শ্রীমঙ্গল উপজেলার সদর ইউনিয়নের একটি গ্রাম রাধানগর। শহর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। পাহাড়ঘেরা এই গ্রামের মানুষ ছিল কৃষিনির্ভর। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে লেবু, আর সমতলে আনারস, ধান চাষ করে জীবিকানির্বাহ করতেন। কিন্তু গত এক দশকে পর্যটনের ছোঁয়ায় কৃষিনির্ভর এই গ্রামটি আজ বদলে গেছে। পুরো গ্রামই আজ পর্যটকনির্ভর। রাধানগর এখন পর্যটন গ্রাম হয়ে উঠেছে। পাঁচতারা হোটেলসহ বহু রিসোর্ট-হোটেল গড়ে উঠছে এখানে। গ্রামজুড়েই লেগে আছে পর্যটনের ছোঁয়া। প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা আসছেন এখানে। গ্রামের বাঁকে-বাঁকে গড়ে উঠেছে আধুনিক রিসোর্ট ও কটেজ। এই গ্রামে এখন পাঁচতারকা মানের রিসোর্টসহ ২৫টি রিসোর্ট ও কটেজ। পরিকল্পনা এবং নির্মাণের অপেক্ষায় আরও ২৫টি। দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ ব্যবসা করছেন এখানে। কেউ রিসোর্ট দিয়েছেন, কেউ রেস্তোরাঁ, আবার কেউবা পরিবহনের কাজ করছেন। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা জেগে থাকে এই গ্রাম। প্রতিদিন অন্তত ৫০০ পর্যটক এই গ্রামের হোটেল-রিসোর্ট-কটেজে বসবাস করেন। পাঁচতারা হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান দিয়ে শুরু এই গ্রামের শুরু। যতই এগিয়ে যাবেন, চোখে পড়বে একের পর এক রিসোর্ট, হোটেল ও ইকো-কটেজ। শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে আসা পর্যটকদের বড় একটি অংশ থাকার জন্য এই গ্রামকেই বেছে নেন। এই পর্যটকদের সেবায় ৫০টির মতো খাবার হোটেলসহ বিভিন্ন ধরনের দোকান গড়ে উঠেছে এ গ্রামে। কেউ জায়গা কিনে রেখেছেন, কেউ নির্মাণকাজ শুরু করেছেন।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই গ্রামে পর্যটন খাতে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ ২০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। চা-শিল্পের পর পর্যটন খাতকেই এই অঞ্চলের সম্ভাবনাময় ও বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ খাত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিনিয়োগ যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে এই এলাকার জায়গার দাম।
পর্যটন কেন্দ্রিক নানা ব্যবসায় এখানে কর্মসংস্থান হয়েছে সহস্রাধিক মানুষের। ১০ বছরে জায়গার দাম বেড়েছে ৫০ গুণ। রাধানগর গ্রামের প্রথম পর্যটন ব্যবসায়ী শামছুল হক। তিনি ১৮ বছর আগে এখানে ইকো কটেজ গড়ে তোলেন। শামছুল হক বলেন, ‘এক সময় মুদি দোকানের পাশাপাশি লেবুবাগান গড়ে তুলেছিলাম। দিনে দিনে শ্রীমঙ্গল পর্যটনে সমৃদ্ধ হতে থাকলে পরীক্ষামূলকভাবে ২০০৭ সালে লেব ুবাগানের ভিতরে এক রুমের একটি ইকো-কটেজ করি। ভাবনার চেয়েও বেশি সাড়া পাওয়ায় পরে পাশেই ২০১১ সালে লেবু বাগানে ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে আরও তিনটি কটেজ গড়ে তুলি। ২০২২ সালে অন্যদের সঙ্গে শেয়ারে একটি খাবার হোটেল খুলি। এসব প্রতিষ্ঠানে এখন স্থানীয় ১৮ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে।’
ট্যুর গাইড রাসেল আলম বলেন, তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি গৃহশিক্ষকতা করতেন। ২০০৫ সালে আকৃষ্ট হই ইকোট্যুরিজমে। প্রশিক্ষণ নিয়ে ট্যুর গাইড হিসেবে নতুন জীবন শুরু করি।’ বর্তমানে পর্যটনের মৌসুমে মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করছেন রাসেল। তিনি জানান, তাঁর আশপাশে এমন অন্তত ১৫ জন গাইড আছেন, যাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে ট্যুরিজম। অরণ্যের দিনরাত্রি রিসোর্টের মালিক কুমকুম হাবিবা জানান, তিনি ঢাকার বাসিন্দা। শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে এসে প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যান। রাধানগরে জমি কিনে রিসোর্ট করেন। এই ব্যবসায় তিনি প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এখন প্রতি মাসে আয় হচ্ছে সাড়ে ৬ লাখ টাকা। খরচ বাদে তিনি পাচ্ছেন ৩ লাখ টাকার মতো। সাবেক ইউপি সদস্য বিশ্বজিৎ দেববর্মা জানান, ১০ থেকে ১৫ বছর আগে এখানে জায়গার দাম ছিল ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা শতক। এখন শতক পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। জানা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী এই গ্রামে জনপ্রিয় ছিল আখচাষ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষ করে আখ ব্যবসায়ী এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা এখানে এসে বসবাস শুরু করেন। ধীরে ধীরে লেবু চাষ এবং কাঁঠাল বাগান জনপ্রিয় হতে থাকে। এখনো এই এলাকায় লেবু বাগানের অস্তিত্ব চোখে পড়ে, রয়েছে কাঁঠাল বাগানও। ২০১০ সাল থেকে এখানে পর্যটন ব্যবসা জনপ্রিয় হতে থাকে। ২০১৫ সালে তা বেগবান হয়। গড়ে উঠছে নতুন নতুন দেশি-বিদেশি খাবার হোটেল, হস্তশিল্পের দোকান, চা-পাতার দোকান। এই গ্রামটি ইকো-ট্যুরিজমের ক্ষেত্রেও একটি দৃষ্টান্ত। দিন-রাত এখানে পর্যটকরা নিরাপদে চলতে পারেন। এই গ্রামকে কেন্দ্র করে যে পর্যটন ক্ষেত্র তৈরি, তার অবদান শুধু শ্রীমঙ্গল নয়, জাতীয় অর্থনীতিতেও রাখছে। রাধানগর ট্যুরিজম এন্ট্রাপ্রেনার অ্যাসোসিয়েশন সহসভাপতি তাপস দাশ বলেন, আমরা চাইনি শুধু রিসোর্ট বা কটেজ গড়ে তুলতে, চেয়েছি প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে একটি টেকসই পর্যটন গ্রাম গড়ে তুলতে। এখানকার প্রতিটি স্থাপনা, রিসোর্ট, ইকো কটেজ বা রেস্টুরেন্ট পরিবেশবান্ধব।