বুধবার, ১৭ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

চেতনায় বঙ্গবন্ধু

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

চেতনায় বঙ্গবন্ধু

শুধু ১৫ আগস্ট এলেই যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা স্মরণ করি, সারা বছর তাঁকে আমাদের চিন্তাচেতনা থেকে দূরে রাখি তবে বুঝতে হবে আমরা যতটা তাঁর ভাবমূর্তিকে শ্রদ্ধা জানাই ততটাই তাঁর ব্যক্তিত্বকে, তাঁর কাজ ও অর্জন অথবা তাঁর স্পন্দমান উপস্থিতিকে ভুলে থাকি। বঙ্গবন্ধুকে আমাদের প্রয়োজন ছিল ১৯৪৭ সাল থেকেই, যদিও তিনি তখন শুধুই তরুণ শেখ মুজিব। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাঁকে আমরা আমাদের সঙ্গে পেতে চেয়েছি। ১৯৫৪ সালে তাঁকে আমাদের প্রয়োজন হয়েছে রাজনীতির মাঠে পাওয়ার। তিনি আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। বাহান্নতে কারাগারে থেকেও তিনি ছিলেন আমাদের মিছিলে-পথসভায়। যে নির্বাচন মুসলিম লীগকে একটি বাতিল রাজনৈতিক দলে পরিণত করে বাঙালি জাতিসত্তার উন্মোচন ঘটিয়েছিল, ১৯৫৪ সালের সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আমাদের সামনে ছিলেন, পাশে ছিলেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা যখন বাঙালিদের ওপর নিপীড়ন শুরু করে, বাঙালিদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতে থাকে তখন তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি ছিলেন ষাটের দশকজুড়ে এবং আমরা তাঁরই অনুপ্রেরণায়, তাঁরই নির্দেশনায় অনেক প্রতিরোধের আন্দোলন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে গড়ে তুলি। পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ুব খান এক বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পথে নেমে আমরা তা প্রত্যাখ্যান করেছি। পাকিস্তানিরা ১৯৬১-তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমাদের সংস্কৃতি থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল; বঙ্গবন্ধু আমাদের তাদের সেই কুটিল চক্রান্ত নস্যাৎ করতে অনুপ্রাণিত করলেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁর ছয় দফা ঘোষণা করলেন। ছয় দফার সমর্থনে সারা দেশে শুরু হলো এক অভূতপূর্ব জাগরণ। সেই জাগরণে নতুন এক সংগ্রামের জন্য আমরা তৈরি হলাম। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা এমনভাবে তাদের প্রতিহিংসার লক্ষ্য বানাল যে এরপর কারাগারই হয়ে দাঁড়াল তাঁর ঠিকানা। কিন্তু তাতে বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য বা আদর্শ, তাঁর একনিষ্ঠ সংগ্রাম, দেশ ও মানুষকে নিয়ে তাঁর ভাবনা ও স্বপ্ন একচুলও বিচলিত হলো না। আমরা তাঁকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বিচারের সামনাসামনি হতে দেখলাম; আমরা প্রণোদিত, উজ্জীবিত হলাম যখন তিনি আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বললেন। ১৯৬৯-এর গণজাগরণ তাঁকে সামরিক কারাগার থেকে মুক্ত করল। তাঁকে উদ্দীপ্ত তরুণসমাজ ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্বোধনে একান্ত আপন করে নিল। ষাটের দশকের প্রতিটি বছর, প্রতিটি দিন তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তখন তো বিশেষ কোনো দিনে তাঁকে স্মরণ করার কথা কেউ ভাবত না। যেমন ভাবত না ১৯৭০ সালে এবং বিশেষ করে ১৯৭১-এ।

১৯৭০ সালটা ছিল ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্ন, একটি জাতির জেগে ওঠার, নিজের পরিচিতি শানিয়ে নেওয়ার, বড় একটি সংগ্রামের জন্য তৈরি হওয়ার বছর। সারা বছর বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের রাজনীতি এবং প্রতিদিনের জীবনচিত্রের মাঝখানে। তিনি কী করেন তা দেখার জন্য, তিনি কী বলেন তা শোনার জন্য আমরা সবাই তাকিয়ে থাকতাম। নভেম্বরে প্রলয়ঙ্করী ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে লাখ লাখ মানুষ মারা গেল, বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, এসব মৃত্যু যেন বৃথা না যায়। এদের জন্য হলেও আমাদের জাগতে হবে, প্রতিরোধ গড়তে হবে। নির্বাচনে আমরা জানিয়ে দিলাম আমরাই আমাদের ভবিষ্যতের কান্ডারি। একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ও মুক্তির সংগ্রামের ডাক দিলেন। তিনি জানতেন আমরা তৈরি। তিনি কখনো ইতিহাসকে ভুলভাবে পড়েননি, তিনি কখনো মানুষকে চিনতে ভুল করেননি। যাঁরা

ইতিহাস তৈরি করেন তাঁরা ইতিহাসকে অনায়াসে পড়তে পারেন, ইতিহাসও তাঁদের সমীহ করে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই দলে। ফলে ২৫ মার্চ রাতটি যখন এলো, বাংলাদেশে কাপুরুষ পাকিস্তানিরা গণহত্যা শুরু করল, বঙ্গবন্ধু বুঝলেন তিনি যদি পালিয়ে যান এরা নৈতিক একটি জয় পেয়ে যাবে, মানুষের ওপর চালাবে এক অমানবিক হত্যাযজ্ঞ। তিনি তাঁর বাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে থাকলেন হানাদারদের জন্য। তিনি জানতেন তাঁকে তারা মেরে ফেলতে পারে, কিন্তু সেই সম্ভাবনায় তাঁর বিন্দুমাত্র শঙ্কা তৈরি হয়নি। কারণ তিনি জীবনমৃত্যুকে তাঁর অনুগত করে রেখেছিলেন। তাঁর বরং এক বিরাট নৈতিক জয় হলো। তিনি বীরের বেশেই তাদের কারাগারে গেলেন। তিনি জানতেন তাঁকে ছাড়া বাঙালিরা ঠিকই যুদ্ধ করবে এবং বিজয় ছিনিয়ে আনবে।

পুরো একাত্তর বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে মনে রেখেছে, তাঁকে সামনে এবং সঙ্গে পেয়েছে। তাঁর নামে যুদ্ধ করেছে। এবং ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে বিজয়ের পতাকা উড়িয়েছে।

১৯৭২-এর জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন। বাঙালি তাঁকে বরণ করে নিল এক সাময়িক বিচ্ছেদের পর, যদিও ওই বিচ্ছেদ ছিল শুধু তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতি। এরপর ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন বাঙালির এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রামে উদ্দীপনা জুগিয়ে গেছেন। বাঙালি এগিয়ে গেছে। কিন্তু ওই নির্মম ১৫ আগস্ট অকৃতজ্ঞ কিছু মানুষ- যার মধ্যে তাঁর সহকর্মী দু-এক জন ছিলেন তাঁকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলেন।

এ এক ভয়ানক ধাঁধা। যাদের তিনি স্বাধীনতা দিলেন, গর্বিত একটি ঠিকানা দিলেন, জাতিসত্তার উদ্বোধন ঘটালেন তাদের কেউ কেউ তা পায়ে ঠেলে আবার পাকিস্তানি অস্তিত্বে ফিরে যাওয়ার জন্য কী অসম্ভব প্রতারণা আর আত্মপ্রবঞ্চনার ঘটনাটি ঘটাল।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর বাঙালি রাষ্ট্রের পরিচয়টি মুছে ফেলার চেষ্টা শুরু হলো। তাঁকে ইতিহাস থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হলো। তাঁর সব অর্জনকে অস্বীকার করে তাঁর সব চিহ্ন মুছে ফেলার আয়োজন শুরু হলো। কিন্তু যাঁকে বাঙালি এত দীর্ঘদিন সামনে ও পাশে পেয়েছে তাঁকে ভুলিয়ে দেওয়াটা যে কত অবাস্তব একটি চিন্তা, ১৯৭৫-এর কুশীলবরা তা বুঝতে পারেনি।

বঙ্গবন্ধু শুধু যে ফিরে এলেন তাই নয়; তাঁর এ প্রত্যাবর্তন বাঙালির জেগে ওঠার একটি নতুন যুগের উদ্বোধন করল। বঙ্গবন্ধুকে মনে রেখে তাঁর আদর্শ, তাঁর চিন্তাভাবনাকে মাথায় রেখে এগিয়ে গেলে হয়তো এ যুগটিকে একটি স্বর্ণযুগে আমরা পরিণত করতে পারব। যেটুকু আমরা এগিয়েছি তাতেই তো অনেক অর্জন আমাদের করায়ত্ত হয়েছে। এখন প্রয়োজন আরও এগিয়ে যাওয়ার।

শুরুতে বঙ্গবন্ধুকে বছরের এক-আধ দিন মনে না করে প্রতিদিন তাঁর থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়ার কথা বলেছি। এ শুধু কথার কথা নয়, এর একটা বাস্তব ভিত্তি আছে।

১৯৭৫-এর সেই মর্মান্তিক দিনটির পর বঙ্গবন্ধুর অনেক সহযাত্রী, সঙ্গী এবং স্নেহভাজনকে দেখেছি তাঁকে ভুলে গিয়ে বেশ ভালোই আছেন। অনেকে তো অন্য দলে নামও লেখালেন। এদের দু-তিন জন বঙ্গবন্ধুর নাম শুনলেই চোখ কোঁচকাতেন, যেন তাঁর নাম বলাটা অপরাধ।

রাজনৈতিক নেতারা না বললেও সাধারণ মানুষ বলত। তারা তাঁকে মনে রেখেছিল। তারাই কৃষিতে বিপ্লব ঘটাল, তৈরি পোশাকশিল্পে, চামড়া-চিংড়ি আর নানা শিল্পে সাড়া জাগাল।

বাংলাদেশের সমৃদ্ধি এসেছে এসব সাধারণ মানুষের হাত ধরে। কিন্তু এখন সময় এসেছে দেশের তরুণদের আবার বঙ্গবন্ধুকে মনে করার। এখন আমাদের গণতন্ত্রের এবং উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্রয়োজন। আমাদের গণতন্ত্র পথ হারাচ্ছে, পরমতসহিষ্ণুতা হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, মানুষের অধিকার খর্ব হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়লে তরুণরা পরিত্রাণ পাবে।

বঙ্গবন্ধুকে হারাবার এই শোকাবহ দিনে বঙ্গবন্ধুকে প্রতিদিন স্মরণ করার একটা সিদ্ধান্ত যদি আমরা নিই, বাংলাদেশ তার রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রতিদিনের জীবনযাপনে এমন এক নৈতিক ও প্রায়োগিক শক্তি খুঁজে পাবে যা দিয়ে ভবিষ্যৎ আমাদের হাতেই ধরা দেবে।

 

লেখক : শিক্ষাবিদ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর