। স্নাতক শেষ করার পর পাহাড়ের সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। করোনার মধ্যে রাজা সাচিংপ্রু সরকারি ও বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিয়ে প্রান্তিক মানুষকে সহযোগিতা করেছেন। ব্র্যাকের সহযোগিতা নিয়ে মেয়েদের মধ্যে ২৫ হাজার স্যানিটারি প্যাড দিয়েছেন রানি উখেংচিং মারমা। উখেংচিংয়ের লেখাপড়া শুরু খাগড়াছড়ির মহালছড়ির চোংড়াছড়ির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর নতুনকুঁড়ি ক্যান্টনমেন্ট হাইস্কুল থেকে এসএসসি শেষ করে খাগড়াছড়ির ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মাস তিনেক অধ্যয়ন করেন। পরে সুযোগ পান এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেনে পড়ার। বিশ্বমানের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ তাকে আরও বিকশিত হতে সহযোগিতা করেছে বলে মনে করেন উখেংচিং। ছোটবেলায় দেখা স্বপ্নগুলো পূর্ণ করার শুরুটা এখান থেকেই।

উখেংচিং বলেন, ‘এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো হয়। আর ইংরেজি আমাদের তৃতীয় ভাষা। মাতৃভাষার পর আমাদের বাংলা শিখতে হয়। তারপর ইংরেজি। আমার জন্য বাংলাটা যেমন কঠিন, ইংরেজিটা আরও কঠিন। তা ছাড়া দেশের নামকরা সব কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা আসে এখানে। আমাদের জন্য কোনো কোটাও নেই। ফলে ভর্তি পরীক্ষায় অন্যদের সঙ্গে লড়াই করেই আসতে হয়েছে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই শিক্ষকদের সহযোগিতায় উখেংচিং ও তার কয়েক বন্ধু মিলে একটি প্রকল্প নিয়েছিলেন। সেই প্রকল্পের আওতায় তাঁরা ১০ জন মিলে ১০ পাহাড়ি মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে পড়া ছেলে-মেয়েদের বছরব্যাপী শিক্ষা সহায়তা দেন। তাঁরা পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয় পড়তে সহযোগিতা করতেন। সেই সঙ্গে তাদের কিছু অনুদানও দেওয়া হতো। এখন এসব ছেলে-মেয়ের বেশির ভাগ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। উখেংচিং মারমা ২০২০ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। বর খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মং সার্কেল চিফ রাজা সাচিং প্রু চৌধুরী। এর মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের মং সার্কেলের অষ্টম রানি হয়েছেন উখেংচিং।

সর্বশেষ খবর