সোমবার, ১৫ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্রের সামাজিক দায়বদ্ধতা

ফরিদা আক্তার ববিতা

চলচ্চিত্রের সামাজিক দায়বদ্ধতা

চলচ্চিত্র তো সমাজের দর্পণ। দেশ, সমাজ ও মানুষের চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি, আচার-আচরণ তুলে ধরা হয় চলচ্চিত্রে। এ জন্য যে কোনো সমাজ বা দেশকে জানতে হলে ওই দেশের চলচ্চিত্র দেখতে হবে। এক্ষেত্রে সেই চলচ্চিত্র হতে হবে অবশ্যই জীবন ঘনিষ্ঠ। একটি দেশের মানুষের আচার-ব্যবহার, সভ্যতা, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, গণতন্ত্র চর্চা, মানবিকতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ সব কিছুর গতি-প্রকৃতি অনুধাবনের জন্য তথ্য প্রদানে চলচ্চিত্র আয়নার ভূমিকা পালন করে।

কোনো একটি দেশের চলচ্চিত্রের আয়নায় চোখ রেখে একজন ভিনদেশি সেদেশের কৃষ্টি, সভ্যতা ও মানুষের মনন উপলব্ধি করতে পারেন। বুঝতে পারেন সেদেশের গণতন্ত্র চর্চা, প্রশাসনিক সেবা, সামাজিকতা, প্রেম, সংগীত, পরিণয়, বিরহের স্বরূপসহ পরিপূর্ণ সমাজমানস। এ বিচারে বলা যায়, চলচ্চিত্র সত্যের সাক্ষী। বাস্তবতা উপস্থাপনকারী। চলচ্চিত্র সত্যকে তুলে ধরে জাতিকে ইতিহাসবিকৃতি থেকে বাঁচায়।

একটি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্ম ও রক্ষাকবচও বলা যায় চলচ্চিত্রকে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ইতিহাসও বলা হয়ে থাকে চলচ্চিত্রকে। এক্ষেত্রে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ কিংবা চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’ চলচ্চিত্রের নাম নির্দ্বিধায় উল্লেখ করা যায়। এ ছাড়া সমাজ সংস্কারের বাণী ফুটে উঠেছে আমজাদ হোসেনের নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, ভাত দে, কসাই  প্রভৃতি ছবিতে।

আখতারুজ্জামানের ‘পোকা মাকড়ের ঘর বসতি’ ছবিতে একটি জনগোষ্ঠীর যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনের ছবি মূর্ত হয়ে উঠেছে। এ উপন্যাসটি লিখেছেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক বেগম সেলিনা হোসেন। এমন জীবন ঘনিষ্ঠ প্রচুর ছবি নির্মাণ হয়েছে আমাদের দেশে। এ ধরনের সমাজের দর্পণ বলতে আমরা মসিউদ্দীন শাকেরের ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’, দহন কিংবা আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘এখনই সময়’ চলচ্চিত্রের নাম উল্লেখ করতে পারি। এসব ছবি সমাজ সংস্কারে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে।

১৯৭৬ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন ভাই নির্মাণ করেছিলেন ‘নয়নমণি’ ছবিটি। এটি তার বিখ্যাত ‘নিরক্ষর স্বর্গে’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। ছবিটির গল্প ছিল সামাজিক কুসংস্কার ও গ্রাম্য শোষক মোড়ল শ্রেণির বিরুদ্ধে বিশাল একটি প্রতিবাদ। আরেক খ্যাতিমান নির্মাতা জহির রায়হান স্বাধীনতার আগেই পাকিস্তানি শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে অগ্নিঝরা প্রতিবাদের ছবি হিসেবে নির্মাণ করেছিলেন ‘জীবন থেকে নেয়া’র মতো বিখ্যাত একটি ছবি। যে ছবিতে একটি পরিবারকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে পাক দুঃশাসন ও এর থেকে পরিত্রাণের পথ দেখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ছবিটিকে স্বাধীনতার যুদ্ধের ভিত্তিপ্রস্তরও বলা যায়। আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, সুন্দরী, ভাত দে ছবিগুলোতেও সমাজের মুনাফাখোর মজুদদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সাহস দেখানো হয়েছে। আবদুল্লাহ আল মামুন তার ‘এখনই সময়’ ছবিতে বেকারত্বের জ্বালায় বিপথগামী হওয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। শেখ নেয়ামত আলীর ‘দহন’ ছবিটিও তাই। খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ’ ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে বাস্তব দর্শন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক ঘরেই রয়ে গিয়েছিল আলবদর রাজাকারদের দোসররা। তারা দেশকে ধ্বংসে প্রশাসন যন্ত্রের সব ক্ষেত্রে অস্থিরতা তৈরির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। স্বাধীন দেশে এমন অপশক্তির মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা সহ্য করতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া একদল কলেজপড়ুয়া তরুণ। তারা আবার হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। কিন্তু তাদের কলেজের অধ্যক্ষ তাদের আইন হাতে তুলে নেওয়া থেকে বিরত করেন। নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’ ছবিতেও আমরা প্রায় একইরকম দুঃস্বপ্ন থেকে উদ্ধারের চিত্র দেখতে পাই। আবদুল্লাহ আল মামুনের আরেক ছবি শহীদুল্লাহ কায়সার রচিত ‘সারেং বউ’তে দেখি একজন সারেংয়ের যাপিত জীবনের যন্ত্রণাক্লিষ্ট চিত্র। এসব ছবির ভিড়ে কাজী জহির নির্মাণ করেন প্রেমের বৃত্তে সামাজিক নানা অবক্ষয়ের চিত্র সমৃদ্ধ ছবি অবুঝ মন, ময়নামতি, বধূবিদায় প্রভৃতি। ছবিগুলো দর্শক ব্যাপকভাবে গ্রহণ করে। একই সঙ্গে নির্মাণ হয় শিশুতোষ চলচ্চিত্র এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, ডুমুরের ফুলসহ অনেক ছায়াচিত্র। এসব ছবি শুধু দর্শককেই মুগ্ধ করেনি। জাতীয় সম্মাননাও বয়ে এনেছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ।

একসময় কী জমজমাটই না ছিল এ দেশের সিনেমা হলগুলো! চিরচেনা চরিত্রের ভিড়ে সামাজিক সেন্টিমেন্টের সিনেমাগুলো ছিল হাসিকান্নার সিকোয়েন্সে ভরপুর। দর্শক প্রাণভরে উপভোগ করে তৃপ্তি নিয়ে সিনেমা হল থেকে বেরিয়েছেন। এরপর কয়েকটা দিন ছায়াছবির দৃশ্যগুলো দর্শকের স্মৃতিপটে থেকে যেত। কল্পনায় নায়ক-নায়িকার চরিত্রের মধ্যে আবিষ্কারের চেষ্টা করতেন নিজেকে। আর এখন? দেশি চলচ্চিত্রের দৈন্য।

অনেকে হয়তো ভাবেন সিনেমায় অভিনয় করে আমি অনেক টাকা কামাব-এ বিষয়টা অবশ্য আমার ভিতরে কোনো দিন কাজ করেনি। বরাবরই চেয়েছি নিজের অভিনীত সিনেমা নিয়ে দেশ-বিদেশের নামকরা সব চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেব। আমার অভিনীত সিনেমা দেখে সবাই হাততালি দেবেন-এ ব্যাপারটা আমার মধ্যে বেশ নাড়া দিত। এখন সে অবস্থা দেখছি না। গল্প নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছি না। যে ধরনের সিনেমা নির্মিত হচ্ছে, সেগুলো সে অর্থে যেমন ব্যবসায়িক সফলতা পাচ্ছে না; তেমনি দর্শকপ্রিয়ও হচ্ছে না। এখনকার চলচ্চিত্রের এ অবস্থা দেখে গভীর চিন্তার মধ্যে আছি। কবে যে আমরা এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসব, তা-ও বুঝতে পারছি না। তারপরও আমি সব সময় আশাবাদী। আমি এই জগৎটাকে সব সময় ভালোবাসি। আমি চাই, আবারও ভালো ভালো সিনেমা হবে। কেউ কেউ যে ভালো সিনেমা বানাচ্ছে না-তা আমি বলব না। ভালো গল্প, ভালো স্ক্রিপ্ট, ভালো ডায়ালগ-সবকিছু মিলিয়ে যেটা হবে সেটাই ভালে সিনেমা।

আমজাদ হোসেন, জহির রায়হানদের সিনেমাগুলো যে ধরনের হতো-সেগুলোকে আমি বলব, ফুল প্যাকেজের মুভি। এখন অনেক সিনেমা বানানো হলেও সিনেমা হলে অল্প কিছু দর্শক দেখা যায়। সব ধরনের লোককে দেখতে হবে সিনেমা। আমার কথা, এমন সিনেমা বানান যেগুলো বক্তব্যপূর্ণ ও সুন্দর হবে, আবার সমাজের জন্য বার্তাও থাকে; আবার ব্যবসায়িকভাবেও সাফল্য পাবে।

অনেক ব্যবসায়ী আমাদের ফিল্মে ঢুকে গেছে। তারা ব্যবসাটাকেই বেশি প্রাধান্য দেন। এ থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। আগে পরিবার নিয়ে সিনেমা হলে যাওয়া যেত। তখন হলের পরিবেশ অনেক সুন্দর ছিল। হলে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ছিল। সবার তো আর গাড়ি ছিল না; রিকশায়, হেঁটে যে যেভাবে পারতেন সিনেমা হলে যেতেন। কিন্তু এখন অনেকে হলে যান না। অনেকে এখন ভাবছেন ঘরে বসেই তো আমরা টিভি চ্যানেলে বাংলাদেশের, বলিউডের ও হলিউডের হিট সিনেমাগুলো দেখতে পাচ্ছি। তাহলে হলে যাব কেন? এজন্য হলের পরিবেশ ও নিরাপত্তার দিকে জোর দেওয়া উচিত।’

আমাদের দেশের চলচ্চিত্র এক সময় ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যমন্ডিত। এ দেশের চলচ্চিত্রকাররা যুগে যুগে তাদের নির্মাণের মধ্য দিয়ে এ সমৃদ্ধি অর্জনে অবদান রেখেছেন। নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিরলস সাধনার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রকাররা অনবদ্য কাজ করেছেন। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সমাজের ‘আয়না’র ভূমিকা পালন করতে পারছে কি? না, তা পারছে বলে মনে হয় না। কারণ, কিছু চলচ্চিত্র নির্মাতা সমসাময়িক নানা ইস্যু চলচ্চিত্রে যেভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন, তারা সে দায়িত্ব পালন করছেন না। সমসাময়িক বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে সমাজ, দেশ ও মানুষকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে অনেকে। ভিনদেশি সংস্কৃতির স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। সমাজের শরীরের ক্ষতস্থানগুলোকে লুকিয়ে রেখে কিছু চলচ্চিত্রে সমাজকে অসম্পূর্ণভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। এটি অবশ্যই অবক্ষয়। যার ফলে একদিকে সমাজে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব অন্যদিকে দেশের চলচ্চিত্র হারাচ্ছে তার কৌলীন্য।

এদেশে চলচ্চিত্রের জন্মলগ্ন থেকেই চলচ্চিত্রকাররা সামাজিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে গল্প শাণিত করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছে। এখনকার অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং শিল্পীদের কাজে সুবিধাবাদ ও বণিকবৃত্তির প্রভাব পড়েছে।

এখন আর ‘জীবন থেকে নেয়া’র মতো সিনেমা হয় না। সেখানে পড়েছে হিন্দি সিরিয়াল ও বলিউডের প্রভাব। আমার মতে, দেশ-বিদেশে একটি দেশের সমাজ, রাষ্ট্র ও জনগণের যাপিত জীবনের ছবি তুলে ধরতে চলচ্চিত্রের বিকল্প নেই। সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। সমাজ  বিনির্মাণে আমরা আবারও জীবন ঘনিষ্ঠ ছবি নির্মাণ করতে পারি। এর জন্য প্রয়োজন দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ ও সুস্থ মানসিকতা।

লেখক : অভিনেত্রী।

সর্বশেষ খবর