সোমবার, ১৫ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

কূটনীতিকের চোখে সাংবাদিকতার প্রত্যাশা

ওয়ালিউর রহমান

কূটনীতিকের চোখে সাংবাদিকতার প্রত্যাশা

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। রাষ্ট্রের তিনটি অপরিহার্য অঙ্গ আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মতো সংবাদপত্রও যেন আরেকটি অপরিহার্য অঙ্গ।

গণমাধ্যম আধুনিক সমাজের একটি অপরিহার্য অংশ। সমাজের উপরিকাঠামো, অবকাঠামো কিংবা মানবীয় আচরণের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণমাধ্যম জনগণকে প্রভাবিত করে ও বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করে। সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশে গণমাধ্যম নতুন যুগের সূচনা ঘটায়। গণমাধ্যমের ভূমিকা শুধু সংবাদ পরিবেশন ও বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সংবাদকর্মীরা বা সাংবাদিকরা দেশের সাধারণ মানুষ ও রাষ্ট্রের মধ্যে মেডিয়েটর বা মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ও চাহিদার বহিঃপ্রকাশ সাংবাদিকদের মাধ্যমে নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছায়। তারা নতুন নতুন ধারণা ও বিষয় মানুষের সামনে হাজির করে। গণমাধ্যমকর্মীরা তাই সমাজের শিক্ষক ও গাইড হিসেবেও কাজ করে। সমাজের গতিধারা ও নতুন প্রবণতাগুলোর সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ হাজির করে গণমাধ্যম।

মার্কিন সাংবাদিক ওয়ালটার লিপম্যানের মতে, সাংবাদিকরা জনগণ ও নীতিনির্ধারণী এলিটদের (রাজনীতিক, নীতিনির্ধারক, আমলা, বিজ্ঞানী) মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে। সংবাদকর্মীরা এলিট শ্রেণি থেকে শুরু করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবার কথা শোনে, দেখে এবং জনগণকে শোনার, দেখার এবং পড়ার ব্যবস্থা করে দেয়। এই দেখা, শোনা এবং লেখা ছুঁয়ে যায় অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি সর্বত্র। তার ভাষায় ‘Views are personal but news is sacred..’ লিপম্যান তাই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ হিসেবে দেখেন গণমাধ্যমকে। তার মতে, সাংবাদিকতায় সত্য প্রকাশের চেয়ে উচ্চতর কোনো আইন নেই। 

বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে যোগাযোগবিদ ড্যানিয়েল লার্নার গণমাধ্যমকে সমাজ পরিবর্তনের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেন।

সব দেশের গণমাধ্যম যে স্বাধীন সেটা বলা যাবে না। আমাদের দেশের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিককদের স্বাধীনতা আছে বলে আমি মনে করি। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, কোনো দেশে স্বাধীন গণমাধ্যম থাকলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হানা দিতে পারে না।

থমাস জেফারসন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। জেফারসন ছিলেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে একজন প্রবাদপুরুষ। তিনি একবার বলেছিলেন, আমাকে যদি এ বিকল্পটি দেওয়া হয় যে তুমি কি সংবাদপত্রবিহীন সরকার চাও, না সরকারবিহীন সংবাদপত্র চাও? তখন আমি পরেরটা বেছে নেব। এখানে তিনি সংবাদপত্রকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

হার্বার্ট মার্শাল ম্যাকলুহান, ইংরেজি সাহিত্যে কানাডীয় অধ্যাপক ও দার্শনিক ছিলেন। পরবর্তীকালে মার্শাল ম্যাকলুহান প্রচারমাধ্যমের দিকে ঝুঁকে পড়েন। বিজ্ঞাপন ও টেলিভিশন শিল্পে তিনি কিছু বিষয়ে ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে কাজ করে গেছেন। ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং মিডিয়া : দ্য এক্সটেনশনস অব ম্যান’। তাঁর অন্যতম সেরা গ্রন্থ। এ গ্রন্থে প্রচারমাধ্যমের প্রভাবে তাদের কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ দিকে ধাবিত হওয়ার কথা তুলে ধরা হয়। এখানে বিভিন্ন মাধ্যম কীভাবে সমাজে প্রভাববিস্তার করে তারই চেষ্টা সম্পর্কে বুঝানো হয়েছে। ম্যাকলুহানের মতে, প্রচারমাধ্যম বিভিন্নভাবে ভূমিকা রাখছে। এটি শুধু তথ্য সরবরাহ করেই ক্ষান্ত হয় না বরং প্রচারমাধ্যম নিজেই একটি অন্যতম চরিত্র। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ‘অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর মানুষ ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবহার করে যোগাযোগ করবে। তার ভবিষ্যদ্বাণী আজ সবার চোখের সামনে।

বিষয়টি যেহেতু ছিল কূটনৈতিকের চোখে সাংবাদিকতার প্রত্যাশা। তাই আমি একজন কূটনৈতিক হিসেবে বলব, সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে এ কাজটি করতে হয়। একজন সাংবাদিককে সবার আগে তার কাজের প্রতি সৎ, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান হতে হবে। তার সংগ্রহ করা সংবাদগুলো সঠিক তথ্যবহুল হতে হবে এবং পরিমার্জিত ও সাবলীল হতে হবে, যাতে পাঠক লেখাটি পরে সহজে বুঝতে পারে। কোনো বিভ্রান্তিমূলক কথা প্রকাশ করা ঠিক নয়। এতে করে অনেকের সম্মান ক্ষুণ্ন হয়। পাঠকের আস্থা অর্জন করা অনেক বড় একটা ব্যাপার। সাংবাদিকদের উচিত দেশ ও জনগণের জন্য যেটা ভালো হবে এমন খবর প্রকাশ করা, সংবাদকে বিকৃতি করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ঘটনাকে বিকৃত করে, এমনকি কখনো কখনো মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের মতো অসদাচরণের দৃষ্টান্তও কম নয়। নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে সংবাদ পরিবেশন প্রতিটি সংবাদপত্রের প্রাথমিক দায়িত্ব। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ না হলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আঘাতপ্রাপ্ত হয়। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে অনেক সচেতন। মিডিয়া নিয়ে তার চিন্তাভাবনা অনেক বিস্তৃত।

১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮-তে বাংলাদেশের সংসদে কণ্ঠভোটে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ পাস হয়। এ আইনটি প্রস্তাবের পর গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমের কর্মীসহ বিভিন্ন মহল তীব্র সমালোচনা করে। ৩২ ধারায় হয়রানির শিকার হতে পারেন বলে আশঙ্কা করেছিলেন সাংবাদিকরা।

৩২ ধারা অনুযায়ী যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার কোনো ধরনের গোপনীয় বা অতি গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা সংরক্ষণে সহায়তা করেন তাহলে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ বলে গণ্য হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণমাধ্যমের কর্মীরা আলোচনায় বসেছিলেন। তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের মতামত নিয়েছেন। আমি নিশ্চিত যে, দেশ ও দেশের জনগণের জন্য যেটা ভালো হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন। আশা করি খুব দ্রুত তাদের মধ্যে একটি সমঝোতা স্বাক্ষর হবে।

তবে বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মিডিয়াকর্মীদের যে সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন এটা সবার জন্য সুখবর। তিনি তাদের নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন, তাদের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখচ্ছেন। এটাকে আমরা সমর্থন করি। সাধুবাদ জানাই।

আমরা যারা কূটনীতিক ছিলাম বা এখন যারা আছেন এদের কাজ শুধু দেশের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এদের কাজের পরিধি ব্যাপক। কূটনীতিকদের বিশ্বের অনেক দেশে গিয়ে কাজ করতে হয়, দেশের স্বার্থে অনেক দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হয়। এরা দেশের ভাবমূর্তি অক্ষুণœ রাখায় নিরলস পরিশ্রম করে যায়। আমি যখন সক্রিয় কূটনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম বঙ্গবন্ধুর সময়ে তখন তার সঙ্গে থেকে অনেক সংস্থার সদস্যপদ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। মুজিবনগর সরকারের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হয়ে অনেক দেশে ঘুরেছি, কাজ করেছি। এই কূটনৈতিকরাই অন্য দেশে গিয়ে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দেশের জন্য কী ভূমিকা রাখছে তা আমাদের সংবাদকর্মীরাই এসব তথ্য তাদের সংবাদে তুলে ধরেন।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা অনেক দেশ জানত না। কিছু সাংবাদিককর্মীই এ সংবাদ বহির্বিশ্বে প্রচার করেছিলেন বলেই কিছু দেশ তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং পাকিস্তানিদের বর্বরতার কথা জেনে ছিল। বিশেষ করে, সায়মন ড্রিং বাংলাদেশের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম বিদেশি সাংবাদিক, যিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেন পাকিস্তানি বাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতন ও গণহত্যার কথা।

এভাবেই গণমাধ্যম তার ভূমিকা রেখে চলেছে দিনের পর দিন। এ ছাড়া যেখানে আইডেন্টিটি পলিটিক্স আছে সেখানে গণমাধ্যম কর্মীরা ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। এর কারণে পাকিস্তানে প্রায় ৫০ জন সংবাদকর্মী জেলে আছেন, এরকম ভারতে এবং চায়না ও ফিলিপাইনেও কিছু সংবাদকর্মী জেলে আছেন। আর এটার কারণ আইডেন্টিটি পলিটিক্স। আইডেন্টিটি পলিটিক্স যেখানে আছে সেখানেই সাংবাদিকদের সমস্যা হচ্ছে এবং হবে। ভারতে সিভিল সোসাইটি অনেক শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি তেমন শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে খুব কঠিন সময়েও গণমাধ্যম সাহসী ভূমিকা রেখেছে এবং রাখছে।

উদাহরণ স্বরূপ বর্তমানে করোনার চ্যালেঞ্জকে যেভাবে আমরা গ্রহণ করতে পেরেছি বা মোকাবিলা করতে পারছি তার পিছনে প্রধান ভূমিকা ছিল মিডিয়ার। এ ক্ষেত্রে  মিডিয়ার যে রোল ছিল তা দেশবাসী কখনো ভুলবে না। কভিড-১৯ এর বিষয়ে আমাদের দেশে ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার যে ভূমিকা তা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এখানে তাদের জীবনেরও ঝুঁকি ছিল, অনেক জায়গা লকডাউন ছিল, কিন্তু সেটা তারা পরোয়া না করে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করে মানুষের দ্বারে পৌঁছে দিয়েছে। এখানে তারা সত্যিই অনেক সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে।

আরেকটি উদাহরণ- রোহিঙ্গা বিষয়। রোহিঙ্গারা কী পরিস্থিতির মধ্যে দিনযাপন করছে এবং বাংলাদেশ তাদের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখছে, বিশেষ করে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। মিডিয়াকর্মীরা রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন খবরাখবর বহির্বিশ্বে প্রচার করেছে বলে বিভিন্ন দেশ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং বিভিন্ন দেশ থেকে মন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, রাষ্ট্রদূতরা বাংলাদেশে এসে তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে গেছেন এবং সাহায্য করেছেন। কীভাবে সমাধান করা যায় সে বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।

এভাবে গণমাধ্যম বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটার পর একটা তাদের ভূমিকা রেখে যাচ্ছে যা সত্যিই অকল্পনীয়।

আগামী ১৫ মার্চ ২০২১ বাংলাদেশ প্রতিদিন দ্বাদশ বর্ষে পদাপর্ণ করছে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের পত্রিকা বের হচ্ছে। তার মধ্যে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া তো আছে। এসবের মধ্য থেকেও বাংলাদেশ প্রতিদিন ১২টি বছর পার করল। এটা সত্যিই একটি চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার।

বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে একটি পত্রিকার সগৌরবে টিকে থাকার নজিরও এ দেশে খুব বেশি নেই। তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে নিজের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে চলা, পেশাদারিত্ব প্রমাণ করা এবং জনমানসে নিরপেক্ষতার ধারণাকে বাঁচিয়ে রাখা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য বিষয়। যেটা বাংলাদেশ প্রতিদিন করতে পেরেছে। আশা করি বাংলাদেশ প্রতিদিন তার নিজস্ব  বৈশিষ্ট্য, অনন্য অর্জন ও নৈতিক আদর্শ নিয়ে এগিয়ে যাবে। গণমানুষের আস্থা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে থাকবে।

 

লেখক : কূটনীতিক।

সর্বশেষ খবর