‘সবুজ মননে সবুজ সৃজন’ প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে নওগাঁয় ব্যতিক্রমী এক কৃষি উদ্যোগের সূচনা হয় ২০১৯ সালে। যেটি সুফলা নওগাঁ এগ্রো প্রজেক্ট নামে পরিচিত। এর পরিচালক হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন হাবিব রতন। আধুনিক কৃষির অনুপ্রেরণা হচ্ছে সমবায়ভিত্তিক এই প্রজেক্ট। সৃজনশীল চিন্তায় হাবিব রতন তরুণ বেকার এবং প্রান্তিক কৃষকদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে গড়ে তুলেছেন প্রজেক্টটি। সূচনালগ্নে সঙ্গী ছিল ১৫ জন। পরবর্তীতে ১০ জনের এই কৃষি উদ্যোগের অর্থ সংগ্রহের পদ্ধতি শুরু হয় ব্যতিক্রমী পদ্ধতিতে।
প্রায় ছয় মাস অর্থ সংগ্রহের পর চকাদিন গ্রামে দুই একর জমি ১০ বছরের জন্য লিজ নিয়ে শুরু হয় মিশ্র ফল বাগান তৈরির কাজ। ব্যতিক্রমী এই প্রজেক্টে চায়না-৩ লেবু, বাউ-৩ ও বারি-১ জাতের মাল্টা, ড্রাগন ও থাই জাম্বুরার চারা রোপণ করা হয়। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও সম্মিলিত পরিশ্রমে অল্প সময়ে এই প্রজেক্টটি মডেল মিশ্র ফল বাগান হিসেবে গড়ে ওঠে। করোনার সময়ে চায়না-৩ জাতের লেবুতে অভাবনীয় সাফল্য আসে। সে সময় বাজারে লেবুর চাহিদা ও দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় উপজেলার অনেক শিক্ষিত বেকার ও প্রবাসফেরত যুবকরা লেবু চাষে আগ্রহী হয়। কৃষিতে আগ্রহী এসব যুবকের সার্বিক সহযোগিতা, পরামর্শ এবং হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিতে উপজেলা কৃষি অফিস প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করে। এতে নতুন নতুন কৃষি উদ্যোক্তা সৃষ্টি হতে থাকে।
এনায়েতপুর গ্রামের শিক্ষিত যুবক ইউসুফ আলী ঢাকায় চাকরি করতেন। সেটি ছেড়ে গ্রামে এসে হতাশায় ভুগছিলেন। সে সময় প্রজেক্টটির স্পর্শে আধুনিক ও উচ্চমূল্যের কৃষির সন্ধান পান। প্রজেক্টের সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন ও নজরুল ইসলাম প্রতিদিন বাগানে কাজ করছেন এবং বাগানের শেয়ারের মুনাফার টাকায় সাংসারিক উন্নতি করেছেন। এভাবে প্রজেক্টটিতে প্রায় ছয়জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়। এটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। প্রজেক্টের অর্থ সম্পাদক মোকাদ্দেস সরদার বছরব্যাপী লেবু, মাল্টা, ড্রাগন ইত্যাদি ফল বিক্রির কাজে ব্যস্ত থাকেন।
তিনি জানান, লভ্যাংশ প্রাপ্তি তাকে কৃষিতে ভীষণ আগ্রহী করে তুলেছে। হাবিব রতনের স্বপ্ন ছিল প্রজেক্ট সম্প্রসারণের। ২০২৩ সালে শুরু হয় আরেক স্বপ্ন যাত্রা। নতুনভাবে আরও দুই একর জমি লিজ নিয়ে বাগান সৃজনের পরিকল্পনা করেন। আবারও উঁকি দেয় সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। এক একর জমিতে টিস্যু কালচারে উৎপাদিত সম্ভাবনাময় জি-৯ কলার বাণিজ্যিক বাগান সৃজনের কাজ চলে। প্রথম রোপণের পর কিছু চারা মারা গেলেও সে বছরের জানুয়ারিতে রোপিত টিস্যু কালচারের চারা থেকে কলা সংগ্রহ শুরু হয় চলতি বছর। যা এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সঠিক পরিচর্যায় বাম্পার ফলনে হৃদয় ও চোখ জুড়িয়ে যায়। সারি সারি লম্বা কলার কাঁদি ঝুলে আছে। প্রতিটি কাঁদিতে কলার সংখ্যা ২০০-২৪০টি। অন্য জাতের কলা সাধারণত প্রতিটি কাঁদিতে ৬০-১২০টি পাওয়া যায়। জনপ্রিয় ফল কলা চাষে পানামা রোগের আক্রমণে বাগানের পর বাগান উজাড় হয়ে যাচ্ছে। সেই জায়গায় জি-৯ জাতের কলা পানামা রোগ প্রতিরোধী।
এই প্রজেক্টের মাধ্যমে জেলায় প্রথম জি-৯ কলার বাণিজ্যিক বাগানের সূচনা হয়েছে। রোগবালাই প্রতিরোধী ও রপ্তানিযোগ্য জি-৯ জাতের কলার চাষ দারুণ লাভজনক। এ কলা জেলায় বেশ সাড়া ফেলেছে। নতুন এই প্রজেক্টে এক একর জমিতে জি-৯ কলা, এক একর জমিতে ফিলিপাইনের ব্ল্যাক আখ এবং আলট্রা হাইড্রেন সিটিতে ব্যানানা ম্যাংগো আম বাগান সফলতার হাতছানি দিচ্ছে। শুধু তাই নয়; প্রজেক্টটি শুরু থেকেই ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করে।
১৫টি চারি থেকে নিয়মিত ভার্মি কম্পোস্ট উত্তোলন হচ্ছে। মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অন্য খামারিদের নিয়মিত জৈব সার উৎপাদন, ব্যবহার ও বিপণন করছে। প্রজেক্টটি উত্তম কৃষিচর্চার মাধ্যমে নিরাপদ ফল উৎপাদন ও অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করছে বলে জানান পরিচালক হাবিব রতন।