শনিবার, ২০ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা
বাঙালির শাসনতন্ত্র - ৪ নভেম্বর ১৯৭২, জাতীয় সংসদ, ঢাকা

আমি স্বীকার করি, আমার দল স্বীকার করে, শক্তির উৎস হলো জনগণ

আমি স্বীকার করি, আমার দল স্বীকার করে, শক্তির উৎস হলো জনগণ
সংসদে অনেকবারই ভাষণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তবে এই ভাষণটি খুব বিখ্যাত কারণ এইদিন বাংলাদেশ প্রথম শাসনতন্ত্র পেয়েছিল। শাসনতন্ত্র পেতে ভারতের লেগেছিল আড়াই বছর, পাকিস্তানের সাড়ে আট; সেখানে নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের লাগে মাত্র সাড়ে দশ মাস। সেই শাসনতন্ত্রের খসড়া অনুমোদন অনুষ্ঠানে সংসদে সংবিধানের মূল চারটি নীতি ব্যাখ্যা করেন বঙ্গবন্ধু...

 

আজ প্রথম সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তাদের শাসনতন্ত্র পেতে যাচ্ছে। বাংলার ইতিহাসে বোধ হয় এই প্রথম নজির যে বাঙালিরা তাদের নিজেদের শাসনতন্ত্র প্রদান করছে। বোধ হয় নয়, সত্যিই প্রথম-বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিরা জনগণের ভোটের মারফতে গণপরিষদে এসে তাঁদের দেশের শাসনতন্ত্র প্রদান করছেন। তদানীন্তন ভারতবর্ষ, যাকে আমরা উপমহাদেশ বলতাম-সেখানে সে যুগে যে স্বাধীনতাসংগ্রাম হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামীরাই রক্তদান করেছে বেশি। কিন্তু দুঃখ, বাঙালির জীবনে সুখ কোনো দিন আসেনি। বাংলাদেশ সম্পর্কে ঠাট্টা করে একবার আমাকে একজন বলেছিল, তোমার বাংলার উর্বর জমি তোমার দুঃখের কারণ। তাই বোধ হয় শকুনিদের বারবার এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গেছে। তারা বাংলার অর্থ, বাংলার সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে অন্যত্র। গৃহহারা, সর্বহারা, কৃষক, মজুর, দুঃখী বাঙালি যারা সারা জীবন পরিশ্রম করেছে, দুবেলা পেটভরে খেতে পায়নি, তাদেরই সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে কলকাতার বন্দর, বোম্বাই, মাদ্রাজ, তাদেরই সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে করাচি, ইসলামাবাদ, লাহোর, গড়ে উঠেছে ডান্ডি, গ্রেট ব্রিটেন। এই বাংলার সম্পদ ছিল বাঙালির দুঃখের কারণ। সংগ্রামী বাঙালিরা বারবার এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাঁদের কথা আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয়। কারণ বাঙালি আজ শাসনতন্ত্র পেতে যাচ্ছে।

স্পিকার সাহেব, বিপ্লবের পর ৯ মাসের মধ্যে শাসনতন্ত্র দেওয়া, মানুষের মৌলিক অধিকার দেওয়ার কারণ হলো আমরা জনগণের ওপর বিশ্বাসী। এই জনগণের ওপর আস্থা নিয়েই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। জনগণের ওপর আমার আস্থা রয়েছে। জনগণকে আমরা ভয় পাই না; জনগণকে আমরা ভালোবাসি। সে জন্য আজ আপনার মাধ্যমে আমি আমার সহকর্মীদের আন্তরিক ধন্যবাদ না দিয়ে পারি না। তাঁরা রাত-দিন অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করে খসড়া শাসনতন্ত্র রচনা করে তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। পাঁচ বছর পর্যন্ত আমরা অনায়াসে শাসনযন্ত্র চালাতে পারতাম, কেউ চ্যালেঞ্জ করলে বাংলার মানুষের কাছে গণভোট দিয়ে প্রমাণ করে দিতাম যে বাংলার মানুষ কাদের ভালোবাসে; কিন্তু তা আমরা চাইনি, চেয়েছি মানুষের অধিকার। এই অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছিলাম। তাই আজ শাসনতন্ত্র দিয়েছি। আমার সহকর্মীর একজনও আপত্তি করেন নাই যে আমরা পরিষদ ভাঙব না। এ জন্য আমি গর্বিত। যাঁরা এই পরিষদের সদস্য হয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন, যাঁরা এই গণপরিষদ সদস্য তাঁরা শাসনতন্ত্র পাস করে বলতে পারতেন যে ভবিষ্যতে আমরা জাতীয় পরিষদরূপে কাজ করব। কারও কিছু বলার অধিকার ছিল না। কেননা কনভেনশনের রীতি রয়েছে; কিন্তু তা করা হয় নাই। ৯ মাসের মধ্যে যে শাসনতন্ত্র দেওয়া হয়েছে এটা হলো আর একটি নতুন দৃষ্টান্ত। আমি আগেই বলেছি শাসনতন্ত্র ছাড়া, মৌলিক অধিকার ছাড়া দেশের অবস্থা হয় মাঝিহীন নৌকার মতো। তাই মানুষের মৌলিক অধিকার যাতে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে তারই জন্য আমাদের পার্টি এই শাসনতন্ত্র প্রদান করল। আশা করি, জনগণ শাসনতন্ত্র গ্রহণ করবে।

আমরা জনগণের প্রতিনিধি। নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা এখানে এসেছি। কেউ আমাদের পকেট থেকে বের করে দেন নাই অথবা আমরা আসমান থেকে পড়ি নাই কিংবা কেউ এসে আমাদের মার্শাল ল জারি করে বসিয়ে দেন নাই। মার্শাল ল জারি আমরাও করতে পারতাম। যেদিন আমার বন্ধুরা, সহকর্মীরা এখানে এসে সরকার বসান, সেদিন তাঁরা বলতে পারতেন, এমারজেন্সি, নো ডেমোক্রেসি, নো টক ফর থ্রি ইয়ার্স এবং সেটা মানুষ গ্রহণ করত। কোনো সমালোচনা চলবে না, কোনো কথা বলা চলবে না, কোনো মিছিল হবে না, কোনো পার্টির কাম চলবে না। কারণ দেশের যা অবস্থা ছিল, তাতে এটা সহজেই করা যেত। সব দেশে, সব যুগে বিপ্লবের পরে তা-ই হয়েছে। কিন্তু আমরা সেটা চাই নাই। শক্তি আমাদের ছিল। আমাদের শক্তি আমাদের জনগণ। কেউ যদি মনে করেন যে শক্তির উৎস বন্দুকের নল-আমি স্বীকার করি না। আমি স্বীকার করি, আমার দল স্বীকার করে, শক্তির উৎস হলো জনগণ।

জনাব স্পিকার সাহেব, চারটি মূলস্তম্ভের ওপর এই শাসনতন্ত্র রচিত হয়েছে। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। জাতীয়তাবাদ না হলে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। জাতীয়তাবাদের অনেক সংজ্ঞা আছে। আমি শুধু বলতে পারি আমি যে বাংলাদেশের মানুষ, আমি একটা জাতি। এই যে জাতীয়তাবাদ, সে সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন আর কৃষ্টিই বলুন, সকলের সাথে একটা জিনিস রয়েছে, সেটা হলো অনুভূতি। এই অনুভূতি যদি না থাকে, তাহলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না এবং জাতীয়তাবাদ আসতে পারে না। অনেক জাতি দুনিয়ায় আছে, যারা বিভিন্ন ভাষাবলম্বী হয়েও এক জাতি হয়েছে। অনেক দেশে আজ একই ভাষা, একই ধর্ম, একই সব কিছু, কিন্তু সেখানে বিভিন্ন জাতি গড়ে উঠেছে, তারা একটি জাতিতে পরিণত হতে পারে নাই। জাতীয়তাবাদ নির্ভর করে অনুভূতির ওপর। আজ বাঙালি জাতি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে; এই সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল যার ওপর ভিত্তি করে, এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে যার ওপর ভিত্তি করে, সেই অনুভূতি আছে বলেই আজকে আমি বাঙালি, আমার ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদ।

দ্বিতীয় কথা, আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র-সেই গণতন্ত্র, যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে থাকে। গণতন্ত্র যেসব দেশে চলেছে, দেখা যায় সেসব দেশে গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের প্রটেকশন দেওয়ার জন্য কাজ করে। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা চাই, শোষিতের গণতন্ত্র এবং সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হলো-আমার দেশে যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে তাতে সেসব বন্দোবস্ত করা হয়েছে, যাতে এ দেশের দুঃখী মানুষ রক্ষা পায়; শোষকেরা যাতে রক্ষা পায়, তার ব্যবস্থা নাই। সে জন্য আমাদের গণতন্ত্রের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য আছে। নিশ্চয়ই আমরা কারোর ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হাত দিচ্ছি না। কিন্তু যে চক্র দিয়ে মানুষকে শোষণ করা হয়, সেই চক্রকে আমরা জনগণের জন্য ব্যবহার করতে চাই। তার জন্য আমরা প্রথমেই ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, কাপড়ের কল, পাটকল, চিনির কারখানা-সব কিছু জাতীয়করণ করে ফেলেছি। তার মানে হলো, শোষকগোষ্ঠী যাতে এই গণতন্ত্র ব্যবহার করতে না পারে। শোষিতকে রক্ষা করার জন্য এই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হবে।

তৃতীয়, সোশ্যালিজম, সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। একেক দেশ একেক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সেই দেশের কী আবহাওয়া, কী ধরনের অবস্থা, কী ধরনের মনোভাব, কী ধরনের আর্থিক অবস্থা-সব কিছু বিবেচনা করে ক্রমে এগিয়ে যেতে হয়। রাশিয়া যে পন্থা অবলম্বন করেছে, চীন তা করেনি। রাশিয়ার পাশে বাস করেও যুগোস্লাভিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া নিজ দেশের পরিবেশ নিয়ে, নিজ জাতির পটভূমি নিয়ে সমাজতন্ত্রের অন্য পথে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যান, দেখা যাবে, ইরাক একদিকে এগিয়ে চলেছে, আবার মিসর অন্যদিকে চলেছে। বিদেশ থেকে হাওলাত করে এনে কোনো দিন সমাজতন্ত্র হয় না; তা যাঁরা করেছেন, তাঁরা কোনো দিন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নাই। কারণ লাইন, কমা, সেমিকোলন পড়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না-যেমন তা পড়ে আন্দোলন হয় না। সে জন্য দেশে পরিবেশ, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের রীতিনীতি, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব-সব কিছু দেখে ক্রমে এগিয়ে যেতে হয়। একদিনে সমাজতন্ত্র হয় না। কিন্তু আমরা ৯ মাসে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছি, তা আমার মনে হয় দুনিয়ার কোনো দেশ, যারা বিপ্লবের মাধ্যমে সোশ্যালিজম এনেছে তারাও সেগুলো করতে পারেন নাই-এ ব্যাপারে আমি চ্যালেঞ্জ করছি। কোনো কিছু প্রচলন করলে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি হয়ই। সেটা প্রসেসের মাধ্যমে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়।

তার পরে এলো ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।

জনাব স্পিকার সাহেব, আজকে আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। এই শাসনতন্ত্রের জন্য কত সংগ্রাম হয়েছে এই দেশে। আজকে আমার দল যে ওয়াদা করেছিল তার এক অংশ পালন করল; কিন্তু জনতার শাসনতন্ত্রে কোনো কিছু লেখা হয় না।

তারা এটা গ্রহণ না করলে প্রবর্তন করা হবে না, ব্যবহার না করলে হবে না। ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ গঠন করতে পারে, তাহলে আমার জীবন সার্থক, শহীদের রক্তদান সার্থক। ভবিষ্যৎ বংশধর, ভবিষ্যৎ জনসাধারণ কী করে কীভাবে শাসনতন্ত্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করবে, তারই ওপর নির্ভর করে শাসনতন্ত্রের সাফল্য, তার কার্যকারিতা।

                ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ’ থেকে, সংক্ষেপিত

সর্বশেষ খবর