বৃহস্পতিবার, ১৮ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা
খালেদ মাসুদ পাইলট

বিশ্বমর্যাদায় বাংলাদেশের ক্রিকেট

বিশ্বমর্যাদায় বাংলাদেশের ক্রিকেট

‘ক্রিকেট এখন বিশ্বমর্যাদার আসনে’- এটা কেমন হেডলাইন! আমি যদি এ হেডলাইন পরিবর্তন করি তাহলে কি ক্ষতি হবে?

যখন থেকে আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্রিকেট খেলছি, তখন থেকেই তো বিশ্বমর্যাদায় বাংলাদেশের ক্রিকেট। তাই আমি একটু পাল্টে দিয়ে বলি, ‘বিশ্বমর্যাদায় বাংলাদেশের ক্রিকেট’।

স্বাধীনতার আগেও বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলা হতো। তখন পাকিস্তানের ক্রিকেটাররাও খেলতেন। আমাদেরও অনেক ভালোমানের ক্রিকেটার ছিলেন। তারাও খেলতেন। তবে দুঃখ এটাই ছিল, সে সময় আমাদের ক্রিকেটাররা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারেননি। অথচ আমাদের ক্রিকেটারদের সামর্থ্য ছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার।

স্বাধীনতার পর যখন দেশে ক্রিকেট শুরু হয় তখন শুধু আমাদের দেশের লোকেরাই খেলতেন। ১৯৭৬ সালে প্রথম বিদেশি দল এমসিসি খেলতে আসে দেশে। তখনই বিশ্ব ক্রিকেটে নাম লেখায় বাংলাদেশ। ১৯৭৯ সাল থেকে আইসিসি ট্রফি খেলার পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। ১৯৮৬ সালে আমরা যখন প্রথম এশিয়া কাপ খেলি তখনই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দল হিসেবে স্থায়িত্ব পায়। সেই শুরু। এর পর থেকে আমরা বিশ্বকাপ খেলছি। টেস্ট খেলছি, টি-২০ খেলছি। বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীরা এখন আমাদের ক্রিকেটারদের নাম জানেন। সবাই আমাদের খেলা দেখেন। আমি একজন ক্রিকেটার, বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এজন্য গর্ববোধ করি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমরা এখন বেশ শক্ত অবস্থানে। আমরা জয় পাচ্ছি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। জয় পাচ্ছি ঠিকই তবে এ জয় আসত নিয়মিত, একটি জায়গায় আমূল পরিবর্তন আনলে।

শুধু আমাদের দেশ নয়, বিশ্বের যে কোনো দেশের ক্রিকেট উন্নয়ন করতে অবকাঠামোর আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। একই সঙ্গে সঠিক পরিকল্পনা থাকতে হবে। তার বাস্তবায়নও করতে হবে সঠিকভাবে। পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক ইমরান খান এখন দেশটির সরকারপ্রধান। তিনি কিছু দিন আগে বলেছিলেন, ‘ভারত এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা দল, কারণ দেশটির ক্রিকেট বোর্ড সে দেশের ক্রিকেট উন্নয়নে অবকাঠামোর দারুণ উন্নতি করেছে।’ আমাদের ক্রিকেট বোর্ডেরও উচিত দেশের ক্রিকেট উন্নয়নে অবকাঠামোর উন্নয়ন করা। অবকাঠামোর উন্নয়ন কীভাবে করতে হবে? এর ব্যাখ্যায় আমি বলি একটি বাড়ির কথা ভাবুন। বাড়িটি সুন্দর ও শক্তিশালী করতে একটি ডিজাইনের দরকার হয়। সুন্দরের জন্য কটি জানালা, কটি দরজা, কোন দিকে বারান্দা রাখতে হবে সেসব থাকতে হয় ডিজাইনে। একইভাবে বাড়িটি শক্তিশালী করতে পিলার কটি লাগবে এসবও থাকতে হয়। ঠিক একইভাবে ক্রিকেটে উন্নতি করতে হলে অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে।

পরিকল্পনায় থাকতে হবে গতিশীল পেস বোলার তৈরি করতে কেমন উইকেট থাকা উচিত। ঘাস আচ্ছাদিত বাউন্সি উইকেট জরুরি। কারণ বিদেশে জিততে হলে বাউন্সি উইকেটে খেলার অভ্যস্ততা থাকতে হবে ক্রিকেটারদের। আবার স্পিন উইকেটও থাকতে হবে। কারণ পরিচিত পরিবেশের সুবিধা নিতে উইকেটও তেমন বানাতে হবে। শুধু বোলার তৈরির জন্য নয়, বিশ্বমানের ব্যাটসম্যান বানানোর জন্যও সঠিক পরিকল্পনা থাকা জরুরি। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমাদের ক্রিকেট বোর্ডের তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই। ক্রিকেট উন্নয়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা থাকা দরকার। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে একটি দেশ, তার প্রমাণ জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়া। জিম্বাবুয়ের সম্ভাবনা ছিল অনেক শক্তিশালী দল হওয়ার। কিন্তু পরিকল্পনা সঠিক ছিল না বলে দেশটির অবস্থান দিন দিন নিচের দিকে নামছে। কেনিয়া তো এখন স্মৃতির খাতায় লেখা নাম। শুধু পরিকল্পনা ও অবকাঠামোর অভাব বলেই দেশটি এখন ক্রিকেটে নেই বললেই চলে। দেশগুলো আসলে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি।

বাংলাদেশে কিন্তু কোনো কিছুর অভাব নেই। আমরা খুবই ভাগ্যবান যে খেলাধুলার প্রতি আমাদের সরকারের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। আমাদের মতো ক্রিকেট ভালোবাসে এমন দর্শক বিশ্বের খুব কম দেশেই রয়েছে। এ ছাড়া অর্থেরও অভাব নেই আমাদের ক্রিকেটে। অর্থ আয়ের উৎসও রয়েছে। বিশ্বের অন্যতম ধনী ক্রিকেট বোর্ড বিসিবির আরও ৩০ শতাংশ আয়ের সুযোগ রয়েছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে স্পন্সর জোগাড় করলে আয়ও বাড়বে। ঢাকার প্রিমিয়ার ক্রিকেটের স্পন্সর যে কোনো একটি বড় কোম্পানিকে দিলে আয়ও বাড়বে।

১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের পর কয়েক শ কোটি টাকা আয় করেছে বিসিবি। কিন্তু দুঃখের কথা, তার নিজস্ব কোনো মাঠ নেই। যদিও পূর্বাচলে নিজস্ব একটি মাঠ তৈরি হচ্ছে বিসিবির।

ক্রিকেট বোর্ডের উচিত দেশের প্রতিটি বিভাগে নিজস্ব মাঠ তৈরি করা। নিজেদের মাঠ থাকলেই বেশি বেশি ম্যাচের আয়োজন করা যাবে। বেশি বেশি ক্রিকেটার তৈরি হবে। অথচ বিসিবির সেদিকে নজর নেই। আমি বলব ক্রিকেট বোর্ডের কর্তাব্যক্তিদের সেদিকে নজর নেই।

আমি মনে করি বিসিবির ২৬ পরিচালকের দরকার নেই। আমি বলি না পরিচালকরা ভালো নন। একসময় এতসংখ্যক পরিচালক দরকার ছিল। যখন আমরা গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে শুরু করেছিলাম তখন দেশের ক্রিকেট শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল। এখন আমরা একটি শক্ত বেজমেন্টের ওপর দাঁড়িয়ে। এখন আর প্রয়োজন দেখি না। দেশের ক্রিকেটের উন্নয়নের জন্য বিভাগ অনুযায়ী পরিচালক থাকবেন। তাদেরই পরিচালক করা হবে যাদের ব্যাকগ্রাউন্ড ক্রিকেটার। এ ছাড়া অনারারি পরিচালকও রাখা উচিত। দেশের ক্রিকেট উন্নয়নে বসুন্ধরা, ওয়ালটন, এক্মি, বেক্সিমকো- বড় বড় এসব কোম্পানিকে অবশ্যই অনারারি পরিচালক করা উচিত। বিভাগীয় পরিচালকের কার্যক্রমের ব্যবচ্ছেদ করবেন বিভাগগুলোর অন্য কর্মকর্তারা। প্রত্যেক পরিচালকের নেতৃত্বে একটি দল থাকবে, যারা ক্রিকেট উন্নতির জন্য কাজ করবেন।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের আজকের অবস্থানে আসার পেছনে অন্যতম অবদান ক্রিকেটারদের। বহুকষ্টে তারা ক্রিকেট খেলেছেন। আজ অর্থের অভাব নেই। অথচ স্বাধীনতার পর নিজ অর্থে ক্রিকেট খেলতেন ক্রিকেটাররা। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা সুযোগ-সুবিধা পেতে থাকেন ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে। আজ সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মুস্তাফিজুর রহমানদের সবাই চেনে। ভবিষ্যতে এদের মতো ক্রিকেটার বের করতে হলে দরকার সঠিক পরিকল্পনা। একই সঙ্গে পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়নও দরকার।

সাকিব আল হাসান বিশ্বমানের তারকা। বিশ্বের যে কোনো দেশে খেলার যোগ্যতা রাখে সাকিব। সত্যিকার অর্থে সে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। মাশরাফিও বড় তারকা। কিন্তু সে লোকাল অ্যাম্বাসাডর।

অনেক দিন ধরেই দেখছি সাকিবকে নিয়ে বেশ কথা হচ্ছে। সাকিব টেস্ট খেলতে চায় না- এ বিষয়ে আমি ভালো করে জানি না। তার বয়স ৩৪-৩৫। আর কয় বছর ক্রিকেট খেলতে পারবে সে? সে দেশকে অনেক দিয়েছে। খেললে আরও দেবে। কিন্তু এও ভাবতে হবে, আর্থিক বিষয়টি পুরোপুরি জড়িত। সে যদি টেস্ট না খেলে তাহলে সে ১০ গুণ টাকার প্রস্তাব পাবে। এটা ভাবতে হবে সবাইকে। আর মুশফিক, রিয়াদরা যদি টেস্ট না খেলে তাহলে তাদের আর্থিক ক্ষতি। কারণ তারা দেশের বাইরে খেলার প্রস্তাব খুব বেশি পায় না। এখন ঝামেলা হচ্ছে ক্রিকেটারদের টেস্ট খেলা নিয়ে। চুক্তির আগেই বিষয়গুলো মাথায় রাখা উচিত ক্রিকেট বোর্ডের; যাতে ভবিষ্যতে কোনো ঝামেলা না হয়। বাংলাদেশের ক্রিকেট এগিয়ে যাক আরও অনেক দূর। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হোক- এমনটাই চাই আমি একজন ক্রিকেটার হিসেবে। আমরা যখন ক্রিকেট খেলেছি তখন স্বপ্ন দেখতাম জাতীয় দলে খেলব। টেস্ট খেলব। এখনকার ক্রিকেটাররা এত বেশি সুযোগ পাচ্ছেন, তাদের স্বপ্ন দেখা উচিত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার।

লেখক : সাবেক অধিনায়ক, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।

সর্বশেষ খবর