মেয়েটা হাফ প্যান্ট পরে ছেলেদের সঙ্গে অনুশীলন করে। পাড়ার লোকেরা ছি ছি করে ওঠে। মা-বাবাকে দেখলেই দুই কথা শুনিয়ে দেয়। একান-ওকান হয়ে পাড়ার সীমানা ছাড়িয়ে মেয়েটার দস্যিপনার খবর ছড়িয়ে যায় দূর-বহুদূর। পাহাড়সম সামাজিক এসব বাধা পাড়ি দিয়েই সামনে এগোতে হয়েছে ফিফার সনদ পাওয়া রেফারি জয়া চাকমা এবং সালমা ইসলাম মণির। আশপাশের লোকজনের ভ্রুকুটি, আত্মীয়স্বজনের কটুকথা আরও নানান সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সাফল্যের পথে ছুটে চলার গল্পটাই বললেন তারা। এক সময় যারা দেখলেই ভ্রুকুটি করতেন তারাই এখন প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন জয়া-সালমাদের। ফিফার পরীক্ষায় পাস করেছেন জয়া ও সালমা। এবার থেকে আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনায় আর কোনো বাধা নেই তাদের। কিন্তু এ পর্যায়ে আসতে তাদের পাড়ি দিতে হয়েছে অনেকটা পথ। বারবার কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে সমাজ বাস্তবতার কাছে। রাঙামাটির মেয়ে জয়া। পড়াশোনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে বিকেএসপির নারী ফুটবল দলের কোচ। ফুটবল নিয়েই পড়ে থাকতেন তিনি দিনমান। জাতীয় দলে খেলেছেন। বেশ নামডাক ছিল সে সময়। এরপর বাংলাদেশের প্রথম মহিলা আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনাকারী রেফারি হন তিনি। ২০১০ সালে ফিফা রেফারিংয়ের ‘ক্লাস থ্রি কোর্স’ করেন। ২০১৩ সালে করেন ‘ক্লাস টু কোর্স’। ২০১৬ সালে হন জাতীয় রেফারি। এর পর দুই বছর ফিফা রেফারির পরীক্ষা দিলেও পাস করতে পারেননি। সালমা জয়ার সঙ্গেই জাতীয় রেফারি হয়েছেন। সালমার বাড়ি নেত্রকোনায়। জেলা স্টেডিয়ামে অনুশীলন করতেন তিনি। কিন্তু তারও আগে কঠিন সময় পাড়ি দিয়েছেন সালমা। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই অ্যাথলেট হিসেবে যাত্রা করেন। মাধ্যমিকে পড়ার সময় কাবাডি আর হ্যান্ডবলে বেশ নামডাক ছিল। কিন্তু ফুটবল তাকে আকর্ষণ করত সব সময়ই। নিজ জেলায় মেয়েদের ফুটবলের তেমন সুযোগ না থাকায় খুব একটা এগোতে পারেননি। তবে ফুটবল খেলার জন্য নিজের ফিটনেসটা ঠিক রাখতেন সব সময়। জেলা স্টেডিয়ামে অনুশীলনের অনুমতি পাওয়ার আগে প্রতিদিন ভোর ৩টায় উঠে দৌড়াতেন বড় ভাই মো. শফিকুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে। সালমা আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার মনে পড়ে, কেডস কিনতে হবে। কিন্তু আমার বাবার অত টাকা নেই। আমার ভাইবোনরা বলল, আমাদের কিছু লাগবে না, ওকে কেডস কিনে দাও।’ নিজের সঙ্গে লড়াই করার পর নেত্রকোনার জেলা ফুটবল কোচ সজলকে অনেক অনুরোধ করে রাজি করান অনুশীলনে নিতে। সে সময় সালমা একাই মেয়ে হিসেবে অনুশীলন করতেন নেত্রকোনার জেলা স্টেডিয়ামে। এরপর ধীরে ধীরে ফুটবলের প্রতি অনুরাগ বাড়তেই থাকে। খেলোয়াড় হিসেবে খুব বেশি দূর যেতে পারেননি সালমা। আন্তজেলা ফুটবল খেলেই থেমেছেন। অবশ্য ফুটবল থেকে দূরে থাকতে পারেননি। বদরুন্নেসা কলেজে পড়েছেন তিনি। ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অনুশীলনের অনুমতি পেয়ে যান। ততদিনে অনেকেই জানত তার ব্যাপারে। তারপরও নেতিবাচক বিষয়গুলোর অভাব ছিল না। ‘ফিফার এলিট প্যানেলে নাম লেখানোই হচ্ছে প্রথম লক্ষ্য।’ কিন্তু আরও বড়, অনেক বড় একটা স্বপ্ন দেখেন সালমা। জয়া চাকমাও কঠোর সাধনার মধ্য দিয়ে অর্জন করেছেন ফিফা রেফারির সনদ। তিনি বলেন, ‘শারীরিক যুদ্ধের সঙ্গে অবশেষে একটা মানসিক লড়াইয়েরও অবসান হলো। এখন লড়তে শিখেছি নিজের সঙ্গে। অনেক দিনের স্বপ্ন সত্যি হয়েছে বলে ভীষণ আনন্দিত।’ ২০১২ সালে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে নিয়মিত রেফারিং শুরু করেন জয়া চাকমা। এরপর একে একে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা পরিচালনা করেছেন শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও তাজিকিস্তানে। প্রায় সবখানেই সালমা ছিলেন জয়ার সঙ্গী। দেশের বাইরে গেলে দুজন নিত্যসঙ্গী। কেবল তাজিকিস্তানে সালমা যেতে পারেননি। সে সময় তার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ছিল। জয়া অবশ্য আরও বেশ কিছু স্থানে গেছেন। ২০১৫ সালে বার্লিনে আন্তর্জাতিক ফুটবল উৎসবে ১০টি ম্যাচ পরিচালনা করেন তিনি। এ ছাড়াও জয়া বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানে পরিচালনা করেছেন মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টের ম্যাচ। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত তিনি ৩৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। মেয়েদের ফুটবল অঙ্গনে নিজেকে আইকন হিসেবে দেখতে চান জয়া। ‘বাংলাদেশের মেয়েদের খেলাধুলার সংস্কৃতিটা বদলে দিতে চাই আমি। মেয়েরা এখন পেশা হিসেবে রেফারির কাজ করতে পারবে, কোচও হতে পারবে। এখন দরজাটা উন্মুক্ত হয়ে গেল মেয়েদের জন্য। আগে মেয়েরা ফুটবল খেলত না, এখন খেলে। আগে মহিলা রেফারি ছিল না, এখন হয়েছে। আগে নারী কোচ ছিল না, এখন হয়েছে। তার মানে এখন মেয়েদের মধ্যে একটা আস্থা চলে আসবে যে খেলাধুলা শেষ করলেই ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় না। আরেকটা ক্যারিয়ার তাদের সামনে হাতছানি দিচ্ছে।’ অবশ্য বাধা ডিঙিয়ে পথ চলতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন সালমা-জয়ারা।