সোমবার, ২২ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

নাজমুনের বিশ্ব ভ্রমণের গল্প

প্রতিদিন ডেস্ক

নাজমুনের বিশ্ব ভ্রমণের গল্প

বাংলাদেশের পতাকা হাতে নাজমুন নাহার ১৪৪ দেশ ভ্রমণের ঐতিহাসিক রেকর্ড অর্জন করেন মালদ্বীপে। নাজমুন নাহার বিশ্ব ভ্রমণের সময় মৃত্যুর হাতছানি থেকে ফিরে এসেছেন বহুবার। লোহিত সাগরের পাড় ঘেঁষে জিবুতি থেকে সোমালিল্যান্ডে সড়কপথে ১৮ ঘণ্টা অভিযাত্রা করেন নাজমুন। জিবুতির সীমান্ত অতিক্রম করে লোয়াদা, সায়লাক, আশাদ্দো, জিধি, ক্যাবদুলকাদির, হরিদ, কুলজিদ, বোরাম, গোরোইও, গ্যাবেলে, আরবসিও হয়ে সোমালিল্যান্ডের রাজধানী হারেগেয়েইসা পৌঁছান। তারপর সুদান অভিযাত্রা করেন তিনি। বাংলাদেশের পতাকাবাহী এ বিশ্ব অভিযাত্রী শুধু বাংলাদেশ নন, পৃথিবীব্যাপী যিনি এখন তরুণদের আইকন। ৩ ডিসেম্বর ২০২০ সোমালিল্যান্ডের জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক ‘গেসকা আফ্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয় নাজমুনের বিশ্বজুড়ে দেশ ভ্রমণের দুঃসাহসিক অভিযাত্রার কথা। নাজমুনের মাধ্যমে লাল-সবুজের পতাকার জয় ছড়িয়ে পড়েছে পুরো পৃথিবীতে।

এ ছাড়া ২৭ নভেম্বর জিবুতির একমাত্র রাষ্ট্রীয় পত্রিকা ‘লা নেশন’-এর পাতাজুড়ে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকার ছবিসহ নাজমুনকে নিয়ে বের হয় বিশেষ প্রচ্ছদ প্রতিবেদন। শুধু তাই নয়, তিনি যখন সুদান অভিযাত্রা করেন সেখানকার বিখ্যাত রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ হামদ সায়েদসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব নাজমুনকে অভিনন্দিত করেন। এ ছাড়া সোমালিল্যান্ডের ভাঙা রাস্তা, মরুপ্রান্তর, গাড়ি নষ্ট হয়ে আটকে যাওয়া, বন্যপ্রাণীর জঙ্গল ভেদ করে রাজধানী হারগেইসা পর্যন্ত অভিযাত্রা করেছেন নাজমুন। তারপর উত্তর সুদানের খার্তুমসহ আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে সফর করেন এবং তিনি মালদ্বীপের মালাহিনি দ্বীপে সাত দিনের এক রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা শেষে নিজ মাতৃভূমি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পর অবিন্তা ফাউন্ডেশন স্কুল নাজমুনকে সংবর্ধনা দেয়। সেখানে নাজমুনের বিশ্ব ভ্রমণের ভিডিওচিত্র প্রদর্শিত হয়। অবিন্তা স্কুলের শিশুদের সঙ্গে তিনি তার বিশ্ব ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন ও শিশুদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। শিশুরা তাদের নিজ হাতে অঙ্কিত বাংলাদেশের ফ্ল্যাগখচিত ফ্ল্যাগগার্ল কার্ড উপহার দেন। ২০০০ সালে প্রথম ভারত দিয়ে শুরু হয় তার পৃথিবী ভ্রমণ অভিযাত্রা। ২০ বছর তিনি পৃথিবীর পথে পথে অভিযাত্রা করেছেন না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, বাংলাদেশের পতাকাকে বিশ্ব দরবারে সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। সম্পূর্ণ ভ্রমণই ছিল একা একা, শুধু ১৪টি দেশের ভ্রমণের সঙ্গী ছিলেন তার মা। লাল-সবুজের এ পতাকাবাহী পরিব্রাজক তারকা পা রাখবেন পৃথিবীর প্রতিটি দেশে। পৃথিবীর বুকে ইতিহাস সৃষ্টি হবে নাজমুন ও বাংলাদেশের নামটি। নাজমুন নাহার পুরো পৃথিবীর একটি মানচিত্র, একটি বাস্তব অভিযাত্রার ইতিহাস। যার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৃথিবীর অনেক উঁচু উঁচু পর্বতশৃঙ্গের গল্প, ভলকানিক সামিটের গল্প, আবার সমুদ্রের দ্বীপ-উপদ্বীপের গল্প, অচেনা সব শহর, নগর সীমান্তের সব বাস্তব গল্প। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন নাজমুন নাহার। তিনি বহু সম্মাননা উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে পিস টর্চ বিয়ারার অ্যাওয়ার্ড, আর্থ কুইন অ্যাওয়ার্ড, জাম্বিয়া সরকারের গভর্নরের কাছ থেকে ফ্ল্যাগ গার্ল উপাধি, অনন্যা শীর্ষ ১০ অ্যাওয়ার্ড, জনতা ইন্টারন্যাশনাল দিয়েছে গেম চেঞ্জার অব বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড, অতীশ দীপঙ্কর গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ডসহ অনেক উপাধি ও সম্মাননা পেয়েছেন নাজমুন নাহার। নাজমুন নাহার উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এবং একজন গবেষক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। এ ছাড়াও তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে হিউম্যান রাইটস ও এশিয়া বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। পৃথিবী ভ্রমণ করতে বহু কঠিন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন নাজমুন। নাজমুন ইথিওপিয়ার জঙ্গলে হামার আদিবাসীদের সঙ্গে গরুর কাঁচা মাংস খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে, আফ্রিকাতে তিন মাস আলু খেয়েছিলেন। সর্বোচ্চ আড়াই দিন না খেয়ে থাকার রেকর্ড আছে তার। পথে গাছ থেকে গাছের সাদা অরেঞ্জ খেয়ে দুই দিন পর আফ্রিকাতে পানির পিপাসা মিটিয়েছেন।

তিনি সড়কপথে ভ্রমণ করেছেন দিনের পর দিন, সর্বোচ্চ টানা ৫৮ ঘণ্টা, কখনো ৪৮ ঘণ্টা, কখনো ৩৬ ঘণ্টা তাকে বাসে জার্নি করতে হয়েছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে। এটা ভাবলে অবাক লাগে যখন টানা কখনো ১৫ দেশ কখনো ১৪ দেশ, কখনো ১৪ দেশ এভাবে তিনি তিন মাস, চার মাস, পাঁচ মাসের জন্য সড়কপথে এক শহর থেকে আরেক শহরে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণ করেছেন। চিলির আতাকামা যেখানে ১০০ বছরে বৃষ্টি হয়নি এমন আশ্চর্যজনক জায়গাতেও পা পড়েছে নাজমুন নাহারের। আফ্রিকার গিনি কোনাক্রিতে ২৬ ঘণ্টা জঙ্গলে আটকা পড়েছেন রাতের অন্ধকারে। জর্জিয়ার সনেটি প্রদেশ যাওয়ার সময় পথে গুলির মুখোমুখি হয়ে পাহাড়ে বুক বিছিয়ে চার ঘণ্টা শুয়েছিলেন। সাহারা মরুভূমিতে ভয়ংকর মরুঝড়ের মুখোমুখি হয়েছেন, গুয়াতেমালায় ছিনতাইকারীর গুলি আর ছুরির মুখোমুখি হয়েও ফিরে এসেছেন কৌশলে। শুধু কি তাই, তিনি কিরগিজস্তানের আলা আরচা পর্বত সামিটে ওঠার সময় পা পিছলে পড়ে ছোট্ট একটা বুনো গাছের সঙ্গে ঝুলে ছিলেন- উঁচু পর্বত থেকে ঝুলে যাওয়া শরীরের নিচে ছিল গহিন ফাঁকা যেখানে বাঁচার কোনো উপায় ছিল না। মৃত্যুকে বারবার কাছ থেকে দেখার এমন গল্প যেন শেষ হওয়ার নয়।

সর্বশেষ খবর