রবিবার, ২১ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধে বন্ধু রাষ্ট্র

মুক্তিযুদ্ধে বন্ধু রাষ্ট্র

১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন এক সময় বিশ্বরাজনীতিতেও বিশাল প্রভাব ফেলে। বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গ নিজ নিজ ভাবমূর্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ঘটনার মূল্যায়ন করে থাকে। তাদের প্রতিক্রিয়া নির্ধারিত হয় ঘটনার গুরুত্ব বুঝে। এর মধ্যেই অনেক দেশ সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করে। কেউ কেউ আবার নীতিগত সমর্থন জানায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো দেশগুলোর কথা লিখেছেন- রণক ইকরাম

 

অকৃত্রিম বন্ধু ভারত

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে অনেকেই বলে থাকেন ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা না থাকলে ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। আবার অনেকেই বলে থাকেন ভারত তার স্বার্থের জন্যই বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছিল। কিন্তু উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে প্রচুর সাহায্য করেছে- এটি অস্বীকারের উপায় নেই। বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের দেশে আশ্রয় দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধে সেনা সহায়তা দেওয়াসহ সব ধরনের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদ দিয়েছিল ভারত। ভারতের সামরিক বাহিনীর সহায়তায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে স্পষ্টভাবে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। আর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের পরই বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে ভারত রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও মতাদর্শগত কারণেই মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহায়তা করে। ভুটানের পর দ্বিতীয় বিদেশি রাষ্ট্র হিসেবে ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। উপমহাদেশের অন্যতম পরাশক্তি ভারতের এ স্বীকৃতি বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয়ে দারুণ ভূমিকা রেখেছিল। তবে পূর্ণ বিজয় অর্জনের ১০ দিন আগেই ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতই প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল বাংলাদেশকে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ওইদিন একটি চিঠি দিয়েছিলেন মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে। চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে ভারত সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানান এবং ভারতের পার্লামেন্টে ওইদিন সকালে এ বিষয়ে তার বিবৃতির কথাও উল্লেখ করেন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে লেখা ইন্দিরা গান্ধীর সেই চিঠি স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষের দিনগুলোয় মুজিবনগর সরকারকে তাৎপর্যপূর্ণ প্রেরণা জুগিয়েছিল। ইন্দিরার সেই চিঠির দিকে চোখ বুলালেও মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা বোঝা যায়। সেই চিঠিটি ছিল এ রকম-

নয়া দিল্লি,

ডিসেম্বর ৬, ১৯৭১

মান্যবর জনাব তাজউদ্দীন আহমদ,

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী,

মুজিবনগর।

প্রিয় প্রধানমন্ত্রী,

আপনি ও সম্মানিত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ৪ ডিসেম্বর আমাকে যে বার্তা পাঠিয়েছেন, তা ভারত সরকারের মধ্যে আমার সহকর্মী ও আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। আপনারা যার আত্মোৎসর্গী নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার যে অনুরোধ করেছেন তা আবারও বিবেচনা করেছে ভারত সরকার। আমি আনন্দের সঙ্গে আপনাদের জানাচ্ছি যে, বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে ভারত সরকার এ স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিষয়ে আজ সকালে আমাদের পার্লামেন্টে আমি একটি বিবৃতি দিয়েছি। তার অনুলিপি এর সঙ্গে যুক্ত করলাম। বাংলাদেশের জনগণকে অবর্ণনীয় দুর্দশার  ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে। আপনাদের যুবসমাজ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য আত্মোৎসর্গী সংগ্রামে নিয়োজিত। একই মূল্যবোধ রক্ষার লড়াই করছে ভারতের জনগণও। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, উদ্যমে ও ত্যাগে এই বন্ধুত্ব মহান উদ্যোগে আমাদের আত্মনিবেদন ও আমাদের দুই দেশের জনগণের মৈত্রী সুদৃঢ় করবে। পথ যত দীর্ঘই হোক এবং ভবিষ্যৎ নির্মাণের ডাকে আমাদের দুই দেশের জনগণের ত্যাগের পরিমাণ যতই হোক, আমি নিশ্চিত যে আমরা বিজয়ী হব। আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে, আপনার সহকর্মীদের এবং বাংলাদেশের বীর জনগণকে আমার অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমি একই সঙ্গে আপনার মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আমার সর্বোচ্চ সম্মান জ্ঞাপন করছি।

আপনার বিশ্বস্ত,

(ইন্দিরা গান্ধী) এর বাইরেও ভারতের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থনদান বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের ছিল। মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামরিক ব্যক্তিকে আশ্রয়দানের সুযোগ দেয়। কলকাতায় একটি প্রবাসী সরকার গঠনের ব্যবস্থা করে। এ ছাড়া পূর্ববাংলার স্বাধীনতার জন্য স্বল্প পরিমাণে সামরিক সহায়তা দিতে থাকে এবং মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়ার জন্য ভারত কূটনৈতিক প্রচারণা অব্যাহত রাখে।

মে মাসের শুরু থেকে জুনের শেষ পর্যন্ত এ সময় বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করে। যার কারণে ভারতীয় সরকার পূর্ববাংলার মুক্তি আন্দোলন নিয়ে ব্যাপকভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এই সময় ভারত পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলকে সমর্থন দিতে থাকে। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এ সময় ভারত পূর্ববাংলার সমস্যার প্রত্যাশিত সমাধানের জন্য কূটনৈতিক ও সামরিক প্রচেষ্টা জোরদার করে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দল পূর্ববাংলায় মোতায়েন করা হয়। ভারত কর্তৃক প্রেরিত তিনটি সৈন্যবহরের দুটি ছিল সপ্তম পদাতিক একটি ছিল নবম পদাতিক যাদের ভারত পূর্ববাংলার সীমান্ত এলাকায় মোতায়েন করে। এ সময় ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সব ধরনের সমর্থনদানে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে কার্যকর কূটনীতিক ও নৈতিক সমর্থন পায়। ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর এ সময় ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে। ফলশ্র“তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

 

সোভিয়েত ইউনিয়ন [রাশিয়া]

ভারতের পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় মিত্রশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েতের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে তার প্রতিপক্ষ আমেরিকা ও চীনকে হীনবল করা সম্ভব হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে আশ্বাস দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র বা চীন যুদ্ধে সম্পৃক্ত হলে তারা এর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়া সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাইন ও ধ্বংসাবশেষ অপসারণে রাশিয়ার অনেককে জীবন দিতে হয়েছে। কেবল আমাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধেই নয়, বাংলাদেশের পুনর্বাসন কাজেও সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আট দিনের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৭১-এর ৩ এপ্রিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে লেখা সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোনির চিঠিটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে চিঠিতে শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের খবরে উদ্বেগ, শক্তি ব্যবহার না করে রাজনৈতিক পথেই সংকট মোকাবিলার পরামর্শ ও মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার কথা রয়েছে। ২৫ মার্চ গণহত্যার পর প্রথম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল ভারত। দ্বিতীয়টি সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই অধ্যায়েই গণহত্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ারও উল্লেখ আছে। ইয়াহিয়ার কাছে পদগোনির চিঠি এবং ৬ এপ্রিল মার্কিননীতি নিয়ে ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেট থেকে আর্চার ব্লাড ও তার অধস্তন ২০ সহকর্মীর পাঠানো প্রতিবাদপত্র হোয়াইট হাউসকে বিব্রত করে তুলেছিল। ব্লাড লিখেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন যেখানে গণতন্ত্র সুরক্ষা ও রক্তপাত বন্ধের আবেদন করেছে, সেখানে ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র তার নৈতিক প্রতিবাদটুকুও জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। একটি পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউরোপে তার প্রভাব বলয়ের মতো এশিয়াতেও তার প্রভাব বৃদ্ধি করার জন্য ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সামষ্টিক নিরাপত্তার ধারণাও এক্ষেত্রে কাজ করেছে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তান চীনের সহযোগিতা পাওয়াটিও তারা মেনে নিতে পারেনি। ১৯৬৭-১৯৬৮ সালে পাকিস্তান, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একত্রিত হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি সাধারণ শত্র“তে পরিণত হয়। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের দুই প্রতিবেশী প্রতিপক্ষ চীন ও পাকিস্তান যাতে বাংলাদেশে যুদ্ধের মাধ্যমে কোনো ধরনের সুবিধা নিতে না পারে এ জন্য বাংলাদেশের যুদ্ধে তারা অংশগ্রহণ করে। অনেকের মতে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন করার অন্যতম কারণ ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র যে রাষ্ট্রকে সমর্থন দিত সোভিয়েত ইউনিয়ন সাধারণত তার প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রকে সমর্থন দিত।

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর পাশাপাশি প্রতিবেশী ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর অবদানও অনস্বীকার্য। বাংলাদেশে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ চলছিল, তখন বিশ্বনেতারাও নীরব ছিলেন না। ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভৃতি বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রশ্নে একযোগে কাজ করেছে। বাংলাদেশকে নিয়ে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে তা নিয়ে জাতিসংঘে তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু হয় এবং প্রস্তাব উঠে যুদ্ধবিরতির। এ প্রস্তাবের বিপক্ষে একাধিকবার ভেটো প্রদান করে সোভিয়েত ইউনিয়ন...

 

ভুটান

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম স্বীকৃতি প্রদানকারী দেশ ছিল একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ভুটান। ভুটান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। সরকার ছাড়াও তৎকালীন ভুটানের জনগণও বাংলাদেশের প্রতি তাদের নৈতিক সমর্থন জানায়।

১৯৭১ সালে একজন সমাজকর্মী হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন জানানোর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন উগিয়েন তেসারিং যিনি ক’দিন আগেই বিদেশি বন্ধু হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা লাভ করেন। তিনি ছাড়াও ভুটানের আরও বেশকিছু সমাজকর্মী এবং সংবাদমাধ্যম নৈতিকভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন জানিয়েছিল। ভুটানের এই স্বীকৃতি পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দারুণ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।

 

মিসর ও অন্যান্য

মুসলিম এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মিসর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে। এর বাইরে ইরাকও বাংলাদেশকে সমর্থন করে। বাংলাদেশের পক্ষে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনের শরিক ভারতের অবস্থানকেই সমর্থন করেছে তারা। সেই সূত্রেই গণহত্যার বিপরীতেই অবস্থান ছিল মিসরের। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানকারী প্রথম দিকের রাষ্ট্রগুলোর একটি মিসর। মিসরের মিডিয়াতেও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে লিখেছেন অনেকেই। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে কায়রোর আধা সরকারি সংবাদপত্র আল আহরামের সম্পাদক ড. ক্লোভিস মাসুদ ভারত থেকে শরণার্থীদের নিরাপদে এবং দেশে ফেরার ব্যবস্থা করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাগিদ দেন। এর পাশাপাশি একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের কথাও বলেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর পাশাপাশি প্রতিবেশী ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর অবদানও অনস্বীকার্য। বাংলাদেশে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ চলছিল, তখন বিশ্বনেতারাও নীরব ছিলেন না। ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভৃতি বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রশ্নে একযোগে কাজ করেছে। বাংলাদেশকে নিয়ে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে তা নিয়ে জাতিসংঘে তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু হয় এবং প্রস্তাব উঠে যুদ্ধবিরতির। এ প্রস্তাবের বিপক্ষে একাধিকবার ভেটো প্রদান করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। কারণ যুদ্ধে সে সময় পাকিস্তানের পরাজয় ছিল সময়ের ব্যাপার। ব্রিটেন এবং ফ্রান্সও ভোটদানে বিরত থাকে।

বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমের ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানি গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী কার্যক্রম তারা তাদের লেখনী ও প্রচারণার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছে।

 

স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল যেসব দেশ

১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। বিজয়ের এ পথ-পরিক্রমা একদিকে যেমন রক্তাক্ত ছিল, তেমনি বিশ্ব মানচিত্রে আলাদা একটা অবস্থান তৈরিও সহজ ছিল না। এরপরও অনেক দেশই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আবার বিজয়ের পর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী কিংবা পাকিস্তানের পক্ষের অনেক দেশও পরিস্থিতির কারণে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। এ তালিকাটি তুলে ধরা হলো-

 

১. ভুটান-৩ ডিসেম্বর ১৯৭১

২. ভারত-৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

৩. পূর্ব জামানি-১১ জানুয়ারি ১৯৭২

৪. মঙ্গোলিয়া-১১ জানুয়ারি ১৯৭২

৫. পোল্যান্ড-১২ জানুয়ারি ১৯৭২

৬. বুলগেরিয়া-১২ জানুয়ারি ১৯৭২

৭. মিয়ানমার-১৩ জানুয়ারি ১৯৭২

৮. নেপাল-১৬ জানুয়ারি ১৯৭২

৯. বার্বাডোস-২০ জানুয়ারি ১৯৭২

১০. যুগোস্লাভিয়া (সার্বিয়া)-২২ জানুয়ারি ১৯৭২

১১. টোঙ্গা-২৪ জানুয়ারি ১৯৭২

১২. সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া)-২৪ জানুয়ারি ১৯৭২

১৩. চেকোস্লোভাকিয়া (চেকপ্রজাতন্ত্র)-২৪ জানুয়ারি ১৯৭২

১৪. সাইপ্রাস-২৬ জানুয়ারি ১৯৭২

১৫. হাঙ্গেরি-৩১ জানুয়ারি ১৯৭২

১৬. অস্ট্রেলিয়া-৩১ জানুয়ারি ১৯৭২

১৭. ফিজি-৩১ জানুয়ারি ১৯৭২

১৮. নিউজিল্যান্ড-৩১ জানুয়ারি ১৯৭২

১৯. সেনেগাল-১ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

২০. ব্রিটেন-৪ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

২১. পশ্চিম জার্মানি-৪ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

২২. ফিনল্যান্ড-৪ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

২৩. ডেনমার্ক-৪ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

২৪. সুইডেন-৪ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

২৫. নরওয়ে-৪ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

২৬. আইসল্যান্ড-৪ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

২৭. ইসরায়েল-৪ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

২৮. অস্ট্রিয়া-৮ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

২৯. পশ্চিম সামোয়া (সামোয়া)-৮ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

৩০. কিউবা-৯ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

৩১. জাপান-১০ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

৩২. লুক্সেমবার্গ-১১ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

৩৩. নেদারল্যান্ড-১১ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

৩৪. বেলজিয়াম-১১ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

৩৫. আয়ারল্যান্ড-১১ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

৩৬. ইতালি-১২ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

৩৭. ফ্রান্স-১৪ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

৩৮. কানাডা-১৪ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

৩৯. সিঙ্গাপুর-১৬ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

৪০. মরিশাস-২০ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

৪১. ফিলিপাইন-২৪ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

৪২. ইন্দোনেশিয়া-২৫ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

৪৩. মালয়েশিয়া-২৫ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

৪৪. মালাবি-২৯ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২

৪৫. গাম্বিয়া-২ মার্চ ১৯৭২

৪৬. শ্রীলঙ্কা-৪ মার্চ ১৯৭২

৪৭. সোয়াজিল্যান্ড-১০ মার্চ ১৯৭২

৪৮. গ্রিস-১১ মার্চ ১৯৭২

৪৯. সুইজারল্যান্ড-১৩ মার্চ ১৯৭২

৫০. লোসোনা-২১ মার্চ ১৯৭২

৫১. বতসেয়ানা-২৩ মার্চ ১৯৭২

৫২. জ্যামাইকা-২৫ মার্চ ১৯৭২

৫৩. তাইওয়ান-২৮ মার্চ ১৯৭২

৫৪. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-৪ এপ্রিল ১৯৭২

৫৫. গ্যাবন-৬ এপ্রিল ১৯৭২

৫৬. মালাগাছি (মাদাগাস্কার)-১৪ এপ্রিল ১৯৭২

৫৭. সিয়েরা লিওন-২১ এপ্রিল ১৯৭২

৫৮. লাওস-২৫ এপ্রিল ১৯৭২

৫৯. লাইবেরিয়া-২৬ এপ্রিল ১৯৭২

৬০. কোস্টারিকা-২ মে ১৯৭২

৬১. ভেনেজুয়েলা-২ মে ১৯৭২

৬২. কলম্বিয়া-২ মে ১৯৭২

৬৩. মেক্সিকো-১১ মে ১৯৭২

৬৪. স্পেন-১২ মে ১৯৭২

৬৫. দক্ষিণ কোরিয়া-১২ মে ১৯৭২

৬৬. ব্রাজিল-১৫ মে ১৯৭২

৬৭. আর্জেন্টিনা-২৫ মে ১৯৭২

৬৮. হাইতি-২৬ মে ১৯৭২

৬৯. চিলি-১ জুন ১৯৭২

৭০. ইকুয়েডর-৬ জুন ১৯৭২

৭১. জাম্বিয়া-২১ জুন ১৯৭২

৭২. রুমানিয়া-২৮ জুন ১৯৭২

৭৩. ইরাক-৮ জুলাই ১৯৭২

৭৪. তানজানিয়া-১২ জুলাই ১৯৭২

৭৫. মাল্টা-১৯ জুলাই ১৯৭২

৭৬. ডোমিনিকান রিপাবলিকান-১৯ জুলাই ১৯৭২

৭৭. গুয়াতেমালা-২২ জুলাই ১৯৭২

৭৮. ইয়েমেন-৩১ জুলাই ১৯৭২

৭৯. পেরু-১ আগস্ট ১৯৭২

৮০. বলিভিয়া-২ আগস্ট ১৯৭২

৮১. উগান্ডা-১৬ আগস্ট ১৯৭২

৮২. পানামা-২৪ আগস্ট ১৯৭২

৮৩. উরুগুয়ে-২৪ আগস্ট ১৯৭২

৮৪. আপার ভোল্টা (বারকিনা ফাসো)-১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭২

৮৫. প্যারাগুয়ে-২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭২

৮৬. ভ্যাটিক্যান সিটি-২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭২

৮৭. হন্ডুরাস-১৯ অক্টোবর ১৯৭২

৮৮. উত্তর ভিয়েতনাম-২৫ নভেম্বর ১৯৭২

৮৯. ইথিওপিয়া-২৫ নভেম্বর ১৯৭২

৯০. ঘানা-৮ ডিসেম্বর ১৯৭২

৯১. আফগানিস্তান-১৮ ফেব্র“য়ারি ১৯৭৩

৯২. লেবানন-২৮ মার্চ ১৯৭৩

৯৩. মরক্কো-১৩ জুলাই ১৯৭৩

৯৪. আলজেরিয়া-১৬ জুলাই ১৯৭৩

৯৫. তিউনিসিয়া-১৬ জুলাই ১৯৭৩

৯৬. মৌরিতানিয়া-১৬ জুলাই ১৯৭৩

৯৭. দক্ষিণ ভিয়েতনাম-৩১ জুলাই ১৯৭৩

৯৮. আইভরি কোস্ট-২৩ আগস্ট ১৯৭৩

৯৯. জায়ারে (গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র)-৮  সেপ্টেম্বর ১৯৭৩

১০০. মিসর-১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩

১০১. সিরিয়া-১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩

১০২. নাইজার-২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩

১০৩. গিনি-বিসাউ-৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩

১০৪. ক্যামেরুন-৬ অক্টোবর ১৯৭৩

১০৫. গিনি-১০ অক্টোবর ১৯৭৩

১০৬. জর্ডান-১৬ অক্টোবর ১৯৭৩

১০৭. ডাহোমি (বেনিন)-২২ অক্টোবর ১৯৭৩

১০৮. কুয়েত-৪ নভেম্বর ১৯৭৩

১০৯. ইরান-২২ ফেব্র“য়ারি ১৯৭৪

১১০. তুরস্ক-২২ ফেব্র“য়ারি ১৯৭৪

১১১. পাকিস্তান-২২ ফেব্র“য়ারি ১৯৭৪

১১২. নাইজেরিয়া-২৭ ফেব্র“য়ারি ১৯৭৪

১১৩. কাতার-৪ মার্চ ১৯৭৪

১১৪. সংযুক্ত আরব আমিরাত-১০ মার্চ ১৯৭৪

১১৫. কঙ্গো প্রজাতন্ত্র-২১ মার্চ ১৯৭৪

১১৬. সুদান-১৬ আগস্ট ১৯৭৫

১১৭. সৌদি আরব-১৬ আগস্ট ১৯৭৫

১১৮. ওমান-১৭ আগস্ট ১৯৭৫

১১৯. চীন-৩১ আগস্ট ১৯৭৫

১২০. ব্র“নাই-১৯৮৫

তথ্যসূত্র : বঙ্গভবনের শতবর্ষ (বঙ্গভবন) ও বাংলাদেশের তারিখ (বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান)।

সর্বশেষ খবর