মঙ্গলবার, ১৬ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রতিদিনের আয়না

আ স ম আবদুর রব

বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রতিদিনের আয়না

‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ বাংলা সংবাদপত্রের সুদীর্ঘ পরম্পরার অন্তর্গত। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা জগতের প্রতিমূর্তি। বাংলাদেশ প্রতিদিন এখন জনপ্রিয়তার উচ্চতায় এবং খ্যাতির শিখরে অবস্থান করছে। প্রকাশনার দিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি এ পত্রিকার নিয়মিত গ্রাহক।

সম্পাদক নঈম নিজাম আমার খুবই আপনজন। তাঁর সুবাদেই বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আমার সখ্য ক্রমাগতভাবে নিবিড় হয়েছে। পত্রিকার খবরের বাইরেও নঈম নিজামের রাজনৈতিক সচেতনতামূলক লেখা, বিদ্যমান বাস্তবতার ওপর আলোকপাত, অনুপম বিশ্লেষণও আমার আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। জাতীয়তা, স্বদেশ প্রেম, গণতান্ত্রিক ও নৈতিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রতি তাঁর আগ্রহ আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।

প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে যখন বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা হাতে নিই তখন মনে হয় বাংলাদেশ প্রতিদিন এখন ‘প্রতিদিনের আয়না’। সবার হাতে পত্রিকা তুলে দেওয়া, শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে পত্রিকা তুলে দেওয়া, নিম্নআয়ের মানুষের কাছে পত্রিকা তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রতিদিন অভাবনীয় পরিবর্তন সূচিত করেছে, পত্রিকার ক্ষেত্রে এক পুনর্জাগরণ সৃষ্টি করেছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন অগ্রসর চিন্তায় প্রবল আগ্রহী, গণতন্ত্র ও সুশাসনের অনুসন্ধানী, ইতিহাস ঐতিহ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অভিমুখী, নিজস্ব সংস্কৃতির অনুসন্ধানে অবিরাম প্রশ্নমুখর। ইতিহাস থেকে রসদ সংগ্রহের প্রশ্নেও বাংলাদেশ প্রতিদিন অনুসন্ধিৎসু।

বাংলাদেশে সংবাদপত্রের পরিধি বিস্তৃতি ও স্বাধীনতা নিয়ে অনেক বেশি মুখর হওয়া প্রয়োজন। তারপরও আমাদের দেশে সংবাদপত্রের দ্রুত সম্প্রসারণ নিঃসন্দেহে তাৎপর্যময় ঘটনা।

গণমাধ্যমের অনেক সংবাদ যত দ্রুত সম্প্রচারিত হয় ঠিক তত দ্রুত মিলিয়ে যায় কিন্তু এখনো সংবাদ মাধ্যমের প্রভাব অসীম। সংবাদপত্রের সঙ্গে বড় ধরনের একটা বিপদ জড়িত থাকে। কারণ, তারা চাইলে সংবাদপত্র দ্বারা জনগণকে সুবিধাজনক মতে প্রভাবিত করে অস্ত্রে পরিণত করতে পারে। পত্রিকা যেমন পাঠকের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সাহায্য করতে পারে তেমনি পাঠককে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ঝুঁকিয়ে দিতে পারে, স্বীয় স্বার্থের উদ্দেশ্যে জনগণকে ব্যবহারের কৌশল গ্রহণ করতে পারে। স্বার্থসিদ্ধির ক্ষমতা প্রয়োগ করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে স্বার্থের অনুকূলে সংবাদপত্রকে ব্যবহার করতে পারে। সংবাদপত্রও অবৈধ ক্ষমতার অনুশীলন করতে পারে।

এককালে গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতাকে খুব গুরুত্ব প্রদান করা হতো। কিন্তু নিরপেক্ষতা অর্জন করা খুবই কঠিন। এসব নিরপেক্ষতা রাজনীতির সঙ্গে প্রায়ই জড়িয়ে থাকে। সরকারের ক্ষমতা আর জনগণের শক্তির মধ্যে অনেক পার্থক্য। সুতরাং ক্ষমতা ও শক্তির মাঝ বরাবর অবস্থান গ্রহণ করলেই নিরপেক্ষ অবস্থান নিশ্চিত হয় না। প্রকৃত নিরপেক্ষতা একটি অস্পষ্ট মতবাদ।

আমাদের রাষ্ট্রে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ জড়াজড়ি করে অবস্থান করছে। এখানে নিরপেক্ষ অবস্থান কোনোক্রমেই বাস্তবসম্মত নয়। যা অন্যায় যা অসত্য যা বর্বরোচিত তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই নৈতিক কর্তব্য।

রাজনৈতিক নিপীড়ন, দুর্নীতি, হিংসাত্মক কার্যকলাপসহ অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ না করলে নৈতিক দায়ের স্খলন ঘটবে।

আমি মনে করি সংবাদপত্র হবে সত্য অনুসন্ধানের গন্তব্যস্থল। সংবাদপত্র আমাদের রাষ্ট্রে এমন একটা পরিবেশ নিশ্চিত করবে যা ‘গণতন্ত্র এবং সত্য’কে বেষ্টন করে থাকবে। রাষ্ট্রের সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও অঙ্গীকার এবং মৌলিক সংস্কৃতি বিকাশের প্রশ্নে আজকের বাস্তবতায় সংবাদপত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সংবাদপত্রের সংবাদ, বিশ্লেষণ, চিন্তা-চেতনার ধরন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ওপর খুবই প্রভাব বিস্তার করে। সংবাদপত্র এখন একটি রাষ্ট্রের ‘সত্য ও সংস্কৃতি’র প্রতিচ্ছবি।

সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। রাষ্ট্রের চরিত্র গড়ন ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য চিহ্নিত করতে না পারলে বিচ্ছিন্নভাবে সংবাদপত্রের অবদান এবং গুরুত্ব চিহ্নিত করা সম্ভব হবে না। রাষ্ট্রের সামগ্রিকতার দৃষ্টিতে সংবাদপত্রের ভূমিকা নিরূপণ করতে হয়। আইনের শাসন সংবিধানের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠনের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং মানবাধিকার মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে এবং স্বৈরাচারী শাসন প্রতিরোধে মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি স্থাপন করে। সুতরাং যে রাষ্ট্রে আইনের শাসন ও মৌলিক মানবাধিকার প্রতি মুহূর্ত লঙ্ঘিত হয়, যেখানে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয় না সেখানে সংবাদপত্রের ভূমিকা খুবই জটিলতর হয়ে ওঠে।

আমাদের রাষ্ট্র নির্মিত হয়েছিল একটি সাধারণ চুক্তির মাধ্যমে। যার ভিত্তি হচ্ছে আইন ও অধিকারের প্রশ্নে সকলের সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচারের মধ্য দিয়ে সকল মানুষের পারস্পরিক আকাক্সক্ষা পূরণের বাসনা। কিন্তু এসব চুক্তি আমরা ছুড়ে ফেলেছি ক্ষমতার স্বার্থে। সরকার জনগণের ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত হবে এই বৈধতার মাপকাঠিকে আমরা উপড়ে ফেলেছি।

আমাদের সংবিধানে বাক-স্বাধীনতাসহ মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা স্বীকৃত থাকলেও সরকারি নিয়ন্ত্রণের আওতাধীন হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র অহরহ রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে ব্যক্তির অধিকারকে খর্ব করে একচেটিয়া আনুগত্য দাবি করে। রাষ্ট্রের ভয়ঙ্কর ভয়ভীতি ব্যক্তিকে দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য করে। আধুনিক বিশ্বে বিশেষত স্বাধীন এবং উন্নত দেশে মানুষ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিকার ও সামাজিক সুবিচার ভোগ করতে পারে। তাদের মানবিক অধিকার এবং মৌলিক অধিকার সবসময় নিশ্চিত থাকে। কিন্তু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র জনগণের স্বাধীনতা এবং অধিকারগুলোকে দমন করতে বা বাতিল করতে বেশি উৎসাহী। সরকারের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা, অপ্রত্যক্ষ মানসিক চাপ, নির্যাতন অনেক মানুষকে মানসিক বিশৃঙ্খলতার দিকে ঠেলে দেয়। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার কথা বলে দমন-নিপীড়নের সকল কার্যক্রমের যৌক্তিকতা ও বৈধতা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেড়াজালে সংবাদপত্রকে সংকুচিত করতে চায়। ডিজিটাল আইন হচ্ছে গণমাধ্যম দমন করার ভয়ংকর হাতিয়ার। যে কাউকে যে কোনো সময় যে কোনো জায়গা থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে যেতে পারে এই আইনের আওতায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৪টি ধারা জামিন অযোগ্য। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। সাংবাদিকদের নামে প্রতিনিয়ত গুজব ছড়ানো, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা, দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অভিযোগ আনা হচ্ছে।

এ অবস্থায় ব্যক্তি স্বাধীনতা, ব্যক্তির মর্যাদা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা করা আরও কঠিন, ফলে তা রক্ষা করা আরও জরুরি হয়ে পড়ে।

ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রাষ্ট্র বা সমাজ বিকাশের প্রয়োজনে অনিবার্য। কিন্তু এসব প্রশ্নে নিয়ন্ত্রণ বা স্ব আরোপিত নিয়ন্ত্রণ এই উভয়ের বিলোপ সাধন করতে হবে। আমাদের শাসনব্যবস্থা থেকে প্রগতির চেতনা, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ জলাঞ্জলি দেওয়ার দুঃস্বপ্ন অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে। রাষ্ট্র কোনো প্রতিষ্ঠানকে এমন কর্তৃত্বের অধিকার দিতে পারে না, যা মানুষের বিবেক এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। অন্যায়, অনিয়ম ও জবরদস্তি মানুষের মর্যাদার সঙ্গে একত্রে চলতে পারে না।

আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থা বিলুপ্ত করার জন্য, নতুন করে নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার দুয়ার খুলে দেওয়ার জন্য নয়। আমরা রক্ত দিয়েছি পুরনো হিংস্র শাসনব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করার জন্য নয়। আমরা অতীতের সর্বগ্রাসী শাসনব্যবস্থায় ফিরে যেতে চাই না।

আমরা সত্য, স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার উচ্ছেদ করে দিলে পরিস্থিতি নিজেই বিপজ্জনক হয়ে উঠবে, নিজের অস্তিত্বের প্রতিই হুমকি সৃষ্টি হবে। পরিশেষে নিজের বেঁচে থাকার অধিকার হারাতে হবে। মিথ্যার সঙ্গে টিকে থাকার প্ররোচনা অবশ্যই আমাদেরকে প্রতিহত করতে হবে, গতিহীন করতে হবে। রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক মানবিক ও নৈতিক করার অনুপ্রেরণা জোগাতে হবে ভয়ভীতি উপেক্ষা করে সাহসিকতার সঙ্গে। সত্যের ভয়ে ভীত সমাজ বিকশিত হতে পারে না, সে সমাজ ক্রমাগত সত্য ধারণে অসমর্থ হয়ে ওঠে। সত্য ছাড়া ব্যক্তির আত্মবিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে, বিচ্ছিন্নতার জন্ম হয়।

সত্যবিহীন সমাজে সংঘাত ঘনীভূত হয়, বিস্তৃতি লাভ করে। সমাজে অস্থিরতা টানাপোড়েন বাড়ে। যারা বল প্রয়োগে, শক্তি প্রয়োগে সত্যকে প্রতিস্থাপন করতে চায় তাদেরকে দৃশ্যপট থেকে বিতাড়িত করতে হবে। সংবাদপত্র হবে জনগণের কণ্ঠস্বরের প্রকৃতিসম্পন্ন। সংবাদপত্র হবে সমগ্র জনগণের মঙ্গলের বার্তাবাহী, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পরিমাপক।

বাংলাদেশ প্রতিদিন এবং মিডিয়ার কাছে আমার প্রত্যাশা, মানুষের ওপর রাষ্ট্রের অন্যায় আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করে সত্যকে সুরক্ষা দিতে হবে। জনগণের অধিকারকে রক্ষা করতে হবে এবং মানুষের মর্যাদার প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। চূড়ান্ত বিচারে ও বিবেচনায় সংবাদপত্র হবে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের উৎস। সংবাদপত্র হবে সত্য রক্ষার প্রতিভূ।

সংবাদপত্র স্বমহিমায় পূর্ণ আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠা লাভ করুক।

 লেখক : সভাপতি,

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি।

সর্বশেষ খবর