শনিবার, ২০ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা
সেনা নির্দেশনা - ১১ জানুয়ারি ১৯৭৫, সামরিক একাডেমি, কুমিল্লা

তোমাদের মধ্যে যেন পাকিস্তানি মেন্টালিটি না আসে। তোমরা পাকিস্তানের সৈনিক নও, বাংলাদেশের সৈনিক

তোমাদের মধ্যে যেন পাকিস্তানি মেন্টালিটি না আসে। তোমরা পাকিস্তানের সৈনিক নও, বাংলাদেশের সৈনিক

’৬৫-র পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ই সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সামরিক বাহিনীর গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এরপরই ছয় দফায় পূর্ব বাংলায় সামরিক একাডেমি ও নৌ সদর দফতর স্থাপন ও প্রতিরক্ষায় স্বনির্ভরতার দাবি তুলেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজেই গড়ে তুলেছেন সেই সামরিক একাডেমি। সেই একাডেমিতেই প্রথম ব্যাচের ক্যাডেটদের শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে কেমন অফিসার চান, জানাচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান

 

বহুকাল সংগ্রাম করেছিলাম যে বাংলাদেশে মিলিটারি একাডেমি হোক। কিন্তু পারি নাই। আজ লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। সেই জন্যই আজ বাংলাদেশের মাটিতে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশের মালিক আজ বাংলাদেশের জনসাধারণ। সেই জন্যই সম্ভব হয়েছে আজ আমার নিজের মাটিতে একাডেমি করা। আশা করি, ইনশাআল্লাহ এমন দিন আসবে, এই একাডেমির নাম শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ই নয়, সমস্ত দুনিয়াতে সম্মান অর্জন করবে।

ক্যাডেট ভাইয়েরা, আজ তোমরা ট্রেনিং শেষ করলা। একপর্যায়ের শেষ, আরেক পর্যায়ের শুরু। এ পর্যায়ের দায়িত্ব অনেক বেশি। আজ তোমরা ট্রেনিং সমাপ্ত করে সামরিক বাহিনীর কর্মচারী হতে চলেছ। জাতির উপর তোমার দায়িত্ব, জনগণের উপর তোমার দায়িত্ব, দেশের উপর তোমার দায়িত্ব এবং যে সমস্ত সৈনিককে তোমরা আদেশ-উপদেশ দেবা, তাদের উপর দায়িত্ব, তোমার কমান্ডের উপর তোমার দায়িত্ব, তোমার নিজের উপর তোমার দায়িত্ব। তোমাদের দায়িত্বজ্ঞান থাকা প্রয়োজন। তা না থাকলে জীবনে মানুষ হতে পারবা না। শৃঙ্খলা ছাড়া কোনো জাতি বড় হতে পারে নাই।

আজ এই একাডেমির কিছুই নাই ধরতে গেলে। আমরা সামান্য কিছু নিয়ে শুরু করেছিলাম। অনেক অসুবিধার মধ্যে তোমাদের ট্রেনিং নিতে হয়েছে। সব কিছু তোমাদের দিতে পারি নাই। তোমাদের কমান্ডাররা অনেক কষ্টের মধ্যে তোমাদের ট্রেনিং দিয়েছে। কিন্তু আজ যা আমি দেখলাম, তাতে আমি বিশ্বাস করতে পারি, যদি পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়, আমার ছেলেদের এই শক্তি আছে, যে কোনো দেশের যে কোনো সৈনিকের সঙ্গে তারা মোকাবিলা করতে পারে। তবে এক দিনে কিছুই হয় না। তিন বছর হলো স্বাধীনতা পেয়েছি। যতটুকু দরকার, চেষ্টার ত্র“টি করা হয় নাই। এমনকি নিজের চেষ্টা করেও জোগাড় করে এদিক-ওদিক থেকে কাজ আরম্ভ করা হয়েছে।

তোমরা জানো না, তোমরা ছোট ছিলা, স্কুলে পড়তা বা তোমরা বাচ্চা ছিলা। পাকিস্তানিরা দুনিয়াকে বুঝায়েছিল যে বাঙালিরা যুদ্ধ করতে জানে না। তারা বাঙালিদের সৈন্য বাহিনীতে নিত না। আমার মনে আছে, বহু আগে, আইয়ুব খান যখন কমান্ডার ইন চিফ ছিলেন, তখন তিনি গোপনে সার্কুলার দিয়েছিলেন যে বাঙালিদের ২ পার্সেন্টের বেশি নেওয়া যেন না হয়। সে কাগজ আমি যেভাবে হয় পেয়ে যাই আর তাই নিয়ে তোলপাড় শুরু করি। যদিও সেই হুকুম তাঁরা উইথড্র করেন; কিন্তু ছলে-বলে-কৌশলে বাংলাকে দাবিয়ে রেখেছেন।

বাঙালিরা সামরিক বাহিনীতে যোগদান করতে পারে না। বাঙালিরা কাপুরুষ, বাঙালিরা যুদ্ধ করতে জানে না। পাকিস্তানের সৈন্যরা বাংলার মাটিতে দেখে গেছে যে কেমন করে বাঙালিরা যুদ্ধ করতে পারে। মুক্তিবাহিনীর ভয়েতে তাদের বড় বড় শক্তিঅলা, ভুঁড়িঅলাদের জান শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমরা বাঙালিরা কাপুরুষ নই। আমি আমার মাতৃভূমিকে ভালোবাসতে পারি।

যুগ যুগ ধরে বাঙালিরা পরাধীন ছিল। ২০০ বছর ইংরেজের আমরা পরাধীন ছিলাম। ২৫ বছর পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু দল ছলে-বলে-কৌশলে আমার বাংলার মাটিকে দখল করে শোষণ করেছিল। এই ক্যান্টনমেন্টে বাঙালিদের স্থান ছিল না। যাওয়ার সময় বাঙালিদের রাস্তায় অপমান করা হতো। যখন আমি এইখান দিয়ে কোনো সময় গাড়ি নিয়ে পাস করেছি, সমস্ত শরীর আমার জ্বলে উঠত। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, দুশমনদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। অনেক ব্যথা, অনেক দন্ড , অনেক জুলুম, অনেক মামলার আসামি, অনেক কারাগারের নির্যাতন আমিই শুধু নই, হাজার হাজার কর্মী সহ্য করে, বাংলার মাটিকে মুক্ত করার জন্য সংগ্রাম করেছে।

একটা জিনিস তোমাদের মনে রাখা দরকার। দেশ যখন আমার আছে, মাটি যখন আমার আছে, বাংলার সোনার মানুষ যখন আছে, যদি আমরা সোনার ছেলে পয়দা করতে পারি, ইনশাআল্লাহ আমার যে স্বপ্ন, সোনার বাংলা, তা একদিন হবে। আমি দেখে না যাবার পারি কিন্তু ইনশাআল্লাহ হবে। আজ ইনশাআল্লাহ বাংলার সম্পদ আর কেউ লুট করে নেবার পারবে না। বাংলার মাটিতে বাংলার সম্পদ থাকবে। বাংলার মানুষ ভোগ করবে। যে জাতির ৩০ লক্ষ লোক রক্ত দিতে পারে স্বাধীনতার জন্য, সে জাতি দরকার হলে এক কোটি লোকের জীবন দেবে, বাংলার স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য।

ছেলেরা আমার, তোমরা নতুন জীবনে যাচ্ছ। মনে রেখো, তোমরা একেকজন সামরিক কর্মচারী, যাদের নিচায় থাকবে আমার সৈনিক বাহিনী। তাদের কাছেও অনেক শেখার আছে। তাদের সঙ্গে মিশতে হবে, তাদের জানতে হবে, তাদের দুঃখের সময় দাঁড়াতে হবে, তাদের পাশে থাকতে হবে। মনে রেখো, শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে। তুমি যখন শাসন করবা, সোহাগ করতে শিখো। তাদের দুঃখের দিনে পাশে দাঁড়িও, তাদের ভালোবেসো। কারণ তোমার হুকুমে সে জীবন দেবে।

তোমাকে শ্রদ্ধা অর্জন করতে হবে। সে শ্রদ্ধা অর্জন করতে হলে তোমাকে শৃঙ্খলা শিখতে হবে, নিজকে সৎ হতে হবে। নিজকে দেশকে ভালোবাসতে হবে, মানুষকে ভালোবাসতে হবে এবং চরিত্র ঠিক রাখতে হবে। তা না হলে কোনো ভালো কাজ করা যায় না। মনে রেখো, আজ তোমরা আমার প্রথম ক্যাডেট। তোমাদের দেখবে ভবিষ্যৎ ছেলেরা যারা আসবে। তোমাদের কাছে তারা শিখবে। আমার মুখ কালা করো না, দেশের মুখ কালা করো না, সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুখ কালা করো না। তোমরা আদর্শবান হও, সৎ পথে থেকো। মনে রেখো, ‘মুখে হাসি, বুকে বল, তেজে ভরা মন, মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন।’ মাঝে মাঝে আমরা অমানুষ হয়ে যাই।

মনে রেখো আমার ছেলেরা, জীবনে তোমরা যে কাজে নেমেছ, উপরের যাঁরা তোমায় হুকুম দেবে, তোমরা ওয়াদা করলা এখনই, তাঁদের হুকুম মানতে হবে। তুমি যদি তাঁদের হুকুম না মানো, নিচায় যারা আছে, তারা তোমার হুকুম মানবে না। সেই জন্যই তোমাকে হুকুম মানতে হবে। আমি তোমাদের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ কথা বলছি না, আমি তোমাদের জাতির পিতা হিসেবে আদেশ দিচ্ছি।

তোমরা সৎ পথে থেকো, মাতৃভূমিকে ভালোবেসো। মনে রেখো, তোমাদের মধ্যে যেন পাকিস্তানি মেন্টালিটি না আসে। তোমরা পাকিস্তানের সৈনিক নও, বাংলাদেশের সৈনিক। তোমরা হবা আমার পিপলস আর্মি। তোমরা শুধু সামরিক বাহিনী নও। তোমাদের দরকার হলে নিজে উৎপাদন করে খেয়ে বাঁচতে হবে। আর যেখানে অন্যায়-অবিচার দেখবা, চরম আঘাত করবা। ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবা। গুরুজনকে মেনো, সৎ পথে থেকো, শৃঙ্খলা রেখো, তাহলে জীবনে মানুষ হতে পারবা। এ কথা তোমাদের ভুললে চলবে না।

আমি গর্বিত। আমি আমার সামরিক বাহিনীকে স্মাগলিং বন্ধ করার হুকুম দিলাম। ২৫ বৎসরে স্মাগলিং বন্ধ করতে পারে নাই। কিন্তু ইনশাআল্লাহ এবার শতকরা ৯৫ ভাগ স্মাগলিং আমার সামরিক বাহিনী বন্ধ করতে পেরেছে, বিডিআরের সাহায্য নিয়ে। তাদের জনগণের সহযোগিতার প্রয়োজন।

মনে রেখো জনগণ কারা? তোমার বাপ, তোমার ভাই। তোমাদের মাইনে কোত্থেকে আসে? বাংলার দুঃখী মানুষের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে। তোমরা তাদের মালিক নও, তোমরা তাদের সেবক। তাদের, অর্থে তোমাদের সংসার চলবে। তাদের শ্রদ্ধা করতে শেখো, তাদের ভালোবাসতে শেখো। নিশ্চয় যেখানে অন্যায় হবে সেখানে দমন করবা। কিন্তু নিরপরাধ লোকের উপরে যেন অন্যায় না হয়, এদিকে খেয়াল রেখো।

আজ আমার মনে যে কী আনন্দ, তোমাদের আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। যখন আমি আগরতলা [মামলায়] বন্দী ছিলাম, যখন পাকিস্তানি মিয়াওয়ালি জেলে বন্দী ছিলাম, ভাবি নাই যে তোমাদের এভাবে প্যারেড হবে, বাংলাদেশে মিলিটারি একাডেমি হবে এবং তা আমি দেখে যাব। এ জানতাম যে হবে, ইনশাআল্লাহ হবে। এ বিশ্বাস আমার ছিল। কিন্তু দেখে যাব, এটা আমি ভাবি নাই। কিন্তু আল্লাহ আমাকে দেখাইছে। আরও দেখতে চাই। সে কী জানো? সোনার বাংলা দেখতে চাই। আরও দেখতে চাই। কী জানো? দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। আরও দেখতে চাই, এ দেশের দুঃখী মানুষ পেট ভরে ভাত খাক। গায়ে কাপড় পরুক, অত্যাচার-অবিচার-জুলুম বন্ধ হয়ে যাক।

এইটি আমি দেখতে চাই। এই জন্য সকলের কাছে আমার আবেদন। আজ তোমাদের এই প্ল্যাটফরম থেকে সামরিক বাহিনী, বেসামরিক বাহিনী, জনগণ, সকলকে আবেদন করব, সংঘবদ্ধ হয়ে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো, আর দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করো। কাজ করব না, পয়সা দাও। ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে। লাফালে চলবে না। লাফানো আমি আর এলাউ করব না। তিন বৎসর করেছি, আর নয়। কারণ দেশের সম্পদ না বাড়ালে দেশের মানুষ বাঁচতে পারে না।

তোমাদের আমার শুভেচ্ছা রইল। আমার আদেশ তোমরা মনে রেখো। আমার স্নেহের আবেদন তোমরা মনে রেখো। আমি তোমাদের দোয়া করব, বাংলার জনগণ তোমাদের দোয়া করবে। তোমরা আমার ফার্স্ট ব্যাচ। তোমরা কাল থেকে অফিসার হয়ে যাবা। তোমরা আদর্শ সৃষ্টি করো, যাতে তোমাদের যারা ফলো করে আসবে, তারাও যেন আদর্শবান হয়। তোমাদের ওপর আমার এই বিশ্বাস আছে।

রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি। এ স্বাধীনতা ইনশাআল্লাহ থাকবে, কেউ ধ্বংস করতে পারবে না। তবে স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে, যদি বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পারো। সেই জন্য তোমাদের কাছে আমার আবেদন রইল, তোমরা সৎ পথে থেকো। খোদা নিশ্চয়ই তোমাদের সাহায্য করবে। বিদায় নিচ্ছি।

                 রেকর্ড থেকে, সংক্ষেপিত

সর্বশেষ খবর