বুধবার, ১৭ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা ও উন্নয়ন দর্শন

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা ও উন্নয়ন দর্শন

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজীবন বাঙালির অধিকার নিশ্চিত করার জন্য লড়াই করেছেন তিনি।  তাঁর ত্যাগ ও নেতৃত্বের জন্য আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। যদিও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর (১৯৭২-১৯৭৫) মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ পরিচালনার সময় ও সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। মাত্র নয় মাসে তিনি জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন একটি সংবিধান। নায্য অধিকার ও মর্যাদা অর্জনের জন্য ওই সময়ে বহুবিধ উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। সেই ধারাবাহিকতার মাঝে দীর্ঘ সময় স্বৈরাচার সেনাশাসন বজায় রাখতে পারেনি। তাদের কূটচালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে জীবন দিতে হয়। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে মহান মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। যত দিন যাচ্ছে ততই বিশ্ববাসীর কাছে উজ্জ্বল ও আলোকিত হয়ে উঠছেন বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ। একটি জাতি ও রাষ্ট্রের এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র কী হতে পারে কিংবা কী হবে তা জাতির জনক নানা সময় বিভিন্ন বক্তব্যে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা ও আমার দেখা নয়াচীন-এ ইতিহাসের বহু সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। বর্তমান রচনায় বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা ও উন্নয়ন দর্শন প্রসঙ্গে সামান্যটুকু পুনরালোচনা করা হবে।

অসামান্য নেতৃত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, মেধা-মমত্ববোধ, সততা এবং দেশপ্রেমের প্রজ্বলিত এক অগ্নিশিখা বঙ্গবন্ধু। যার উত্তাপ এখনো চিরন্তন। মৃত্যুকে পরোয়া না করে তিনি গোটা বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন।

বাঙালির আর্থসামাজিক মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন। ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে এবং জীবনের বড় একটা সময় কারাগারে থেকে তিনি এদেশের মানুষের দুঃখ ও বঞ্চনার তল খুঁজে পেয়েছিলেন। তাই তিনি ‘ছয় দফা’কে বাঙালির ‘বাঁচার দাবি’ হিসেবে মুক্তি আকাক্সক্ষী বাঙালির কাছে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি এই ছয় দফার পক্ষে গণরায় দেয়। ভোটে জিতেই বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে শপথ পাঠ করান এ ছয় দফার পক্ষে অবিচল থাকার জন্য। ছয় দফার মূল ভাবনাকে সংবিধানে কী করে প্রতিস্থাপন করা যায় সে বিষয়টি নিয়েই তিনি কাজ করছিলেন তাঁর সহ-নেতা ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে। ওই সময় ইয়াহিয়া খান ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। আসলে এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব। এ আন্দোলন চলমান থাকা অবস্থায় ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ তৎকালীন রমনা রেসকোর্সে এক বিরাট জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির ডাক দেন। সেই ডাকের পটভূমিতেই নির্মম পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে গণহত্যা শুরু করে। এর পরপরই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

আমরা ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের দিকনির্দেশনা পেয়েছিলাম। আর ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভাষণে দিকনির্দেশনা ছিল অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের। ওই ভাষণে ১৫টি দিকনির্দেশনা ছিল। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক রূপরেখা সম্পর্কে বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা (পরবর্তীকালে সংযোজিত হয়েছিল জাতীয়তাবাদ)।’

১৯৭১-এর ৭ই মার্চের ভাষণে গরিব মানুষ, দুঃখী মানুষের কথা, নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের কথা বারবার এসেছে। এ ভাষণে জাতির জনক রাষ্ট্রকাঠামোর চরিত্রের রূপরেখা উপস্থাপন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপর’-অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক এক বাংলাদেশের চিত্র ৭ই মার্চের ভাষণেই এঁকেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ অসাম্প্রদায়িক চেতনা রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে নয় জনগণের সহজাত দায়িত্ববোধ থেকে উৎসারিত হতে তিনি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। জনগণ ছিল তাঁর চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু।

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও আমরা দেখি যে, মানুষের ওপর তাঁর আস্থা ও ভালোবাসার কথা। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-দর্শনের সারকথা ছিল মানুষের উন্নয়ন, কোনো গোষ্ঠীবিশেষের উন্নয়ন নয়। যদিও তাঁর উন্নয়ন-দর্শনের কোনো লিখিত দলিল নেই। তাঁর সারা জীবনের সংগ্রামের অভীষ্ট মানুষের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে দেশপ্রেমে ঐক্যবদ্ধ করা। আমরা তাঁর তিন হাজার ৫৩ দিন কারাবাসের কারণে পেয়েছি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামে দুটি মহামূল্যবান গ্রন্থ। এ বইতে তাঁর জীবন ও রাজনীতির কথা নির্মোহভাবে বর্ণিত হয়েছে। এ দুটি গ্রন্থ আমাদের ঐতিহাসিক পথনির্দেশ করেছে, জানার সুযোগ করে দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর ছিল খাঁটি, নির্ভেজাল, নিরঙ্কুশ ও আপসহীন দেশপ্রেম। সেই দেশপ্রেম থেকেই তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছে। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল ঘবংি ডববশ পত্রিকায় সংবাদ ভাষ্যকারের এ মন্তব্য তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার স্বরূপটিকে সঠিকভাবেই উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়, ‘মুজিব মৌলিক চিন্তার অধিকারী বলে ভান করেন না। তিনি একজন রাজনীতির কবি; প্রকৌশলী নন। শিল্পকৌশলের প্রতি উৎসাহের পরিবর্তে শিল্পকলার প্রতি ঝোঁক বাঙালিদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। কাজেই সব শ্রেণি ও আদর্শের অনুসারীদের একতাবদ্ধ করার জন্য তাঁর স্টাইল (পদ্ধতি) সবচেয়ে বেশি উপযোগী ছিল।’ দেশপ্রেম মানে আবেগ। সেই আবেগেই তিনি প্রথম যৌবনে পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানের প্রতারণা তিনি ধরে ফেলেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বাঙালিদের প্রতি ছিল সুনির্দিষ্ট শ্রেণি ও বর্ণবিভেদ, আর্থিক বৈষম্য। এ বৈষম্য কর্মক্ষেত্রেও ছিল। আর এ বৈষম্য রোধে মাত্র একজন বাঙালি সফল এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে জয়ী হয়েছিলেন তিনি বঙ্গবন্ধু।

তাঁর স্বদেশ ভাবনা ও দেশপ্রেম সব বাঙালিকে এক করেছিল। তার প্রমাণ ১৯৭১-এ আমরা পেয়েছি। তাছাড়া দেশপ্রেম মানে তো স্বদেশের মাটি, মানুষ, ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য-সবকিছুর প্রতিই প্রেম। সেসবের প্রতি সংগ্রাম ও তন্নিষ্ঠ দৃষ্টিপাতেই তিনি উপলব্ধি করে ফেললেন যে, পাকিস্তানের মতো একটি অদ্ভুত ও কৃত্রিম রাষ্ট্রের থাবা থেকে মুক্ত করতে না পারলে তার স্বদেশের মুক্তিলাভ ঘটবে না। আমরা তাঁর রাষ্ট্রভাবনার মধ্যে সেই কল্যাণকর, মুক্তবুদ্ধির সমাজ ও অসাম্প্রদায়িক রুচি দেখতে পাই। ১৯৭২-এর ১৪ মার্চ আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধু সেøাগানের মতো করে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম দেশ গড়ার সংগ্রাম।’ ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছিল : ‘সরকারি আইন করে কোনো দিন দুর্নীতিবাজদের দমন করা সম্ভব নয় জনগণের সমর্থন ছাড়া। ...আজকে আমি বলব বাংলার জনগণকে এক নম্ব^র কাজ হবে, দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে।... একটা কাজ আপনাদের করতে হবে।’ ঘুষ-দুর্নীতি উচ্ছেদ করে সমাজ বদলে দেওয়ার ব্যাপক বৈপ্লবিক কর্মসূচি ছিল বাকশাল। জনগণের ব্যাপক ঐক্যের মঞ্চও ছিল বাকশাল। আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন ছিল মানুষকেন্দ্রিক। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা এবং আদর্শ বাংলাদেশ রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধুর এ দুটো অর্জনের পথে আমরা সঠিক নেতৃত্বে  এগোচ্ছি।

মুক্তিযুদ্ধের পর পর দেশ যে একটা বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে রয়েছে তা বঙ্গবন্ধু নিশ্চিতভাবেই অনুধাবন করেছিলেন। কিন্তু পাশাপাশি অসংখ্য বাধা মোকাবিলা করে সাফল্য পাওয়ার যে সক্ষমতা এ দেশের জনগণের রয়েছে সে সত্যটিও তিনি জানতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কাক্সিক্ষত পথে তাদের নিয়ে এগোনো খুবই সম্ভব। ১৯৭২ সালেই খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের ‘কতিপয় প্রশ্নের জবাবে’ নিজের চিন্তা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘ছাত্রজীবন থেকে আজ পর্যন্ত আমার এ সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রাম কতিপয় চিন্তাধারার ওপর গড়ে উঠেছে। এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী তথা সব মেহনতি মানুষের জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাম্য প্রতিষ্ঠাই আমার চিন্তাধারার মূল বিষয়বস্তু। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। কাজেই কৃষকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে আমি জানি শোষণ কাকে বলে। এ দেশে যুগ যুগ ধরে শোষিত হয়েছে কৃষক, শোষিত হয়েছে শ্রমিক, শোষিত হয়েছে বুদ্ধিজীবীসহ সব মেহনতি মানুষ। এ দেশের জমিদার, জোতদার, মহাজন ও তাদের আমলা-টাউটদের চলে শোষণ। শোষণ চলে ফড়িয়া ব্যবসায়ী ও পুঁজিবাদের। শোষণ চলে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদের। এ দেশের সোনার মানুষ, এ দেশের মাটির মানুষ শোষণে শোষণে একেবারে দিশাহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের মুক্তির পথ কী? এই প্রশ্ন আমাকেও দিশাহারা করে ফেলে। পরে আমি পথের সন্ধান পাই। আমার কোনো কোনো সহযোগী রাজনৈতিক দল ও প্রগতিশীল বন্ধুবান্ধব বলেন, শ্রেণিসংগ্রামের কথা। কিন্তু আমি বলি জাতীয়তাবাদের কথা।’

বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন ছিল এ দেশের গণমানুষের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এক গভীর মানবিক সংগ্রামী দর্শন। এ দর্শনের ভিত্তিমূলে ছিল ঐতিহাসিক বিশ্বাস, যা কেবল জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন অনুযায়ী, গণমানুষের মুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম হলো ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ বাংলাদেশ, যেখানে সাংবিধানিকভাবেই ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’। এ দর্শনের স্পষ্ট প্রতিফলন তাঁর সোনার বাংলার স্বপ্ন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন, শোষণ-বঞ্চনা-দুর্দশামুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন। স্বাধীনতার অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার অনেকটাই বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছিলেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ১৯৭২ সালে আমাদের অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর আমাদের রিজার্ভে তখন কোনো বৈদেশিক মুদ্রাও ছিল না। শতকরা ৮০ ভাগের মতো মানুষ দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বৈপ্লবিক নেতৃত্বের কল্যাণে যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো এবং সত্যিকার অর্থে কোনো নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান না থাকা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। তখন তাঁর হাতে সম্পদও ছিল খুব সীমিত। তিনি সীমিত সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে মানুষের মনে আস্থা স্থাপন করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা ও উন্নয়ন দর্শনকে বিশ্লেষণ করলে ‘জাতীয় গণতন্ত্র’ ও ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ দুটি দিক আমাদের সামনে চলে আসে। ‘জাতীয় গণতন্ত্র’ নামে পরিচিত অনেক রাষ্ট্রের মতো বঙ্গবন্ধুও সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে একদলীয় শাসনের বিধান সংযোজিত করেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর নিজেরই এতে পুরোপুরি সায় ছিল বলে মনে হয় না। সমাজের কাক্সিক্ষত পরিবর্তনের জন্য বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন ‘বহুমুখী সমবায়’-এর ওপর। ১৯৭৫-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে ওই সমবায় বা কো-অপারেটিভ সম্পর্কে অনেক কথা বলেছিলেন। গান্ধীজি যেমন চরকায় সুতা কেটে কাপড় বুনে স্বদেশি হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, বঙ্গবন্ধুও বাঁশকে বিদেশি খাম্ব^ার বদলে বিদ্যুতের খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে দেশপ্রেমের নজির তুলে ধরেছেন।

বঙ্গবন্ধুকে হারানোর পর বহু বছর পেরিয়ে গেছে। তবু আজও তিনি তাঁর কন্যাদের এবং আমাদের চেতনার জায়গা থেকে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছেন। নিরন্তর সাহস ও অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন আমাদের বিস্ময়কর উন্নয়ন অভিযাত্রায়। অস্বীকার করার উপায় নেই আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রেই আয় বৈষম্য এখনো প্রকটভাবে উপস্থিত। এ কথাটি মেনে নিয়েও বলা যায় যে, অন্তত ভোগবৈষম্য আর না বাড়ার ক্ষেত্রে আমরা সফল হয়েছি। আমরা আশাবাদী যে, ‘ডেমোগ্রাফিক’ ও ‘ডেনসিটি ডিভিডেন্টে’র কল্যাণে বাংলাদেশের এ সাফল্যের ধারা আরও কয়েক দশক ধরে অব্যাহত থাকবে।  আর এসব কারণেই বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্পটি এতটা চমকপ্রদ। আর এর ভিত্তি গড়ে দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু।

 

লেখক : সাবেক উপাচার্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর