বুধবার, ২৪ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

বিশ্বসেরা সাকিব

প্রতিদিন ডেস্ক

বিশ্বসেরা সাকিব

মাগুরার সেই ছেলেটি

  মাগুরায় তাকে সবাই ফয়সাল নামেই চেনে। পরিবারের মানুষজনের কাছে এখনো তিনি ফয়সালই। অনেকেই জানেন না বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের ডাক নাম ফয়সাল। জন্ম ১৯৮৭ সালের ২৩ মার্চ, মাগুরায়। সাকিবের বাবা মাশরুর রেজা বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং মাতা শিরিন শারমিন একজন গৃহিণী। পারিবারিক বলয়ের কারণে ছোটবেলা থেকেই খেলাপাগল ছিলেন সাকিব। তবে সেই বলয়ের কারণে সাকিবের হওয়ার কথা ছিল ফুটবলার। সাকিবের বাবা খুলনা বিভাগের হয়ে এবং এক কাজিন বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলতেন। কিন্তু সাকিবের গন্তব্য ছিল ভিন্ন দিকে। একজন ক্রিকেটার সারা বিশ্ব কাঁপানোর যে অদৃষ্টের লিখন ছিল, সাকিব সেদিকেই হাঁটছিলেন। সাকিবের বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে ফুটবলার হোক। একটা সময় সাকিব নিজেও ফুটবলার হতে চাইতেন। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কেনিয়াকে হারিয়ে আইসিসি ট্রফি জয় করে বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেলে সারা দেশে শুরু হওয়া ক্রিকেট জ্বরে আক্রান্ত হলেন সাকিবও। তাই শেষ পর্যন্ত সাকিব ক্রিকেটকেই বেছে নিলেন। তার সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

২০০১ সালের দিকে ক্লাস সেভেনে থাকাকালীন আলোকদিয়ার মাঠে সাকিব গিয়েছিলেন ভাড়ায় খেলতে। বিধ্বংসী ব্যাটিং আর পেস বোলিংয়ে নজর কাড়লেন সবার। ভুল পড়ছেন না, ঠিকই পড়ছেন। শুরুর দিকে সাকিব আল হাসান কিন্তু পেসারই ছিলেন। আলোকদিয়ার মাঠের সেই খেলায় আম্পায়ার ছিলেন সাদ্দাম হোসেন গোর্কি। তিনি আবার স্থানীয় পর্যায়ের একজন কোচও। সাকিবের খেলা তাকে দারুণ মুগ্ধ করল। এই মুগ্ধতার প্রকাশ ঘটাতে সাদ্দাম হোসেন সাকিবের মেধাকে কাজে লাগাতে চাইলেন। তার পরামর্শে সাকিব মাগুরায় ইসলামপুরপাড়া স্পোর্টিং ক্লাবে যোগ দেন। এটি মাগুরা লিগের একটি পরিচিত দল। এর আগ পর্যন্ত সাকিবের সব খেলা হয়েছিল টেপড টেনিস বলে। তখনো পর্যন্ত সাকিব আসল ক্রিকেট বলের দেখাই পাননি। সেখানেও নতুন ক্রিকেট বলে প্রথমে পেস বোলিং শুরু করেন সাকিব। জোরে বল করার মধ্যে আলাদা মজা পেতেন সাকিব। কিন্তু তার কোচ সাদ্দাম হোসেন সাকিবকে স্পিন বল শুরু করতে বলেন। সত্যিকার ক্রিকেট বল দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে করা সাকিবের প্রথম বলটি ছিল স্পিন বল। এবং প্রথম বলেই উইকেট পান সাকিব।

সাকিব ২০০১ সালে বিকেএসপির প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রমে মাগুরা জেলা থেকে নড়াইল ক্যাম্পের জন্য নির্বাচিত হন। নড়াইল ক্যাম্প থেকে ঢাকার বিকেএসপিতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য যে ২০ জন সুযোগ পেয়েছিল, সাকিব তাদেরই একজন। তখনই আসলে সাকিবের মূল ক্যারিয়ারের শুরু। বিকেএসপিতে ভর্তির পর বাংলাদেশের হয়ে বয়সভিত্তিক দলগুলোতে [অনূর্ধ্ব-১৫-১৭-১৯] খেলার সুযোগ পান। আর সেখানেই মেধার স্বাক্ষর রাখেন সাকিব। পনেরো বছর বয়সে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলা সাকিব আসলে তখনই জাতীয় দলে কড়া নাড়ছিলেন।

অভিষেকের দিন...

৬ আগস্ট ২০০৬, বাংলাদেশ বনাম জিম্বাবুয়ের পঞ্চম ওয়ানডে ম্যাচ। অভিষেক হলো এক তরুণ খেলোয়াড়ের, নাম সাকিব আল হাসান। বল হাতে ১০ ওভারে ৩৯ রানের বিনিময়ে এলটন চিগাম্বুরার উইকেট এবং ব্যাট হাতে ৪৯ বলে অপরাজিত ৩০ রানের একটি ইনিংস। এটি ছিল সিরিজের শেষ ম্যাচ যাতে জিম্বাবুয়ে ৩-২ ব্যবধানে জয়ী হয়। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে সাকিব, ফরহাদ রেজা ও মেহরাব হোসেন জুনিয়র বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ আয়োজিত ২০০৭ ক্রিকেট বিশ্বকাপে হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বাধীন ১৫ জনের বাংলাদেশ স্কোয়াডে ডাক পান সাকিব। বাংলাদেশ সেবার টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় পর্বে যেতে সক্ষম হয় এবং সপ্তম টিম হিসেবে টুর্নামেন্ট শেষ করে। সেবার শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে বিশ্বকে চমকে দেয়। টুর্নামেন্টে ৯ ম্যাচে তিনি ২৮.৮৫ গড়ে ২০২ রান করেন। বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রান করেন মোহাম্মদ আশরাফুল (২১৬)। সাকিব ৪৩.১৪ গড়ে ৭টি উইকেটও নেন। সে বছরই মে মাসে দুই টেস্ট ও তিন ওয়ানডের এক সফরে ভারত বাংলাদেশে আসে। মে মাসের ১৮ তারিখ সাকিবের টেস্ট অভিষেক হয় ভারতের বিপক্ষে। অভিষেকটা খুব একটা ভালো না হলেও ছন্দে ফিরতে সময় নেননি সাকিব। পরের গল্প কেবলই এগিয়ে চলার।

বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হয়ে ওঠা...

সাকিবের ক্যারিয়ারটা বেশ অদ্ভুতুড়ে। শুরুর দিকে বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে দলে ঢোকেন সাকিব। এরপর দলে ঢোকার পর হয়ে ওঠেন পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান। মূলত একজন অলরাউন্ডার হিসেবে পারফর্ম করলেও ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ড দলের বাংলাদেশ ট্যুরের আগ পর্যন্ত সাকিবকে বোলার নয়, ব্যাটসম্যান হিসেবেই গণ্য করা হতো। তখন টেস্টে সাত নম্বরে ব্যাটিংয়ে নামলেও ওয়ানডেতে কিন্তু প্রথম পাঁচ ব্যাটসম্যানের মধ্যেই থাকতেন সাকিব। তখনকার কোচ জেমি সিডন্স হুট করে ঘোষণা দেন, সাকিবকে স্পেশালিস্ট বোলার হিসেবেই টেস্ট সিরিজ খেলানো হবে। কোচকে হতাশ করেননি সাকিব। উদ্বোধনী টেস্টের প্রথম ইনিংসেই তিনি ৩৭ রান দিয়ে তুলে নেন সাতটি উইকেট। তখন পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশি বোলারের টেস্টে এটাই ছিল বেস্ট বোলিং ফিগার। বাংলাদেশ সিরিজ হারে ২-০ তে, কিন্তু সাকিব ১৭.৮০ গড়ে ১০টি উইকেট নিয়ে সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হন। ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচটিতে বাংলাদেশ জয় পায়। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়ানডেতে এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম জয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাংলাদেশ সিরিজ হারে ২-১ ব্যবধানে। সাকিব ৩ ম্যাচে ৫ উইকেট তুলে নেন।

পরের মাসেই বাংলাদেশ দল দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যায়। সাকিবের বোলিং পারফরম্যান্স এখানেও অব্যাহত থাকে। প্রথম টেস্টের প্রথম দিন সাকিব উইকেটশূন্য থাকলেও দ্বিতীয় দিনেই পাঁচ উইকেট তুলে নেন। দ্বিতীয় টেস্টে সাকিব আবারও এক ইনিংসে ৫ উইকেট তুলে নেন। সিরিজ শেষে সাকিবের ঝুলিতে জমা হয় ২০.৮১ গড়ে ১১টি উইকেট। ২০০৮ এর ডিসেম্বর মাসে শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশে দুটি টেস্ট ও একটি ত্রিদেশীয় ওয়ানডে টুর্নামেন্ট [অপর দলটি ছিল জিম্বাবুয়ে] খেলতে আসে। দুটো টেস্টই শ্রীলঙ্কা জিতে নেয়। সেই সঙ্গে ওয়ানডে টুর্নামেন্টের ফাইনালও। গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে সাকিবের করা হার না-মানা ৯২ রানের ইনিংসটি বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সিরিজের একমাত্র জয়ের স্বাদ এনে দেয়। সাকিব ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন। ২২ জানুয়ারি, ২০০৯ সাকিব আইসিসির ওডিআই অল-রাউন্ডার র‌্যাংকিংয়ে ১ নম্বরে উঠে আসেন। ২০১১ সালে আইপিএলের নিলামে তাকে ৪ লাখ ২৫ হাজার ডলারের বিনিময়ে কলকাতা নাইট রাইডার্স কিনে নেয়। এরপর কেবলই এগিয়ে চলা কলকাতার হয়ে জিতেছেন ট্রফি। বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় সব ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ মাতিয়েছেন বিশ্বের সেরা সব ক্রিকেটারের সঙ্গে। মোহাম্মদ আশরাফুলের পর মাশরাফিকে যখন অধিনায়ক করা হয়, তখন সাকিবকে ডেপুটি করা হয়। এরপর মাশরাফির ইনজুরিতে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পান সাকিব। সেই সুযোগেই দলকে বিজয় এনে দেন। এরপর স্থায়ীভাবে দলের দায়িত্ব নেন। আবার সেটি হারিয়েও ফেলেন। শৃঙ্খলাজনিত কারণে ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল। এরপর আবার ফিরেও এলেন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ তো বটেই বিশ্বের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে নিজের নামটাকে আস্তে আস্তে জ্বলজ্বলে করে তুলছেন সাকিব আল হাসান।

এক নজরে...

পুরো নাম : সাকিব আল হাসান।

পরিচিত : সাকিবুল হাসান।

জন্ম : ২৪ মার্চ ১৯৮৭ মাগুরা।

বর্তমান বয়স : ৩২ বছর ৩ মাস ৩ দিন।

খেলার ধরন : অলরাউন্ডার।

ব্যাটিং ধরন : বাঁ-হাতি।

বোলিং ধরন : বাঁ-হাতি অর্থোডক্স।

খেলার ক্ষেত্র : বাংলাদেশ, অ্যাডিলেড স্ট্রাইকার, বাংলাদেশ ‘এ’ দল, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড একাদশ, বার্বাডোস ট্রাইডেন্টস, ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরস, ঢাকা আবাহনী, ঢাকা মোহামেডান, লিজেন্ড অব রূপগঞ্জ, জ্যামাইকা তাল্লাওয়াস, করাচি কিংস, খুলনা ডিভিশন, কলকাতা নাইট রাইডার্স, পেসোয়ার জালমি, সানরাইজার্স হায়দরাবাদ, ওরচেস্টারশায়ার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর