শনিবার, ১ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

বগুড়ার ঐতিহ্য ভারে দই বিক্রি

দই বিক্রেতা রন্টু ঘোষ জানান, তার দাদাও ভারে ফেরি করে দই বিক্রি করেছেন। তার পরিবারের সবাই দুধ থেকে দই তৈরির কাজে সিদ্ধহস্ত। ভালোমানের দই বিক্রি করা তার নেশা ও পেশা। ভালো দই দিতে পারলে ক্রেতারা খুঁজে নেবেন...

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

বগুড়ার ঐতিহ্য ভারে দই বিক্রি

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর নাটকে বলা হয়েছে-দই দই ভালো দই! এমন হাঁক শুনে নাটকের অমল চরিত্র দইওয়ালাকে তিনবার ডেকেছিল দইওয়ালা, দইওয়ালা, ও দইওয়ালা! অমল দইওয়ালার কাছ থেকে দই কিনতে না পারলেও দইওয়ালার সঙ্গে চলে যেতে চেয়েছিল। অমলের দূর থেকে দইওয়ালার হাঁক মধুর লেগেছিল। রবীন্দ্রনাথের ডাকঘরের মতো আজও বগুড়ায় ভারে করে দই বিক্রি হয়। কালে কালে সময় গিয়ে দই বিক্রির জন্য টাইলস মোজাইক আর এসি শোরুম সৃষ্টি হলেও এখনো বাপ-দাদার পেশা ভারে করে দই বিক্রি করে যাচ্ছেন অল্প কিছু দই বিক্রেতা।

দইয়ের শহর বগুড়ায় স্বাধীনতার আগে ও পরে দই বিক্রি হতো ভারে করে। বাঁশের তৈরি বিশেষ ধরনের বহনকারী ভারে দইয়ের হাঁড়ি বসিয়ে ফেরি করে দই বিক্রি হতো। পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে, ফেরি করে দই বিক্রির একটি প্রচলিত রীতি ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন অনেকাংশে কমে গেছে। ভারে করে দই বিক্রি তেমন আর দেখা যায় না। কালেভদ্রে চোখে পড়ে এই দৃশ্য। দই বিক্রেতারাও আর কাঁধে ভারী ভার তুলতে চাইছেন না। সেদিক থেকে জেলার সব এলাকায় কম-বেশি দই বিক্রির শোরুম গড়ে উঠেছে।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বগুড়ার গাবতলী উপজেলার হাতিবান্ধা গ্রামের রন্টু ঘোষ ভারে করে দই বিক্রি করছেন জেলা শহরের ভাটকান্দি এলাকায়। তিনি কয়েক কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ভার নিয়ে দই বিক্রি করছেন। তার ভারে সাজানো রয়েছে মিষ্টি দই, টক দই, সাদা দই। তিনি ‘দই নেবেন দই’ বলে হেঁকে যাচ্ছেন। আর কেউ বা নিচ্ছেন আবার কেউ বা দর দাম করে যাচ্ছেন। কোথাও ভার রেখে জিরিয়ে নিচ্ছেন। আবার দই বিক্রির জন্য ফেরি করতে রওনা হচ্ছেন। তিনি জানান, সাধারণত তিন প্রকার দই বিক্রি করেন। এর মধ্যে সাদা, টক ও মিষ্টি দই। মিষ্টি দইয়ের চাহিদা বেশি। মিষ্টি দই বড় হাঁড়ি ১৫০ টাকা, ছোট ৮০ টাকা করে বিক্রি করেন। সাদা ও টক দই ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করেন। রন্টু ঘোষ জানান, আগে ফেরি করেই দই বিক্রি হতো। কিন্তু এখন ফেরি করে তেমন দই বিক্রি হয় না। সবাই শোরুম করেছে। শোরুম থেকেই দই বেশি বিক্রি হয়। যাদের বাপ-দাদার আমল থেকে দইয়ের ব্যবসা ছিল তাদের কেউ কেউ ফেরি করে দই বিক্রি করে থাকেন। তাছাড়া এখন আর গোয়ালারা তেমন দই বিক্রি করেন না। গোয়ালারা দই তৈরি করে দেন আর বড় বড় ব্যবসায়ীরা টাইলসের এসি শোরুম দিয়ে দই বিক্রি করছেন।

বগুড়ার প্রবীণরা জানান, দইয়ের শুরুটা হয়েছিল বগুড়া শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলায়। কথিত আছে, উনিশ শতাব্দীর ৬০-এর দশকের দিকে গৌর গোপাল পাল নামের এক ব্যবসায়ী প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে সরার দই তৈরি করেন। তখন দই সম্পর্কে সবার ভালো ধারণা ছিল না। গৌর গোপালের এই দই-ই ধীরে ধীরে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নবাব পরিবার ও সাতানী পরিবারের কাছে এ দই সরবরাহ করতেন গৌর গোপাল। সে সময়ে এ দইয়ের নাম ছিল নবাববাড়ীর দই। নবাবী আমলে বিশেষ খাবার ছিল এই দই। কালে কালে দিন গড়িয়ে গেলেও এখনো বিশেষ খাবার হিসেবে ধরে রেখেছে দই। বিয়ে, জন্মদিন, ঈদ, পূজা, আকিকা হালখাতা বা পারিবারিক যে কোনো অনুষ্ঠানে দই বিশেষ খাবার হিসেবে পরিবেশিত হয়ে থাকে।

বগুড়ায় খাবার হিসেবে দইয়ের প্রচলন বেশি হওয়ায় জেলা শহরের আনাকে-কানাচে দইয়ের শোরুম গড়ে উঠেছে। হিসাব কষলে ১২ উপজেলায় প্রায় দুই সহস্রাধিক দইয়ের শোরুম রয়েছে। এসব শোরুম থেকে প্রতিদিনিই দই বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে বর্তমানে সুনাম ছড়িয়েছে বগুড়া শহরের কবি নজরুল ইসলাম সড়কের আকবরিয়া লিমিটেড, এশিয়া সুইটমিট ও দই ঘর, নবাববাড়ীর রুচিতা, বিআরটিসি মার্কেটের দইবাজার, মিষ্টিমহল, মহরম আলী, শ্যামলী, এনাম দই ঘর, শেরপুর দই ঘর, চিনিপাতা, বাঘোপাড়ার রফাত দই ঘর, শেরপুরের রিপন দধি ভাণ্ডার, সাউদিয়া, জলযোগ, শম্পা, বৈকালী ও শুভ দধি ভাণ্ডার থেকে প্রতিদিন প্রচুর দই বিক্রি হয়। বগুড়ার আকবরিয়া লিমিটেডের চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল জানান, ‘আধুনিকভাবে শোরুম গড়া হয়েছে। দই বিক্রি হয় প্রতি পিস হিসেবে। দই তৈরির যাবতীয় দ্রব্যের দাম বেড়েছে দিগুণ। এ কারণে দইয়ের দামও বেড়েছে। তাদের শোরুমে বিভিন্ন স্বাদের দই পাওয়া যায়। মিষ্টি দইয়ের পাশাপাশি বিক্রি হয় টক বা সাদা দই। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দই পাওয়া যায়। যার প্রতি পাতিল বিক্রি হয় ৩৫ টাকা থেকে ৩০০ টাকায়। ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির মাটির পাত্রে দই ভরা হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ বগুড়া এলে আকবরিয়ার দইয়ের স্বাদ নিয়ে থাকেন।’

সর্বশেষ খবর