মঙ্গলবার, ১৬ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধে ১১টি সেক্টরের অনুসরণে গণমাধ্যমকে ১২ নম্বর সেক্টরের মর্যাদা দেওয়া উচিত

লে. কর্নেল জাফর ইমাম (অব.) বীরবিক্রম

মুক্তিযুদ্ধে ১১টি সেক্টরের অনুসরণে গণমাধ্যমকে ১২ নম্বর সেক্টরের মর্যাদা দেওয়া উচিত
সামরিক স্বৈরাচাররা জানত সশস্ত্র বাহিনীর প্রশিক্ষিত সৈনিক-কর্মকর্তারা অবধারিতভাবেই গড়ে তুলবে প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধকে পূর্ণতা দিতে এগিয়ে আসবে ছাত্র-শিক্ষক-শিল্পী-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরা। ঘটনা ঘটেছিলও তাই।

বিগত সহস্রাব্দে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা তথা স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। এই স্বাধীনতার পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী বাঙালি জাতিকে সংগ্রাম করতে হয়েছে বিদেশি দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে। ঔপনিবেশিকতার যে শিকল বাঙালির পায়ে বেড়ি পরিয়ে রেখেছিল তাকে ছিঁড়ে-ভেঙে মুক্তির সম্মিলিত আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হয় এই দীর্ঘ আন্দোলনে ও সংগ্রামে। এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, প্রায় ২০০ বছরের ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা এবং অবসান দুটিই ঘটেছিল এই বাংলায়। পলাশীর রণাঙ্গনে অস্তমিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতা। আবার ঊনবিংশ শতাব্দীতে সেই ইংরেজ রাজশক্তির বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক সিপাহি বিদ্রোহেরও প্রথম ও প্রধান রণাঙ্গন ছিল এই বাংলাদেশ। আন্দোলন ও সংগ্রামের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বাঙালির পরিপূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিফলিত হয় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে। কিন্তু নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে শাসনক্ষমতা ছেড়ে না দিয়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নারকীয় বর্বরতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োজিত বাঙালি কর্মকর্তা ও সৈনিকদের খতম করা এবং একই সঙ্গে সমগ্র দেশবাসীর ওপর গণহত্যা চাপিয়ে দেওয়া, বিশেষ করে ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের ওপর। কেননা সামরিক স্বৈরাচাররা জানত সশস্ত্র বাহিনীর প্রশিক্ষিত সৈনিক-কর্মকর্তারা অবধারিতভাবেই গড়ে তুলবে প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধকে পূর্ণতা দিতে এগিয়ে আসবে ছাত্র-শিক্ষক-শিল্পী-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরা। ঘটনা ঘটেছিলও তাই।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ গণযুদ্ধ। এই গণযুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল সমগ্র জাতি। এর বিরুদ্ধপক্ষ বা ভিন্নমতও ছিল। তবে গণহত্যা, নির্যাতন ও লুণ্ঠনের মতো অপরাধে অংশীদার হয়ে যারা জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তারা ছাড়া সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল স্বাধীনতার সম্মিলিত চেতনায়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে কেবল ঘরে ঘরেই সেদিন দুর্গ গড়ে ওঠেনি, দেশের প্রতিটি মানুষের মনদুর্গে সেদিন একটিই আকাক্সক্ষা প্রতিভাত হয়েছিল এবং তা হলো পশুশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করা। সেই মহান স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধে দেশপ্রেমিক সৈন্য, কর্মকর্তা, ছাত্র-যুবক-শ্রমিক-কিশোর-কবি-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম। পশুশক্তির নির্বিচার গণহত্যার বলি হয়েছিলেন ‘ইত্তেফাক’-এর শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, ‘পূর্বদেশ’-এর এ বি এম গোলাম মোস্তফা, পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল ‘পিপিআই’ বার্তা সংস্থার সৈয়দ নাজমুল হক, বিবিসির নিজামুদ্দিন আহমদ, ‘সংবাদ’-এর শহীদুল্লা কায়সার ও শহীদ সাবের, ‘পাকিস্তান অবজারভার’-এর এস এ মান্নান (লাডু ভাই), সাংবাদিক আবু তালেব, মোহাম্মদ আকবর, আবুল বাশার, চিশতী হেলালুর রহমান, স্মরণ চক্রবর্তী, সেলিনা পারভিন প্রমুখ। জাতীয় প্রেস ক্লাব ভবনের স্মারক প্রস্তরলিপিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী এসব মহান শহীদ সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীদের নাম।

২৫ মার্চের কালরাতে পাকবাহিনী আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগ করে ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাক, পিপলস, পূর্বদেশ, সংবাদ, পাকিস্তান অবজারভার, দৈনিক পাকিস্তানসহ আরও কয়েকটি পত্রিকার অফিসে। আক্রমণ চলে জাতীয় প্রেস ক্লাব ভবনে। এ ছাড়া সারা দেশে সাংবাদিক-লেখক-সাহিত্যিক-শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন ও ব্যাপক ধরপাকড়। অনেকে নিহত হন পাক-বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যা ও নির্যাতন। বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন প্রবীণ সাংবাদিক ভারতে শরণার্থী হয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ সংগঠিত করেন। এই বেতার কেন্দ্রটি হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির কণ্ঠস্বর। এখান থেকে প্রচারিত বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, যুদ্ধ সংগীত, দেশাত্ববোধক গান, কবিতা, সংবাদ ও ধারাভাষ্য মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং জোগায় মুক্তির অমূল্য অনুপ্রেরণা। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানগুলো তাদের মনোবল ও প্রতিরোধের কঠিন সংকল্পে এক দুর্ভেদ্য দুর্গ। 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবরুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে, মুক্তাঞ্চলে, ভারতে এবং প্রবাসে সব শ্রেণি পেশা ও বুদ্ধিজীবী মানুষ নৈতিক সমর্থন সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করেন। স্বাধীনতার স্বপক্ষে এসব মানুষ নিঃস্বার্থভাবে দেশের মুক্তির লক্ষ্যে যার যার অবস্থান থেকে যে যেভাবে যতটুকু পারেন অবদান রাখেন। আজ থেকে পঞ্চশ বছর আগে গণমাধ্যমের প্রসার আজকের তুলনায় অনেক সীমাবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও সেই সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে গণমাধ্যম বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা এবং জনমত সংগ্রহে বিশাল ভূমিকা পালন করে। তাদের সম্মিলিত অবদানে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আশানুরূপ সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। রিপোর্টার লিখেছেন, ফটোগ্রাফার ছবি তুলেছেন, প্রবীণ সাংবাদিকরা সম্পাদকীয় লিখেছেন, গীতিকার গান লিখেছেন, সুরকার সুর দিয়েছেন, শিল্প গান গেয়েছেন, চিত্রকর ছবি এঁকেছেন, তারকারা জন সমাবেশ করে তহবিল সংগ্রহ করেছেন। সৃজনশীল এসব অবদান যুদ্ধে প্রাণপণ লড়াইতে সৈনিক, কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়েছে। সমগ্র দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করেছে মুক্তির সংগ্রামে।

দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম শুধু যে কেবল বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার ছিল তাই-ই নয়, বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল অগ্রগামী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধে বিশ্ব বিবেককে আহ্বান করার লক্ষ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৬টি দেশে রাষ্ট্রীয় সফর করেন। তাঁর এসব সফরের খবর এবং পর্যালোচনা সাংবাদিকরা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করেন। গণমাধ্যমের এই ভূমিকার কারণে পৃথিবীর বহু দেশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নৈতিক সমর্থন দেয়। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো ভূমিকার পেছনে গণমাধ্যমের এই ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সময়োচিত এবং ইতিবাচক।

বহু বিদেশি সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী ভারতের গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে রণক্ষেত্র, প্রশিক্ষণ, প্রতিরোধ এবং শরণার্থীদের শিবির পরিদর্শন করেন এবং প্রতিবেদন লেখার ব্যাপারে ব্যাপক সহায়তা পান। নেতৃস্থানীয় ও বহুল প্রচারিত ভারতীয় পত্রপত্রিকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এগুলোর মধ্যে ছিল আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, দ্য স্টেটসম্যান, হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য হিন্দু, হিন্দুস্তান ডেইলি, নবভারত, রাজস্থান ডেইলি, দ্য পাঞ্জাব কেশরি, লোকমত, দৈনিক ভাস্কর, দৈনিক উজালা। এ ছাড়া ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের, বিভিন্ন ভাষার, প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে প্রায় প্রতিদিনই মুক্তিযুদ্ধের সচিত্র প্রতিবেদন, সংবাদ নিবন্ধ, সম্পাদকীয়, কলাম ও ফিচার পাতায় প্রকাশিত হতো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংবাদ ও পর্যালোচনা। এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার নেতৃস্থানীয় সংবাদপত্রগুলোয় পাক-বাহিনীর বর্বরতা ও মুক্তি-সংগ্রামীদের যুদ্ধযজ্ঞের সংবাদ ও সম্পাদকীয় মতামত বিশ্বজনমত গঠনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলোর মধ্যে ছিল প্রখ্যাত সংবাদ-সামরিকী ‘নিউজউইক’, ‘টাইম’, ‘ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর’ ও ‘ইকোনমিস্ট পত্রিকার একাধিক সচিত্র প্রচ্ছদ প্রতিবেদন; লন্ডন টাইমস, দ্য ডেইলি মেইল, সানডে টাইমস, ডেইলি টেলিগ্রাফ, শিকাগো ডেইলি মেইল, টেলিগ্রাফ, সানডে অবজারভার, শিকাগো মর্নিং। হেরালড, রাশিয়ার প্রাভদা, দ্য অস্ট্রেলিয়ান, সিডনি মর্নিং হেরাল্ড, টোকিও টাইমস, জাপান টাইমস, আশাহি শিমবুন, ফাংকফুর্টার এলজেমেইন জাইটুং, গার্ডিয়ান, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, কানাডার দ্য ডেইলি মেইল’, ‘দ্য অবজারভার’, জার্মানির ‘বি’ ডেইলি, ‘ডাই ওয়েল্ট, দ্য ডয়েচল্যান্ড, ফ্রান্সের ‘লা মদ’ এবং ‘লা প্রেসা প্রভৃতি। ল্যাটিন আমেরিকার নেতৃস্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতেও যথোচিত গুরুত্বসহকারে স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর এবং অনুকূল সম্পাদকীয় মন্তব্য।

তখনকার দিনে টেলিভিশনের সম্প্রচার সুযোগ ছিল সীমিত। তা সত্ত্বেও বিবিসি টিভি, সিবিএস, জাপান টেলিভিশন, এবিসি, এনবিসি, ডয়েচে ভেলে টিভি, ফ্রেঞ্চ টেলিভিশন, সোভিয়েত নভোস্তি প্রেস ইন্টারন্যাশনাল বিশেষ করে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, রয়টার্স, ইউএনআই, প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই) প্রভৃতি বার্তা সংস্থাগুলো তাদের ব্যুরোর মাধ্যমে ও সাংবাদিক পাঠিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর সম্প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

রণাঙ্গনের প্রতিদিনকার তাজা খবর সংগ্রহ, সম্পাদন ও মুদ্রণের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে সংবাদকর্মীরা যে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, তার যথোচিত মূল্যায়ন আজ পর্যন্ত হয়নি। কারণ তারাই সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থেকে গোপন ছাপাখানায় অথবা গুপ্ত আশ্রয়ে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে বুলেটিন বা প্রচারপত্র ছেপে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে।

এসব রণবার্তা বা বুলেটিন মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে পৌঁছে দিতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এসব প্রকাশনার উদ্যোক্তা এবং কর্মী-সহকারী-সহযোগীদের মূল্যায়নও হয়তো আজও হয়নি। এই সব উদ্যোগ ছিল এতই অসংগঠিত এবং স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত যে, সেগুলোর রেকর্ড রাখাও সম্ভব হয়নি। এসব প্রকাশনা-উদ্যোগের তালিকা প্রকাশও তাই দুঃসাধ্য। তবু কয়েকটি উদ্যোগের নাম উল্লেখ না করলেই নয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জয় বাংলা, বিপ্লবী বাংলাদেশ, নতুন বাংলা, দাবানল, বাংলার মুখ, গণশক্তি, সংগ্রাম, সংগ্রামী বাংলা, জাগ্রত বাংলাদেশ, একতা, বঙ্গবাণী, দুর্জয় বাংলা, স্বরাজ বাংলা, প্রতিনিধি, আমার দেশ, হাতিয়ার, রণাঙ্গন, মুক্তবাংলা, মুক্তি, অগ্রদূত, দি নেশন, বাংলাদেশ, রাষ্ট্রদূত, সন্দ্বীপ। বার্তা, বাংলাদেশ সংবাদ, প্রতিরোধ, স্বাধিকার, গ্রেনেড, বিচ্ছু প্রভৃতি। এ ছাড়া প্রবাসে বিভিন্ন দেশে বাঙালি সংগঠকরা নিজ নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন পত্রিকা বা সাময়িকী প্রকাশনার এবং ডাকযোগে বিলি করার ব্যবস্থা করেন।

মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশতাব্দী পর সেদিনের বাস্তবতার দিকে চোখ ফেরালে এক তীব্র বেদনাবোধে দংশিত না হয়ে পারি না। কারণ অত্যন্ত ঝুঁকি ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ চালাকালে লেখক-সাহিত্যক-সাংবাদিকরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংহত করার ক্ষেত্রে দেশ ও বিবেকের তাড়নায় এসব অসাধ্য সাধন করেছিলেন। সেই গৌরবময় ও সাহসী সাংবাদিকতা পেশা আজ তার গৌরবময় অতীত ঐতিহ্য থেকে বহু দূরে সরে গেছে। সেই নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও দেশপ্রেম, দেশত্ববোধ আজ কোথায়? সেই সততা, নিষ্ঠা ও চারিত্রিক গুণাবলীই বা আজ কোথায়? জনগণের যে ঐক্য সেদিন দেশপ্রেমিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, সেই রাজনৈতিক ঐক্য-সংহতিতে ফাটল দেখা দেওয়ায় পেশাজীবী বৃত্তিজীবী এমনকি স্বাধীনচেতা শিল্পী-কলা-কুশলী-সাংবাদিক সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরাও আজ মোটা দাগে বিভক্ত। বিভক্ত সাংবাদিকদের ইউনিয়ন। অন্যান্য পেশাজীবী সংঘগুলোও নানা ভাগে বিভক্ত। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো গণমাধ্যমের দ্বিধাবিভক্তি। এই বিভাজনের ফলে অনৈতিক অপশক্তি। মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যোগ্যতা বা কর্তব্যনিষ্ঠার চেয়ে দলীয় আনুগত্যই এখন পেশার প্রধান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। সাংবাদিকতা পেশার মান-মর্যাদা সমুন্নত রাখার তাগিদ তাই আজ সর্ব মহলে অনুভূতি হচ্ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে যে গণমাধ্যম এত বড় ভূমিকা পালন করছে তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে হলে আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধে ১১টি সেক্টরের অনুসরণে তাদের নিয়ে ১২ নং সেক্টরের মর্যাদা দেওয়া সমীচীন হবে। মুক্তিযুদ্ধের সেই দেশপ্রেমিক চেতনায় গণমাধ্যমকে আবার সঞ্জীবিত করতে পারলে অপসাংবাদিকতা এবং কলমকে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহারের পথ বন্ধ করা যাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসাবে গণমাধ্যমর এই পুনর্মূল্যায়ন থেকে দেশ ও জাতি প্রভূতভাবে উপকৃত হবে বলে আমি মনে করি।

যে দেশ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে, সেখানে যুদ্ধকালীন আগে-পরে যে চেতনায় যুদ্ধ হয়েছে স্বাধীনতার পক্ষে নির্যাতনের ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষের অধিকার ও সর্বোপরি স্বাধীনতার পক্ষে যে ভূমিকা সাংবাদিকরা পালন করেছিল আজ ৫০ বছর পরে সে চেতনতার ঘাটতি থাকবে কেন? আজ কেন স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিগুলো স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বৃহত্তম জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে বাধা কোথায়? আজ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। এ ব্যাপারে আমাদের গণমাধ্যমের ভূমিকা আমাদের হতাশ করে।

মুক্তিযুদ্ধ তথা এই গণযুদ্ধ সর্বস্তরে মুক্তিযোদ্ধারা এককাতারে অংশগ্রহণ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের এই কাতারে শামিল রয়েছে সশস্ত্র মুক্তি, সংগঠক, রাজনীতিবিদ, সহযোগিতা মুক্তিযোদ্ধা, সহযোগী, শিল্পী, সাংবাদিক, খেলোয়াড় এবং বিভিন্ন পেশাজীবী শামিল রয়েছে। এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। কাতারের সবাই আমরা মুক্তিযোদ্ধা। তবে যেহেতু এই কাতারে শামিল মুক্তিযোদ্ধাদের এই গণযুদ্ধে পৃথক পৃথক ভূমিকা রয়েছে তাই বিলম্ব হলেও মুক্তিযুদ্ধের শ্রেণিবিন্যাস অতি জরুরি আবশ্যক। কারণ এদের নিজ নিজ ভূমিকা লিপিবদ্ধ না করি তাহলে সঠিক ইতিহাস কখনো প্রণয়ন হবে না। তাই যিনি শব্দসৈনিক তার থাকবে শব্দসৈনিক, সশস্ত্রের পদ সশস্ত্র, যিনি কূটনৈতিক থাকবে নৈতিক, এভাবে শ্রেণিবিন্যাস করতে হবে। প্রত্যেকের অবদানের সম্মিলিত লেখা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে ভূমিকা উল্লেখ করে প্রকাশ করা উচিত। না হয় যে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা না সে শুনে অথবা খেয়াল খুশিমতো কাল্পনিক চিত্র তুলে ধরবে। তা প্রত্যাশিত নয়। এমনিভাবে যে শিল্পী, যে সাংবাদিক স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বা যুদ্ধ চলাকালীন লিখেছেন তাদের ভূমিকা অন্যরা খাটো করে দেখতে পারে। এই শ্রেণিবিন্যাসের এই উদ্যোগের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়নে বিরাট সহায়ক ভূমিকাও পালন করবে।

 লেখক : সাবেক মন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর