সোমবার, ১৫ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

আনন্দবাজার পত্রিকা ও আমার অভিজ্ঞতা

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

আনন্দবাজার পত্রিকা ও আমার অভিজ্ঞতা

আনন্দবাজার পত্রিকা এবং বাংলাদেশ প্রতিদিন একই মাসে জন্ম। আনন্দবাজার ১৯২২ সালের ১৩ মার্চ। আর বাংলাদেশ প্রতিদিনের জন্ম ১৫ মার্চ। বাংলাদেশ প্রতিদিনের বয়স মাত্র ১২ বছর। আনন্দবাজার ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের দীর্ঘদিনের ফারাক হলেও মূল উদ্দেশ্য একই। অর্থাৎ পাঠকদের প্রতি দায়বদ্ধতা। আর শাসকের হুমকির কাছে মাথা নত না করা।

আমার মনে আছে ১৯৭৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার ওপর পশ্চিমবঙ্গের সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সরকার যেভাবে অত্যাচার শুরু করেছিল, এমনকি সরকার কাগজ অধিগ্রহণ করার হুমকি দিয়েছিল, তা অভাবনীয়। সেদিনকার সম্পাদক আমাকে বলেছিলেন, আমরা মানুর (সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়) কাছে নতিস্বীকার করব না। আমরা মানুর কাছে দায়বদ্ধ নই। আমরা দায়বদ্ধ মানুষের কাছে, পাঠকের কাছে।

এবার দেখা যাক ১৯২২ সাল থেকে আনন্দবাজারের অভিযানের অগ্রগতি। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে দেখতে পেয়েছি, স্বাধীনতাবিরোধী কোনো শক্তির কাছে বাংলাদেশ প্রতিদিন মাথা নত করেনি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিকে বাংলাদেশ প্রতিদিন পূর্ণ সমর্থন করে বারবার সোচ্চার হয়েছে। ঢাকার সরকারের একটা অংশ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি পাকিস্তান, সিআইএ বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নষ্টের যে চেষ্টা করে চলেছে, বাংলাদেশ প্রতিদিন বারবার তার মুখোশ খুলে দিয়েছে।

দোলযাত্রার দিনই আনন্দবাজার পত্রিকার শুরু। লাল কাগজে ছাপা আনন্দবাজার পত্রিকার জন্ম পরাধীন ভারতবর্ষে। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন তখন সবে দানা বেঁধে উঠেছে। জন্মদিন থেকে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি পর্যন্ত বহুবার রাজরোষে পড়তে হয়েছে আনন্দবাজারকে। ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে যেমন স্বাধীনতাসংগ্রামীদের দুঃখ-কষ্ট, ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তেমনই আনন্দবাজার ও তার কর্মকর্তাদের বহুবার কারাবরণ করতে হয়েছে। জরিমানা দিতে হয়েছে হাজার হাজার টাকা। ১৯২৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বাঙালি বীর যতীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সম্পাদকীয় প্রকাশের জন্য ভারতীয় দন্ডবিধির ১২৪(ক) ধারা অনুসারে আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রফুল্ল কুমার সরকার ও মুদ্রাকর অধরচন্দ্র দাসকে রাজদ্রোহের অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। জামিন দেওয়ার আরজি অগ্রাহ্য করে সম্পাদক ও মুদ্রাকরকে জেলহাজতে রাখা হয়। পরে তারা মুক্তি পান। ১৯২৬ সালে আবার ফৌজদারি দন্ডবিধির ১৫৩(ক) ধারা অনুসারে ইংরেজ সরকার পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা করে। ১৯২৭ সালের ২৫ জুলাই আনন্দবাজারের সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারকে ভারতীয় দন্ডবিধির ১৪৩, ১৪৭, ১৪৮ ধারা অনুসারে অভিযুক্ত করে গ্রেফতার করা হয়। ১৯২৯ সালে বিশেষ কংগ্রেস সংখ্যায় বাংলার বিপ্লব আন্দোলন সম্পর্কে প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারকে রাজদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। সম্পাদকের এক হাজার টাকা জরিমানা হয় এবং তা না দেওয়ায় এক মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড হয়। ওই বছর ৩১ ডিসেম্বর পুলিশ আনন্দবাজার অফিসে খানাতল্লাশি করে পত্রিকার কংগ্রেস সংখ্যার অবিক্রীত সংখ্যাগুলো বাজেয়াপ্ত করে। ১৯৩০ সালে বিশেষ কংগ্রেস সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধের জন্য সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের ছয় মাসের কারাদন্ড হয়। ওই বছর ১৪ নভেম্বর আনন্দবাজার অফিসে পুলিশ হানা দেয়। পরদিন মাখনলাল সেনকে গ্রেফতার করে। বিচারে মাখনলাল সেনের ছয় মাস কারাদন্ড হয়। ১৯৩১ সালে সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের নয় মাসের কারাদন্ড হয়। ১৯৩২ সালে সরকার আনন্দবাজার পত্রিকার কাছে দুই হাজার টাকা জামানত দাবি করে। এখানেই শেষ নয়। পরপর আনন্দবাজার থেকে হাজার হাজার টাকা জামানত নেওয়া হতে থাকে। আনন্দবাজার সরকারের সব টাকা মিটিয়ে দেয়। এ ছাড়া ওই বছরের ১ এপ্রিল থেকে পত্রিকার সুরেশবাবু ও সত্যেনবাবুকে ছয় দিনের জন্য বিনা কারণে আটকে রাখে ব্রিটিশ সরকার।

১৯৩৪ সালে এক হাজার টাকা জামানত বাজেয়াপ্ত করে এবং নতুন করে ১০ হাজার টাকা জামানত দাবি করে। ১৯৩৬ সালে ‘সাহিত্যে সরকারি দৌরাত্ম্য’ সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশের জন্য সরকার দুই হাজার টাকা জামানত বাজেয়াপ্ত করে। আবার ১০ হাজার টাকা জামানত চায়। ১৯৩৮ সালে সত্যেনবাবুর ছয় মাসের জন্য বিনাশ্রম কারাবাস ও মুদ্রক সুরেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের তিন মাস কারাবাসের আদেশ হয়।

১৯৪৪ সালে জাতীয় সপ্তাহ সম্পর্কে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আনন্দবাজার সংবাদ প্রকাশ করলে রাজশক্তি পত্রিকাকে সাবধান করে অভিযোগ থেকে রেহাই দেয়। ওই বছর ভারতরক্ষা আইন অনুসারে পত্রিকার বিরুদ্ধে একটি মামলাও হয়।

১৯৪১ সালে সরকারি নির্দেশ অমান্য করার অভিযোগে মামলা হয়। এ মামলায় সম্পাদকের ১৫০ ও মুদ্রকের ৫০ টাকা জরিমানা হয়। ১৯৪২ সালে সুরেশচন্দ্র মজুমদারকে ভারতরক্ষা আইনবলে ২৭ আগস্ট গ্রেফতার করা হয়। ওই সময় বেশ কয়েক দিন পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ থাকে। ১৯৪৬ ও ’৪৭ সালে ইংরেজ সরকার পত্রিকার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

ইংরেজ সরকারের দমননীতি আনন্দবাজারকে তার কর্তব্য থেকে বিরত রাখতে পারেনি। আনন্দবাজার স্বাধীনতাসংগ্রামীর কর্তব্য পালন করেছে। ১৯ বার শাস্তি দিয়ে রাজশক্তি সেদিনকার আনন্দবাজারকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি।

সংবাদ পরিবেশনায় আনন্দবাজার পত্রিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান বাংলা ভাষায় লাইনো টাইপের প্রবর্তন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে দুটি কারণে ১৯৩৫ বিখ্যাত। প্রথমটি ১৯৩৫ সালের ইন্ডিয়া অ্যাক্ট। দ্বিতীয়টি বাংলা ভাষায় লাইনো টাইপের প্রবর্তন। ওই বছর ২৬ সেপ্টেম্বর লাইনো টাইপ শুরু হয়। সেদিন থেকে মুদ্রণশিল্পে এক বিশেষ উন্নতি পরিলক্ষিত হয়।

আনন্দবাজার পত্রিকার সুরেশচন্দ্র মজুমদার বাংলা ভাষায় লাইনো টাইপ প্রবর্তনের জন্য বাঙালির মনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষ বাংলা লাইনো টাইপের পেটেন্ট নিয়ে অনেক অর্থ-উপার্জন করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষ জাতীয়তাবাদে উৎসর্গীকৃত প্রাণ। তার কাছে দেশের উন্নতি, সমাজের উন্নতি ও শিল্পের উন্নতি প্রাধান্য পেয়েছে। দেশীয় শিল্প ও বাণিজ্য প্রসারের জন্য আনন্দবাজার পত্রিকার অবদান কম নয়।

ঠিক একইভাবে বাংলাদেশ প্রতিদিন দেশের শিল্প-বাণিজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নিরন্তর চেষ্টা করে গেছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির মোকাবিলার ব্যাপারে ঢাকার বাংলাদেশ প্রতিদিন এবং কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা একই সুরে কাজ করে গেছে। এখনো যাচ্ছে। দুই কাগজই মনে করে শেষ কথা বলে পাঠকরাই। আনন্দবাজার এখনো কাগজের মূল কথা- চেক, চেক অ্যান্ড রিচেক- এখনো প্রধান বিষয় বলেই মেনে চলেছে। বাস্তবকে তারা কখনো অস্বীকার করেনি।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইস্যুতে আনন্দবাজার বরাবরই কড়া ভূমিকা পালন করেছে। এ ইস্যুতে আনন্দবাজার ছিল জিরো টলারেন্স। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সারা দেশ যখন জ্বলছিল সে সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। তিনি বিরোধী নেতা তথা কংগ্রেসের বিশিষ্ট নেতা এ বি এ গনিখান চৌধুরীকে বলেছিলেন, আপনিই পারেন দাঙ্গা থামাতে। আপনি যান। আমাকে যা করতে বলবেন করব। পাশাপাশি একই ভূমিকা নিয়েছিল আনন্দবাজারও। আনন্দবাজার প্রসঙ্গে বলতে গেলে সন্তোষ কুমার ঘোষের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। তিনিই এ বঙ্গে সংবাদপত্রে সাধু ভাষার পরিবর্তে চলিত ভাষা প্রচলন করেছিলেন। মেহেরপুরে মুক্তিযুদ্ধ সরকার শপথ নেওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আমাকে বলেছিলেন, এ জায়গাটার নাম যেন কাগজে না বের হয়। আমি অফিসে ফিরে সন্তোষবাবুকে সে কথা বলায় তিনি তৎক্ষণাৎ মেহেরপুরের নাম দিয়েছিলেন মুজিবনগর। বিদেশি সংবাদমাধ্যমসূত্রে সারা বিশ্ব জেনে গেছিল মুজিবনগরের নাম।

শেষ করার আগে আনন্দবাজারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক উল্লেখ না করলে নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ হয়ে থাকবে। অনেক ঘটনা আছে। আমি নিজে একটি ঘটনার সাক্ষী ছিলাম। এপ্রিলে (১৯৭২) বঙ্গবন্ধুর প্রেস কনফারেন্সে ঢাকায় গণভবনে আমার সঙ্গে ছিলেন আনন্দবাজারের তৎকালীন চিফ রিপোর্টার শিবদাস ভট্টাচার্য (বাংলাদেশের মাগুরায় বাড়ি)। তাকে দেখেই পরম আতিশয্যে ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তারপর বলেছিলেন কীভাবে তিনি প্রেস নোট নিয়ে শিবদার কাছে যেতেন। অনেক পুরনো স্মৃতি উঠে এসেছিল সেদিন।

 লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক  (ভারত)।

সর্বশেষ খবর