বুধবার, ১৭ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

সেলিনা হোসেন

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

ধর্মনিরপেক্ষতার মানবিক দর্শন নিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেছিলেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে কিশোর বয়সেই লিখেছেন, ‘আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোনো জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল।’

ছয় দফা দাবি পেশ করার পরে তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘ছয় দফা মুসলিম-হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধদের নিয়ে গঠিত বাঙালি জাতির স্বকীয় মহিমার আত্মপ্রকাশ আর নির্ভরশীলতা অর্জনের চাবিকাঠি।’ ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে মানব জীবনের বেঁচে থাকার সত্যকে তিনি কৈশোর থেকে আপন প্রজ্ঞায় ধারণ করেছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এটি ছিল তাঁর জীবন দর্শন।

ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল তাঁর জীবন দর্শনের একটি অন্যতম দিক। ছাত্রজীবন থেকে তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। যে কোনো আধুনিক রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় এটি একটি মৌলিক শর্ত। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধলে তিনি দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকায় রিলিফের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। বিপন্ন মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ভারতের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত। তিনি ১৯৪৩ সাল থেকে ইসলামিয়া কলেজে শিক্ষকতা করতেন। তাঁর ‘ষাট দশক’ শিরোনামের বইয়ে তিনি দাঙ্গার সময়ের স্মৃতিচারণা করে লিখেছেন : ‘ইসলামিয়ার ছাত্ররা যে আমাদের জন্য কতটা করতে পারত তার প্রমাণ পেলাম ১৯৪৬-এর রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়। বালিগঞ্জ থেকে ইসলামিয়া কলেজের রাস্তায় পদে পদে বিপদ। এই রাস্তা আমাদের ছাত্ররা পার করে দিত। ওরা বালিগঞ্জের কাছে অপেক্ষা করত আর সেখান থেকে ওয়েলেসলি স্ট্রিটে কলেজে নিয়ে যেত। আবার সেভাবেই ফিরিয়ে দিতে যেত। এখানে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি ইসলামিয়া কলেজের সেই সব মুসলমান ছাত্রকে যারা আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে বিপজ্জনক এলাকাটা পার করে দিতেন। এই ছাত্রদের একজনের নাম ছিল শেখ মুজিবুর রহমান।’

১৯৬৪ সালের বাঙালি-বিহারি দাঙ্গার সময় তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছিলেন। নারায়ণগঞ্জে ভয়াবহ সহিংসতার মধ্যে বিপন্ন হয়ে পড়েছিলেন। দাঙ্গাবিরোধী কমিটিতে থেকে ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ লিফলেট প্রকাশ করে বিতরণ করেছিলেন। দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ লিফলেট প্রচার করার দায়ে তাঁকে পাকিস্তান প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স ও পাকিস্তান দন্ডবিধি প্রয়োগ করে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে তিনি জামিনে মুক্তিলাভ করেন।

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর খসড়া শাসনতন্ত্র অনুমোদন উপলক্ষে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সে ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘চতুর্থত, বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না। এই হলো চার দফা, চার স্তম্ভ।’

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের আগে নভেম্বরে বেতার-টেলিভিশনের ভাষণে ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে বলেছিলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে, আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য-বলে সর্বস্ব ইসলামে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হজরত রাসুলে করিম (সা.)-এর ইসলাম, যে ইসলাম জগদ্বাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বরাবর যারা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে, আমাদের সংগ্রাম সেই মোনাফেকদেরই বিরুদ্ধে। যে দেশের শতকরা ৯৫ জনই মুসলমান, সে দেশে ইসলামবিরোধী আইন পাসের সম্ভাবনার কথা ভাবতে পারেন শুধু তাঁরাই, ইসলামকে যারা ব্যবহার করেন দুনিয়াটা ফায়স্থা করে তোলার কাজে।’

তিনি আরও একটি ভাষণে বলেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করব না। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম করবে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার-এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।’

কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিপরীতে এক অসমতল মেরু। এখানে বঙ্গবন্ধুর সেই উক্তি স্মরণ করা জরুরি। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলার সকল অধিবাসী সে সংখ্যাগুরুই হোক বা সংখ্যালঘুই হোক সকলকেই আজ দেশাত্মবোধ নিয়ে জেগে উঠতে হবে, মরণপণ করে বাংলার মান-ইজ্জত রক্ষার জন্য এগিয়ে ডাক দিয়ে কেবল বলে যেতে চাই : জাগো বাঙালি জাগো।’

এই সময়ও তাঁর কণ্ঠস্বর ধারণ করে বলবে, ‘জাগো, বাঙালি জাগো।’ বাঙালিকে জেগে ওঠে তার জাতিসত্তার বোধ চেতনার রন্ধ্রে রাখতে হবে।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর