শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৮ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

কভিড-১৯ সময়ে আমাদের সাংবাদিকতা

ফরিদা ইয়াসমিন

কভিড-১৯ সময়ে আমাদের সাংবাদিকতা

করোনাভাইরাস কভিড-১৯ পুরো বিশ্বকে তছনছ করে দিয়েছে। জীবনের স্বাভাবিক গতি যেন থমকে গেছে। সবকিছু কেমন যেন হয়ে গেল এলোমেলো। ২০১৯-এর ডিসেম্বরে যখন চীনের উহান প্রদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হলো তখনো কেউ এর ভয়াবহতা ভাবতে পারেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও অনুমান করতে পারেনি কী ঘটতে যাচ্ছে। বিশ্বের কোনো দেশই সেভাবে প্রস্তুত ছিল না এ ভাইরাসটি মোকাবিলায়। চিকিৎসকরা জানেন না ঠিক কী করতে হবে। প্রস্তুত ছিল না উন্নত বিশ্বের স্বাস্থ্য বিভাগও। সাংবাদিকরাও ঠিক প্রস্তুত ছিলেন না এ পরিস্থিতিতে ঠিক কী করতে হবে। ৮ মার্চ ২০২০ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্তের খবর পাওয়া গেল। সবাই যখন আইসোলেশনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সাংবাদিকরা তখন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রস্তুতি নিচ্ছেন এক মহাযুদ্ধে যাওয়ার। কারণ, যে কোনো দুর্যোগ দুর্বিপাকে সাংবাদিকরা ঘরে বসে থাকতে পারেন না। সঠিক তথ্যটি মানুষকে জানানো সাংবাদিকের নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। সাংবাদিক তাঁর নিজের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে ছোটেন কীভাবে সঠিক তথ্যটি পৌঁছে দেবেন।

অন্যদের মতো সাংবাদিকরাও আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন ইত্যাদি শব্দের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। সাংবাদিকরা তা আয়ত্ত করেছেন এবং জনগণকে বুঝিয়েছেন। সারা বিশ্বে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আতঙ্কিত মানুষ, ডালপালা ছড়াচ্ছে গুজবের। ঠিক মানুষ যখন দিশাহারা, গুজব মোকাবিলা করে জনগণকে সঠিক খবরটি, সঠিক তথ্যটি পৌঁছে দিয়েছেন সাংবাদিক। সাংবাদিকরা হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল, স্বাস্থ্য অধিদফতর, মন্ত্রণালয়, আইইডিসিআর ছুটেছেন তথ্যের সন্ধানে। এ মহাদুর্যোগে ঘরে ছিলেন না স্বাস্থ্যকর্মী, নিরাপত্তারক্ষী তেমনি সাংবাদিক। কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন অনেক সাংবাদিক ও সঙ্গে তাঁর পরিবার। অনেকে মারা গেছেন। করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া প্রথম সাংবাদিক দৈনিক সময়ের আলোর নগর সম্পাদক হুমায়ুন কবির খোকন। এক এক করে আমরা অন্তত ৪০ জন সাংবাদিককে কভিড সময়ে হারিয়েছি। প্রথিতযশা এসব সাংবাদিকের প্রয়াণে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। সাংবাদিকরা মারা যাচ্ছেন কিন্তু সহকর্মীরা ভোলেননি তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। একদিকে সহকর্মীর মৃত্যুশোক অন্যদিকে ছুটছেন খবর সংগ্রহে।

 

করোনাকাল সাংবাদিকদের পেশাগত জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। একদিকে মৃত্যুঝুঁকি অন্যদিকে টিকে থাকার সংগ্রাম। একদিকে আপনজন হারানোর শোক অন্যদিকে কর্তব্যের টানে ছুটে যাওয়া। নারী সাংবাদিকদের জন্য ছিল চ্যালেঞ্জ আরও বেশি। এই সময়ে কাজের বাড়তি চাপ নিতে হয়েছে তাঁদের। গৃহকাজে সহায়তা যারা করতেন তাঁদের ছুটি দিয়ে দেওয়ায় একদিকে অফিস অন্যদিকে ঘরের কাজ সবই করতে হচ্ছে। ছাঁটাইয়ের আতঙ্কও থাকে তাঁদের বেশি।

 

সাংবাদিকদের মোকাবিলা করতে হয়েছে নানা ষড়যন্ত্র ও গুজবের। আর সামাজিক যোগাযোগ -মাধ্যমের অপতথ্যের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে তাঁদের। যে কোনো গুজবের জবাব সঠিক তথ্য দেওয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে যা পারছে তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে আজকের সাংবাদিকতায় এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাংবাদিকদের এ চ্যালেঞ্জ বরাবরই মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

করোনার সময় অনেক সাংবাদিক চাকরিচ্যুত হয়েছেন। বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক সাংবাদিক বেকার হয়েছেন। সব গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিক পাশে এসে দাঁড়াননি। এর মধ্যে আমরা হারিয়েছি ডেইলি স্টারের অন্যতম উদ্যোক্তা ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান ও দৈনিক যুগান্তরের মালিক যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলকে। এ দুজন শিল্পপতির মৃত্যুতেও সাংবাদিকসমাজে শোকের ছায়া নেমে আসে। সাংবাদিকরা তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠিত হন, কিছুটা হতাশা নেমে আসে।

এসবের মধ্যেই সাংবাদিকরা আশায় বুক বাঁধেন। সংগঠনগতভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে একে অন্যের পাশে দাঁড়ান। কার ঘরে খাবার নেই, কে অর্থকষ্টে আছেন কার চিকিৎসা সহায়তার প্রয়োজন, কার অ্যাম্বুলেন্স লাগবে এসব খোঁজখবর রেখেছেন, যথাসাধ্য সমাধানের চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে জাতীয় প্রেস ক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি, ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার সাংবাদিক ও তাঁদের পরিবারের জন্য করোনা পরীক্ষার বুথ স্থাপনসহ নানাভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে। সাংবাদিকদের অন্য সংগঠনগুলোও নানাভাবে এগিয়ে এসেছে। জরুরি স্বাস্থ্যসামগ্রী যেমন স্যানিটাইজার, মাস্ক, পিপিই ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছে। জাতীয় প্রেস ক্লাব করোনা বুথ স্থাপন ছাড়াও অ্যাম্বুলেন্স সুবিধা ও হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে যাতে সাংবাদিকরা জরুরি চিকিৎসা সুবিধা পান। এমন একটা সময় গেছে হাসপাতাল হাসপাতাল ঘুরে ভর্তির জন্য সিট পাওয়া যেত না, পথেই অনেককে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। তবে এ দুর্যোগের সময়ে সাংবাদিকদের কথা ভোলেননি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি চাকরিচ্যুত ও অসচ্ছল সাংবাদিকদের আর্থিক অনুদান দিয়েছেন। তিনি দলমত-নির্বিশেষে সাংবাদিক ইউনিয়নের মাধ্যমে এ অর্থ সারা দেশে বিতরণ করেছেন। দুর্যোগের সময় এই সামান্য অর্থটুকু আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে।

সারা বিশ্বের সবার মতো বাংলাদেশের সাংবাদিকদের জন্য করোনা নতুন বিষয়। তার পরও বিশ্ব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেশে ছোবল আনার অনেক আগেই সাংবাদিকরা সতর্ক করেছিলেন। তবে স্বাস্থ্য বিভাগ বারবার বলেছিল তারা যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত আছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে এ রকম পরিস্থিতির জন্য তারা মোটেই প্রস্তুত ছিল না, সবকিছুতে একটা হযবরল অবস্থা। কিন্তু সাংবাদিকরা তাঁদের কর্তব্য ঠিক করে ফেলেছিলেন। এ জটিল পরিস্থিতিতে সাংবাদিকরা তাঁদের যথাযথ কর্তব্যটি করেছেন। এ সময়টি ছিল তাঁদের জন্য নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের। করোনা টেস্টের অপর্যাপ্ততা, হাসপাতাল ও আইসিইউর সংকট এবং স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি মানুষকে দিশাহারা করে দেয়। এ সুযোগে ভুয়া করোনা পরীক্ষা কেন্দ্র গড়ে ওঠে। সেই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার অপপ্রচার। কভিড সময়ে নানা গুজবের জন্ম হয়েছে, অভিযোগে কেউ কেউ গ্রেফতারও হয়েছেন। এজন্য তথ্য যাচাইয়ে সাংবাদিকদের নিতে হয়েছে অতিরিক্ত সতর্কতা। কারণ সাংবাদিকদের মাথার ওপর ঝুলছে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আক্রান্তের আশপাশে যাওয়া যাবে না, বলা হচ্ছে মৃতদেহ থেকে করোনাভাইরাস ছড়ায়, এমনকি সাংবাদিকদের হাসপাতালে যাওয়ার ব্যাপারেও নিরুৎসাহ করা হচ্ছে। সেখানে নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে সঠিক তথ্য তুলে আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। একটি জটিল পরিস্থিতিতে সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে সাংবাদিকরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সময়ে অন্তত আটটি জাতীয় দৈনিক সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হলো। কোনো কোনো পত্রিকা বাসা থেকে অফিস চালু করল। কভিড-১৯ আমাদের সাংবাদিকতারও অনেক কিছু শিখিয়ে দিল। একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সবাই যার যার বাসা থেকে কাজ করেছেন। পালাক্রমে এক-দুজন অফিসে থেকে কাজের সমন্বয় করে পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। কোনো কোনো পত্রিকা অফিসে এক গ্রুপ দিন-রাত অফিসেই থেকেছে। যাতে এদের কেউ অসুস্থ হলে সবাইকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো যায়। এক সপ্তাহ পরে অন্য এক দল কাজে যোগ দিয়েছে। এভাবে পত্রিকা প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যেই সাংবাদিকরা অসুস্থ হয়েছেন, মারা গেছেন। পত্রিকার সাংবাদিকদের চেয়ে টেলিভিশন সাংবাদিকদের জন্য এ চ্যালেঞ্জ ছিল বহুমাত্রিক। তাঁদের বাসা থেকে অফিস করার সুযোগ নেই। তাঁদের ঘটনাস্থলে যেতে হয়েছে। তাঁরা অনেক বেশি ঝুঁকি নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটেছেন, দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেছেন, সচেতনতার কাজটি করেছেন। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বাসা থেকে অতিথিদের সংযোগ করে টকশো প্রচার অব্যাহত রেখেছে। অবশ্য এখনো অনেকে বাসায় থেকেই সংযুক্ত হচ্ছেন।

অনেক অপপ্রচার মোকাবিলাও সাংবাদিকরা করেছেন। বিদেশ থেকে কেউ এলে তাকে একঘরে করে রাখা এবং লাল পতাকা টানিয়ে দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়া হতো। এই বিদেশফেরতদের কিংবা কোথাও করোনা আক্রান্ত হয়েছেন জানলেই তার পরিবারকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা হতো। তাই কভিড আক্রান্ত হলে সাধারণত মানুষ তা গোপন রাখার চেষ্টা করতেন। অক্রান্ত ও তার পরিবারের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হতো। গণমাধ্যম মানুষকে মানবিক আচরণ করার আবেদন-সংবলিত নানা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। একজন গণমাধ্যমকর্মী যখন আক্রান্ত হলেন সে প্রতিষ্ঠানটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা প্রকাশ করেছে। এখানেও এ প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের দুজন কর্মী প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেন।

করোনাকাল সাংবাদিকদের পেশাগত জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। একদিকে মৃত্যুঝুঁকি অন্যদিকে টিকে থাকার সংগ্রাম। একদিকে আপনজন হারানোর শোক অন্যদিকে কর্তব্যের টানে ছুটে যাওয়া। নারী সাংবাদিকদের জন্য ছিল চ্যালেঞ্জ আরও বেশি। এই সময়ে কাজের বাড়তি চাপ নিতে হয়েছে তাঁদের। গৃহকাজে সহায়তা যারা করতেন তাঁদের ছুটি দিয়ে দেওয়ায় একদিকে অফিস অন্যদিকে ঘরের কাজ সবই করতে হচ্ছে। ছাঁটাইয়ের আতঙ্কও থাকে তাঁদের বেশি। সব প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় আগে নারীকে ছাঁটাই করার তালিকায় রাখা হয়। গণমাধ্যমকর্মীরা টিকে থাকার লড়াইয়ে রাত-দিন পরিশ্রম করেছেন। অথচ পত্রিকাগুলো বেশির ভাগ পড়ে থাকত বাড়ির বাইরে। গুজব ছড়ানো হয়েছে পত্রিকা থেকে ভাইরাস ছড়ায়। কোনো কোনো কাগজকে বিজ্ঞাপন দিয়ে বলতে হয়েছে কাগজ থেকে ভাইরাস ছড়ায় না। এই সময়ে টেলিভিশনের দর্শক, রেডিওর শ্রোতা বেড়েছে কিন্তু খবরের কাগজের পাঠকসংখ্যা কমেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী পত্রিকার প্রচারসংখ্যা কমে যায়। তবে বর্তমানে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ব মিডিয়াও। প্রচারসংখ্যা আবার বাড়ছে বিশ্বের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক জাপানি ভাষায় প্রকাশিত ‘দ্য ইয়োমিউরি শিমবুন’সহ বিশ্বের অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাগজগুলোর।

কভিড-১৯ এখনো পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়নি। জীবন-জীবিকার তাগিদে ঘুরে দাঁড়িয়েছে মানুষ। বিশ্বের অন্য গণমাধ্যমের সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমও। কভিড-১৯ আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। গণমাধ্যমকেও  নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে অনেক কিছু। অভিজ্ঞতার ঝুলিতে অনেক সঞ্চয়। এর আলোকে আমাদের গণমাধ্যমকেও ঢেলে সাজাতে হবে। গণমাধ্যমকর্মীরা সারা বছর ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও নেই ঝুঁকিভাতা। আর্থিক সংকটে পড়লে কর্মী ছাঁটাই না করে কীভাবে প্রতিষ্ঠান চালানো যায় প্রয়োজন সে রকম তহবিল গঠন। এ তহবিল মালিক, সাংবাদিক, সরকার সব পক্ষ মিলেই হতে পারে।

লেখক : সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব।

সর্বশেষ খবর