মঙ্গলবার, ১৬ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

আনন্দবাজার ও আমার সাংবাদিকতা

জয়ন্ত ঘোষাল

আনন্দবাজার ও আমার সাংবাদিকতা
১৯২২ সালের ১৩ মার্চ, দোলযাত্রার দিনই আনন্দবাজার পত্রিকার যাত্রা হয়েছিল। এক পরাধীন ভারতবর্ষে লাল কাগজে ছাপা আনন্দবাজার পত্রিকার জন্ম। তখন মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন সবে শুরু হয়েছে। জন্মদিন থেকে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি ১৯৪৭ সালে। বহুবার রাজরোষে পড়তে হয়েছে সেই আনন্দবাজার পত্রিকাকে।

 

আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দেওয়ার পর যেদিন প্রথম কলকাতায় সদর দফতরে গেলাম, একটা বিশাল সাদা প্রাসাদ! সেই বাড়ির ঝাঁ তকতকে মেঝেতে এসে দাঁড়াতেই সামনে দেখলাম প্রয়াত অশোক কুমার সরকারের একটি তৈলচিত্র। তৈলচিত্রটির শিল্পী প্রয়াত বিকাশ ভট্টাচার্য। সত্যিই আমার রোমাঞ্চ হচ্ছিল। আমি তো আনন্দবাজার পত্রিকার দিল্লির অফিসে যোগ দিয়েছিলাম। তারপর তৎকালীন সম্পাদক মশাই অভীক কুমার সরকার আমাকে বললেন কলকাতায় আসতে এবং অফিস দেখতে এবং অফিসের যারা সহকর্মী, তাদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করতে। আমি তার আগে বর্তমান খবরের কাগজে কাজ করতাম। সুতরাং কলকাতার বর্তমান কাগজ থেকে আনন্দবাজার পত্রিকায় আসা, -এটা আমার কাছে একটা বিরাট যাত্রাপথ। তখন আনন্দবাজারের এক্সিকিউটিভ এডিটর ছিলেন সুমন চট্টোপাধ্যায়। তিনিও খুব উৎসাহ দিয়ে বললেন, যাতে আমি কলকাতায় এসে সবার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করি। আনন্দবাজার একটা সিস্টেম। কলকাতায় এটা তো শুধু খবরের কাগজ নয়, এটা একটা প্রতিষ্ঠান, এটা একটা সাংস্কৃতিক হেজেমনি। যদিও করোনাকালে অনেক সমস্যা, অনেক সংকট দেখা দিয়েছে।

১৯২২ সালের ১৩ মার্চ, দোলযাত্রার দিনই আনন্দবাজার পত্রিকার যাত্রা হয়েছিল। এক পরাধীন ভারতবর্ষে লাল কাগজে ছাপা আনন্দবাজার পত্রিকার জন্ম। তখন মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন সবে শুরু হয়েছে। জন্মদিন থেকে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি ১৯৪৭ সালে। বহুবার রাজরোষে পড়তে হয়েছে সেই আনন্দবাজার পত্রিকাকে। ১৯২৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বাঙালি বীর জ্যোতিন্দ্রনাথ সম্পর্কে সম্পাদকীয় প্রকাশের জন্য ভারতীয় দন্ডবিধির ‘১২৪-ক’ ধারা অনুসারে আনন্দবাজার পত্রিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল এবং প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রফুল্ল কুমার সরকার ও মুদ্রাকর অধর চন্দ্র দাসকে রাজদ্রোহের অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। জামিন দেওয়ার প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে সম্পাদক আর মুদ্রাকরকে জেল হাজতে রাখা হয় এবং পরে তারা মুক্তি পান।

আমি যখন আনন্দবাজার পত্রিকার অফিসে অশোক বাবুর ছবিটি দেখে, লিফটে উঠলাম এবং সেকেন্ড ফ্লোরে অভীক সরকারের ঘর এবং তারপর বার্তা দফতরে গেলাম তখন আমার বারবার এসব কথা মনে পড়ছে যে, এই সাদা বাড়িটির পাশের রাস্তাটির নাম প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট আর এই রাস্তা দিয়ে আমি বারবার হেঁটে গেছি। এই আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে প্রকাশিত দেশ পত্রিকায় একটা ছোট চিঠি কলেজ জীবনে প্রকাশিত হয়েছিল, ‘ধর্ম এবং বিজ্ঞান’ সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে। সেই চিঠিটা পর্যন্ত আজও আমার কাছে আমি রেখে দিয়েছি যা সযত্নে লালিত। কেননা, দেশ পত্রিকা আজও আমার কাছে একটা অসম্ভব ভালোবাসা আর আবেগের সঙ্গে যুক্ত। এই দেশ পত্রিকার যে লোগোটা, সেটাও সত্যজিৎ রায় করে দিয়ে গেছিলেন। এরকম একটা সংবাদপত্র হচ্ছে আনন্দবাজার পত্রিকা এবং সেই পত্রিকায় আমি কাজ করবার সুযোগ পেয়েছি। সুতরাং প্রথম দিন থেকেই একটা অদ্ভুত আনন্দ আমার মধ্যে কাজ করেছিল। এমন নয় যে, আমি বর্তমান ছাড়তে চেয়েছিলাম। বর্তমান পত্রিকাতেও আমি দীর্ঘদিন কাজ করেছি। খুব আনন্দ সহকারে প্রয়াত বরুণ সেনগুপ্তর কাছ থেকে কাজ শিখেছিলাম। বরুণ সেনগুপ্ত তো আনন্দবাজারেরই সৃষ্টি, আনন্দবাজার থেকেই তো বরুণ সেনগুপ্ত নামক ব্যক্তিত্বটির জন্ম হয়েছে। তিনি একটা সাংঘাতিক কান্ড করেছিলেন! তিনি একটি পৃথক সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করে সেটাকে সফলতার দ্বারে পৌঁছে দিয়েছেন এবং আজ বর্তমান পত্রিকা তার নিজের গৌরবে সম্পূর্ণ সম্মানের সঙ্গে সাধারণ মানুষের মন জয় করে দুর্দম বেগে কতটা এগিয়ে গেছে। যখন আমি বর্তমান কাগজ থেকে আনন্দবাজার পত্রিকায় এলাম তখন কলকাতার এক বিশিষ্ট শিল্পপতি, রমা প্রসাদ গোয়েঙ্কা, রাজস্থানের মানুষ হলেও কয়েক দশক ধরে তিনি কলকাতার বাসিন্দা। তিনি বাঙালিই হয়ে গেছিলেন। সেই প্রয়াত রমা প্রসাদ গোয়েঙ্কা তখন রাজ্যসভার সদস্য। তাঁর রাজস্থানি হিন্দির টানে তিনি কথা বলতেন। তিনি আমাকে একদিন বললেন, ‘আপনি কিন্তু খুব ভাগ্যবান আছেন। বরুণ সেনগুপ্তের কারখানায় আপনি কাজ শিখেছেন আর অভীক আপনাকে দুনিয়া দিখাচ্ছে।’ এই যে এক কথায় উনি আমাকে বলেছিলেন যা আজ এত বছর পর আমার মনে হয়, এ কথাটা একটা সাংঘাতিক সত্য যে, আনন্দবাজার পত্রিকা এমন একটা সংবাদপত্র, যেটা অভীক বাবু বলতেন, তুলনা যদি করতে হয় তাহলে কাগজটার তুলনা করবে, নিজেকে বড় ভাববে, ছোট ভাববে না। নিউইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে তুলনা করবে, তুমি ওয়াশিংটন পোস্টের সঙ্গে তুলনা করবে। বিভিন্ন ইকোনমিক্স পত্রিকার সঙ্গে তুমি তোমার পত্রিকার তুলনা করবে। তবে তো তুমি নিজেকে আরও উন্নত, নিজেকে বড় করতে পারবে।

একবার যেরকম অভীক বাবু বললেন, প্রত্যেকদিন কাগজে কি ভুল বেরোচ্ছে, সেই ভুলগুলো আমরা প্রতিদিন ছাপলে কেমন হয়? এডিটোরিয়াল মিটিংয়ে এ নিয়ে যখন আলোচনা হলো তখন তৎকালীন বার্তা সম্পাদক হীরক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘অভীক বাবু, আপনি যে স্তর থেকে কথাটা বলছেন সেটা খুবই ভালো কিন্তু কী জানেন, এটা নিয়ে আমাদের যারা প্রতিপক্ষ, তারা তো আমাদের যে সাংবাদিকতার মান সম্পর্কে আমাদের যে মানসিকতা বা আমাদের যে দর্শন, সেটা বুঝবে না। উল্টে প্রচার করবে চারদিকে, গাঁয়ে-গঞ্জে যে, দেখো, প্রতিদিন আনন্দবাজারে কত ভুল বেরোয় এবং সেগুলো ওদের স্বীকার করতে ওরা বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ভুল অন্য কাগজে থাকে। তারা যদি স্বীকার না করে তাহলে খামোখা আমরা স্বীকার করে আমাদের এরকম বদনামের কেন ভাগিদার হই? সুতরাং সেটার একটা বাস্তব যুক্তি হীরকের ছিল। কিন্তু অভীক বাবু বললেন, না, তুমি বুঝতে পারছ না। তোমরা যদি এই ভুলটা স্বীকার করে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন কর, অন্যদের কথা ভেবো না। তোমরা যদি ভুল স্বীকার কর।

আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা প্রফুল্ল কুমার সরকার ১৮৮৪ সালে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত কুমারখালীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা প্রসন্ন কুমার সরকার খুব খ্যাতনামা সাংবাদিক ছিলেন। পাবনা জেলা স্কুল আর কলকাতা জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইনস্টিটিউশনে পড়াশোনা করেছিলেন। ১৯০৫ সালে বাংলায় প্রথম স্থান অধিকার করে বিএ পাস করেছিলেন। বঙ্কিম পদক পর্যন্ত পেয়েছিলেন। ১৯০৮ সালে বিএ পাস করে ফরিদপুর আর ডালটনগঞ্জে তিনি কিছুদিন ওকালতি করলেন। তারপর উড়িষ্যার ঢেঙ্কানলে রাজ পরিবারের গৃহশিক্ষক হন। তখনকার দিনে সেরকমভাবে রাজপরিবারে গৃহশিক্ষক বিযুক্তও করা হতো এবং সেটা খুব সম্মানের পদ হতো। ক্রমে দেওয়ান পদক লাভ করেছিলেন রাজাদের কাছ থেকে। তিনি বন্ধু, সুরেশ চন্দ্র মজুমদারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিষ্ঠা করলেন। ১৯২২ সালের ১৩ মার্চ পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশ হলো। ৯ সেপ্টেম্বর তিনি বাঘা যতীনের জীবনী এবং তাঁর ওপর সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশ করে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। সে কথা আগেই বলেছি।

১৯৪১ সাল থেকে আমৃত্যু আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। এ ছাড়াও তাঁর কথা সাহিত্য, প্রবন্ধ সাহিত্য রচনা খুব উল্লেখযোগ্য ছিল। ওঁর বন্ধু সুরেশ মজুমদার, তিনি নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবার নাম ছিল মহেন্দ্রনাথ মজুমদার। বিপ্লবের কাজে যুক্ত ছিলেন। আবাল্য বন্ধু প্রফুল্ল কুমার সরকারের সহযোগিতায় আনন্দবাজার পত্রিকা প্রকাশ করেন। তাঁর জীবনের অক্ষয়কীর্তি হচ্ছে বাংলা লাইনো টাইপের প্রবর্তন। তিনি ১৯৩৩ সালে সাপ্তাহিক পত্রিকা দেশ আর ১৯৩৭ সালে ‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’ দৈনিক পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। এরপর তিনি ধীরে ধীরে প্রফুল্ল বাউর পুত্র অশোক কুমার সরকার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁর আদি নিবাস ছিল নদীয়ার কুমারখালীতে। ১৯১২ সালে তাঁর জন্ম এবং অশোক সরকার কলকাতার টাউন স্কুল এবং স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র ছিলেন। প্রথমে আনন্দবাজারের সংস্থার ডিরেক্টর হন এবং তারপর ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত দেশ পত্রিকার সম্পাদনা করেন। তাঁর কর্মদক্ষতায় আনন্দবাজার গোষ্ঠী থেকে তিনটে দৈনিক, চারটে সাপ্তাহিক, তিনটে পাক্ষিক পত্রিকা বাংলা, হিন্দি ও ইংরাজি ভাষায় প্রকাশিত হতে থাকে। সাহিত্যিকদের উৎসাহ দানের জন্য ‘আনন্দ পুরস্কার’-এর প্রবর্তন তিনিই করেছিলেন। ১৯৬০ সালে বাঙালি তরুণদের নন্দাঘণ্টি পর্বত অভিযানের ব্যয়ভার আনন্দবাজার পত্রিকা বহন করেছিল। ১৯৬৭ সালে তাঁকে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

এহেন আনন্দবাজার পত্রিকায় যখন কাজ শুরু করলাম তখন আমার কর্মস্থল মূলত ছিল দিল্লি। দিল্লিতে সবসময় শুনতাম, টাইমস অফ ইন্ডিয়া-ন্যাশনাল ডেইলি, হিন্দুস্তান টাইমস-ন্যাশনাল ডেইলি। একবার ব্রিটিশ কাউন্সিলে একটা আলোচনা সভার আয়োজন হলো। আমি তখন দিল্লির সাংবাদিক। সেখানে আলোচনার বিষয় হলো, ভাষা সাংবাদিকতা। আগে ভারতে বিভিন্ন ভাষাকে বলা হতো আঞ্চলিক ভাষা। তারপর এই আঞ্চলিক শব্দটা তুলে দেওয়া হলো। কেননা বলা হয়, ভাষাকে কোনো ভৌগোলিক সীমানায় বাধা যায় না। বাংলাদেশের মাতৃভাষা বাংলা, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। ভূগোলের মাধ্যমে ভাষাকে বোঝানোটা একটু মুশকিল হয়ে যায়। সেই কারণে বাংলা শুধু নয়, তামিল, তেলেগু,-এগুলোকে ভাষা সাহিত্য, ভাষা সাংবাদিকতা বলে অভিহিত করা উচিত। যেভাবে ভারতে সাহিত্য একাডেমি আগে আঞ্চলিক সাহিত্য বলত, এখন বলে ভাষা সাহিত্য।

আমি ওই ব্রিটিশ হাইকমিশনের আয়োজিত এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলে অনুষ্ঠিত যে অনুষ্ঠানটা হয়েছিল, সেখানে বক্তা ছিলাম এবং আমি প্রথমেই বলেছিলাম যে, আমি বাংলা কাগজে কাজ করি। তা বলে কি আমি অ্যান্টি ন্যাশনাল? আমিও জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই সাংবাদিকতা করি। কিন্তু বাংলা ভাষায় করি। বাংলায় করি বলে তোমরা বুঝতে পার না। ইংরেজিটা অমনি প্রেজেন্ট ভাষা- কে বলেছে? ইংরাজি ভাষা তো গাঁয়ে-গঞ্জের বহু জায়গার মানুষ বুঝতে পারে না। তাহলে অমনি প্রেজেন্ট ভাষা কেন বলব? অমনি পোটেন্ট কেন বলব? আমার বাংলা ভাষা বহু জায়গায় যেখানে আনন্দবাজার পত্রিকা বিক্রি হয়, সেখানে ইংরেজি সংবাদপত্র হয়তো সেখানে যায় না। তাহলে এখন যেটা বলতে হবে সেটা হচ্ছে, ইংরাজি সংবাদপত্রকে তথাকথিত জাতীয় সংবাদপত্র বলা হচ্ছে। কিন্তু একটা বাংলা ভাষায় লেখা হচ্ছে বলে সেটা জাতীয়তাবাদী নয় বা সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি নেই? এটাও কিন্তু একটা অদ্ভুত মানসিকতা। আনন্দবাজার এই ভাষা সাংবাদিকতার মহিরুহ। এটা একটা লিডার অফ দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ জার্নালিজম ইন আওয়ার কান্ট্রি। আমাদের দেশের একটা ভ্যানগার্ড অফ দ্য সাংবাদিক হলো আনন্দবাজার। আমি বলতাম, আনন্দবাজার হলো সমস্ত বাংলা কাগজের এই মুহূর্তে অভিভাবক। এবং বাংলা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে শিক্ষা অভীক সরকারের কাছ থেকে এবং পরবর্তীকালে অরূপ সরকার অর্থাৎ তাঁর ভাইয়ের কাছ থেকে আমি পেয়েছি সেটার কোনো তুলনা হয় না। আনন্দবাজার পত্রিকায় আমার এখনো মনে পড়ে, সবসময় অভীক বাবু একটা জিনিস বলতেন, যেরকম ভুল স্বীকার করার কথা তিনি শিখিয়েছিলেন। এখন কিন্তু আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রতিদিন প্রতিনিয়ত এখনো ভ্রম সংশোধনের কিন্তু এডিট পেজের নিচে ভুল থাকলে সেটা জানানো হয় এবং সংশোধন করার একটা প্রক্রিয়া চলতে থাকে। বহু মানুষ ভুল ধরিয়ে দিয়ে সেটা কিন্তু জানায়।

আনন্দবাজার পত্রিকার আর একটা জিনিস অভীক বাবু বলতেন, গোটা পৃথিবীতে সাংবাদিকতাটা কীভাবে এগোচ্ছে, সেটা সম্পর্কে তিনি নিজে অবহিত ছিলেন। আমি তো ওঁ’কে বলতাম, আপনি হলেন একজন গ্লোকাল সম্পাদক। অর্থাৎ গ্লোবালই লোকাল। তাই তিনি গ্লোকাল। অর্থাৎ, কলকাতার বালিগঞ্জে বসে, গোটা বিশ্বে কী হচ্ছে, তিনি কিন্তু সেই খবরটা রাখতেন। নতুন শুধু বই বেরোলে তিনি সেই বইয়ের খবর যে রাখতেন বা বই-য়ে কী ছাপা হচ্ছে, সেটা যেমন রাখতেন, সাংবাদিকতায় যেমন উনি বলতেন, শুধু রাজনীতি সর্বস্বতা নয়। বাঙালিদের সংবাদপত্রে একটা ডোমিনেশন আছে রাজনীতি খবরের। কিন্তু একটা খেলার খবর, একটা বিনোদনের খবর, একটা বিজ্ঞানের খবর, স্বাস্থ্যের খবর এবং সেটাকে প্রথম পাতায় নিয়ে আসা, গুরুত্ব দিয়ে ছাপা, সেটাও একটা খুব প্রয়োজনীয় বিষয়। সেটা তিনি কিন্তু এক্সপেরিমেন্ট করতেন। তিনি সায়েন্সের ক্ষেত্রে যেরকম উনি বলতেন, সায়েন্স রাইটার হয়, সায়েন্সের কলামিস্ট হয়। আমি সায়েন্স রিপোর্টার চাই, যে বিজ্ঞানের খবর দেবে। অর্থাৎ, নতুন কোনো খবর দেবে। এখন যেমন করোনার সময় বোঝাই যাচ্ছে, এই বিজ্ঞান সাংবাদিকতার, স্বাস্থ্য সাংবাদিকতার, আবহাওয়া সাংবাদিকতা, পরিবেশ সাংবাদিকতার গোটা পৃথিবী কত এগিয়ে গেছে। আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। এই করোনার সময় বোঝা যাচ্ছে, কতটা গুরুত্ব, কতটা তাৎপর্যপূর্ণ।

শুধু প্রতিষেধক নিয়ে শুধু তো স্বাস্থ্য নয়, তার সঙ্গে রাজনীতি এমনকী কূটনীতি পর্যন্ত জড়িয়ে রয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকায় সেই জিনিসটা কিন্তু সব সময় করেছে। একটা জিনিস যেটা আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে আমাদের বলা হতো, আমাদের একজন সহ-সাংবাদিক বলেছিলেন, আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের একজন টুলে বসা সচিবের ঘরের সামনে বসে থাকা সেই ভদ্রলোক বলেছিলেন, আনন্দবাজারের সব ভালো কিন্তু কী জানেন, বড্ড শক্ত বাংলাটা। মনে হয় একটু জল দিয়ে ভিজিয়ে নরম করে পড়ি। এখন এই যে শক্ত বাংলা, মানে সহজ বাংলায়, মেঠো বাংলায়, চলতি বাংলায় মানুষের কাছে পৌঁছানোটা যে কতটা প্রয়োজন, সেটা সব সময় বর্তমান কাগজ যেরকম যেরকম যে কোনো স্তরের মানুষের কাছে হয় তো অনেক বেশি সহজবোধ্য একটা কাগজ এবং তারা যেটা চাইছে সেটা ক্যাটার করে। সেখানে কিন্তু হয়তো খুব তাত্ত্বিক বা খুব কঠিন একটা বিষয় নিয়ে খুব বেশি একাডেমিক জিনিস সেখানে পাওয়া যায় না বা পরিবেশন করা হয় না। এখানে কিন্তু মেধার উৎকর্ষ আনন্দবাজার সবসময় সেটা কিন্তু চেষ্টা করেছে বাঁচিয়ে রাখতে। একটা সময় তো বাংলা সাংবাদিকতা শুধু নয়, বাংলা সাহিত্যের যাঁরা কুশীলব, সেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রমাপদ চৌধুরী থেকে শুরু করে সমরেশ মজুমদার সবাই আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর সাহিত্যিক গোষ্ঠীর একটা আধিপত্য ছিল এবং সেটা একটা হেজেমনি ছিল। কীভাবে, কেন সেই সাহিত্যিকদের তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সুনীল, শীর্ষেন্দু এবং সমরেশ মজুমদারের এই যে লিগ্যাসিটা, সমাজের একটা নির্ধারক শক্তি হয়ে ওঠা এবং আনন্দবাজার পত্রিকার মাধ্যমে, সেটা কীভাবে কমে গেল বা অনেকটাই অবলুপ্ত হলো এবং রাজনীতির দাপটটা বেড়ে গেল পশ্চিমবঙ্গে। সেটা একটা অন্য গবেষণার বিষয়। সেই রূপান্তরটা সমাজের নাগরিক সমাজে এবং সর্বত্র যে হয়েছে এবং সেটাতে কোনো সন্দেহ নেই। আনন্দবাজার পত্রিকা কিন্তু সবসময় এখনো সচেষ্ট তাদের এই গুণগত মানটাকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়। অভীক বাবু সবসময় বলতেন, আমি আমার একটা আইডোলজি আছে। সেটা তো আমি কম্প্রোমাইজ করব না। তাতে সার্কুলেশন কমে গেলে কমে যাবে। কিন্তু সেটা বোধহয় সবসময় মানা যায় না। কেননা, অরূপ বাবু দায়িত্ব গ্রহণ করার পরে তিনি কিন্তু এই সার্কুলেশনটা যাতে না কমে এবং মানুষই যে আসলে তাঁর কাছে দায়বদ্ধতা রয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকার। অর্থাৎ, মানুষ জানে না, পাঠক জানে না সে কী চায়। আমি পাঠককে জানাব। সেটা যেরকম একটা দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। আনন্দবাজার পত্রিকা কিন্তু এখন তার দৃষ্টিভঙ্গি আবার সেই সাবেকি অশোক সরকারের সময়কার যে দৃষ্টিভঙ্গি, যে বাঙালি পাঠক আমার কাছে সে-ই সার্বভৌম। পাঠকের চাহিদা পূরণ করাটাই আমার কাছে সব থেকে বড় অগ্রাধিকার। আমি পাঠককে ডিক্টেট করব না। পাঠককে আমি নিশ্চয়ই আমার অন্যরা যেটা লঘুভাবে দেবে, আমি সেটা আরও গুরুভাবে দেব। আমি আমার উন্নত মেধা দিয়ে দেব। সু-পরিশীলিতভাবে দেব। কিন্তু তাই বলে আমি একটা সম্পূর্ণ জমির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে এমন কিছু বিষয় নিয়ে একটা আলোচনা করব, সেটা হয় তো ব্রেকটের কলাকৈবল্যবাদ, সেটা নিয়ে যদি একটা সুদীর্ঘ প্রবন্ধ যদি এখন আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়, সেটা রাম, শ্যাম, যদুর টম ডিক হ্যারি। কেউ বুঝতেই পারল না। তাতে মানুষের কাছে যদি পৌঁছাতেই আমি না পারি তাহলে সেটা আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব, আমার গ্রাহক কমবে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও কিন্তু আনন্দবাজার সরে এসেছে। সব মিলিয়ে আমার যেটা মনে হয় যে, আনন্দবাজারের কাজ করার যে অভিজ্ঞতা, সেটা আমার জীবনে একটা বিরল অভিজ্ঞতা। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। প্রতিনিয়ত আমি শিখেছি এবং আমার যেটা মনে হয়েছে যে, আনন্দবাজার পত্রিকা এখনো এগিয়ে চলেছে অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে। গুণগত মান বজায় রাখা এবং তার সঙ্গে সঙ্গে সার্কুলেশনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া,-এটার মধ্যে কিন্তু একটা ভীষণ ডাইগোটমি আছে। সেই ডাইগোটমির মধ্যে দিয়ে, সেই ডায়লেক্টিকসের মধ্যে দিয়ে আনন্দবাজার এখনো এগোচ্ছে এবং এগিয়ে চলেছে আগামী দিন বলবে আনন্দবাজারের ভবিষ্যতের যাত্রাপথ শেষ পর্যন্ত কী হবে!

 লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক [ভারত]।

সর্বশেষ খবর